মজিনার কড়া সমালোচনা সংসদে-জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি

জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সরকারকে আলোচনায় বসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার আহ্বানের কঠোর সমালোচনা করেছেন সরকারদলীয় সংসদ সদস্যরা। তাঁরা বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়ে শক্তিধর দেশটির রাষ্ট্রদূত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বাধা সৃষ্টিকারীদের উৎসাহিত করেছেন।
সংসদ সদস্যরা মজিনার প্রতি প্রশ্ন করেন, 'আপনার দেশের পুলিশের ওপর যদি তারা (জামায়াত-শিবির) হামলা করত, তাহলে কি আপনারা আক্রমণকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতেন?'
গতকাল রবিবার মাগরিবের নামাজের বিরতির পরে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে পয়েন্ট অব অর্ডারে এই সমালোচনা করেন সিনিয়র সংসদ সদস্যরা। জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার পক্ষেও যুক্তি দেখান তাঁরা। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর শরিয়া আইনের বিচারবিষয়ক বক্তব্যে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে এর ব্যাখ্যা দাবি করেন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ফজলুল আজিম। প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, 'কথার ছলে এ কথাটি এসেছে। উনি যে এ কথাটি বলেছেন, তা আমরা অস্বীকার করছি না।' তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, 'তারা তো বলেন অমুকের আইন চাই, তমুকের আইন চাই। যদি লাফালাফি করেন দেখি সেটা প্রয়োগ করে।'
যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করে তোফায়েল আহমেদ বলেন, 'যারা জঙ্গি উত্থানের বিরুদ্ধে। যারা লাদেনকে হত্যা করেছে। ইরাক ও লিবিয়াতে যারা ব্যবস্থা নেয়। তারা কী করে একটি জঙ্গি সংগঠনকে সমর্থন দেয়।' তিনি বলেন, 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এর সঙ্গে বিএনপি জড়িত। আমরা যেকোনো মূল্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ সমাপ্ত করব।' তোফায়েল বলেন, 'স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলব, বক্তৃতা-বিবৃতি না দিয়ে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনুন। কারণ মানুষ এটা ভালোভাবে দেখছে না। অন্য সময় হলে এই ঘটনার পর গুলি করা হতো, অনেক ঘটনা ঘটত। কিন্তু পুলিশ তা না করে ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। এ জন্য আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই।'
শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার গোটা জাতির দাবি। বিচার শেষ পর্যায়ে আসায় অরাজকতা-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে তা বন্ধ করতে চাচ্ছে জামায়াত-শিবির। তাদের কোনো ক্ষমা করা যাবে না। বিএনপি এখনো তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। তারাও চায় না বিচার হোক। সাংবিধানিক নিয়মকানুন তারা মানছে না। জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি বন্ধের দাবি করে সেলিম বলেন, 'বোমা মারার জন্য জেএমবিকে যখন নিষিদ্ধ করা গেল, তখন পুলিশ ও আইনমন্ত্রীকে আক্রমণ করার জন্য কেন জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করা যাবে না। এদের নিষিদ্ধ করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হোক।'
ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন বলেন, কয়েক দিন ধরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের দাবি নিয়ে জামায়াত-শিবির পুলিশের ওপর আক্রমণ করেছে। আইনমন্ত্রীর গাড়িতে আক্রমণ চালিয়ে তারা রাষ্ট্রের ওপর আক্রমণ করেছে। জামায়াতের এই ঘটনা নতুন কিছু নয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও বিএনপি তাদের পক্ষ হয়ে কথা বলছে। তিনি বলেন, 'ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পরিণাম, ফল এটাই। বাহাত্তরের সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীতে আমরা তার সঙ্গে আপস করেছি। সময় এসেছে জামায়াত-শিবিরের এই ধরনের তৎপরতার ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করার।'
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে মতিয়া চৌধুরী বলেন, 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সবাই চেয়েছে। জাতি বিচারের জন্য উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করছে। এটা আমাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। এর ভিত্তিতে বিপুল গণরায় নিয়ে সরকার গঠন করেছি। সময় অনেক গড়িয়ে গেলেও বিচার শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মানদণ্ড বজায় রেখেই এ বিচার হচ্ছে।'
তিনি বলেন, এমন অবস্থায় বিএনপি এখন যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। খালেদা জিয়া তাদের মুক্তি দাবি করেছেন। একই সঙ্গে তিনি এই বিচার নিয়ে প্রতিবাদও জানিয়েছেন। মতিয়া বলেন, কয়েকটি মামলার শুনানি প্রায় শেষ পর্যায়ে এসেছে। এ অবস্থায় জামায়াত দেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় পুলিশের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়েছে। কোনো প্রতিবাদের কর্মসূচি না দিয়ে কমান্ডো স্টাইলে হামলা করেছে। পুলিশকে রক্তাক্ত করল। তাদের গায়ে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু পুলিশ ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বিবৃতির কড়া সমালোচনা করে কৃষিমন্ত্রী বলেন, 'একটি শক্তিধর দেশের রাষ্ট্রদূত জামায়াতের সঙ্গে আমাদের বসার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। আমি প্রশ্ন করি, তাঁর দেশের পুলিশের ওপর যদি হামলা করা হতো, তাহলে কি তাঁরা তাদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। তাঁরা কি প্রেমালাপে বসতেন। বিচারের পক্ষে গণরায়ের পর এ ধরনের কথা কাদের উৎসাহিত করে? নিশ্চয়ই তাঁর এই বক্তব্য আক্রমণকারীদের উৎসাহিত করেছে।' তিনি বলেন, আইনের মাধ্যমে এর চেয়ে স্বচ্ছতার সঙ্গে পৃথিবীর কোথাও কোনো বিচার হয়নি। বিভিন্ন দেশের লোক এসে এই বিচার নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলতে পারেনি।
স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ফজলুল আজিম বলেন, 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। বিচার শুরু হয়েছে, বিচার হবে। কিন্তু এটাকে কেন্দ্র করে জামায়াত-শিবির যে সহিংসতার আশ্রয় নিয়েছে, তা কাম্য নয়। তারা সহিংসতার আশ্রয় নিয়ে দেশের আইন ভঙ্গ করছে। প্রচলিত আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে এই আইন ভঙ্গকারীদের বিচার হবে। কিন্তু বিচারকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রীর শরিয়া আইনের বিচারবিষয়ক বক্তব্য উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে। শরিয়া আইন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও সংবিধান পরিপন্থী। আমরা সংবিধান সংশোধন করে শরিয়া আইনে যাচ্ছি কি না? প্রধানমন্ত্রী সত্যিকার অর্থে সংবিধান সংশোধন করে শরিয়া আইন চালু করবেন কি না, জানতে চাই।'
ফজলুল আজিমের উৎকণ্ঠার সঙ্গে একমত প্রকাশ করে রাশেদ খান মেনন বলেন, 'প্রধানমন্ত্রীর শরিয়া আইন নিয়ে আমিও বিভ্রান্ত হয়েছি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেশের প্রচলিত আইন ও সংবিধানই যথেষ্ট। এটা অনুসরণ করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করা সম্ভব।'
এ সময় স্পিকার বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী সংসদে নেই। তিনি কী প্রেক্ষাপটে, কেন বলেছেন, কিভাবে বলেছেন, তা উনিই ভালো বলতে পারবেন। তিনি নিশ্চয়ই শুনবেন এবং হাউসে এসে এ বিষয়ে ওনার অভিমত ব্যক্ত করবেন।' এ ছাড়া পয়েন্ট অব অর্ডারে বক্তব্য দেন অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু।

No comments

Powered by Blogger.