এমপির ভাইয়ের গ্রাসে দুই গ্রামের জমি-প্রতিরোধে একাট্টা আখাউড়ার শতাধিক পরিবার by বিশ্বজিৎ পাল বাবু

'৪০-৫০ বছর ধইরা এইহানে থাহি। কিনা সূত্রে জায়গার মালিক আমরা। অহন শুনতাছি এমপি শাহ আলমের ভাই দলিল কইরা লইছে; জোর দেহাইয়া আমরারে উডানের চেষ্টা করতাছে। আমরার গ্রামে দলাদলি থাকলেও এই ব্যাপারে সবাই এক অইছি। জান দিমু, তবু আমরা জাগা ছাড়তাম না'- বলছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার বনগজ গ্রামের বাসিন্দা সৈয়দ খান।
তিনি এলাকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। গত শনিবার রাতে ওই এলাকার মোর্শেদ নামের এক যুবকের কাছে মোবাইল ফোনে জায়গা-সংক্রান্ত বিষয়ে জানতে চাইলে কথা টেনে নিয়ে এ প্রতিবেদককে কথাগুলো বলেন সৈয়দ খান।
গতকাল রবিবার সকালে ধরখার ইউনিয়নের বনগজ গ্রামে গেলে সাংবাদিক এসেছেন শুনেই অহিদ মিয়া নামের একজনের বাড়িতে এলাকার শতাধিক লোক জড়ো হয়। এলাকাবাসী অভিযোগ করে, ভুয়া ওয়ারিশান এবং জায়গার মালিক সাজিয়ে আমমোক্তারনামার (পাওয়ার অব অ্যাটর্নি) মাধ্যমে বনগজ গ্রামের ৩৬ একর ৭৭ শতক এবং তন্তর গ্রামের ২৬ একরসহ মোট ৬৯ একর ৩৭ শতক ভূমি গ্রহীতা হিসেবে গ্রহণ করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া) আসনের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শাহ আলমের ভাই মো. সেলিম ও শামছুল আলম নামের এক ব্যক্তি। গ্রাম দুটির বেশির ভাগ অংশজুড়েই আছে এই জমি। জমিতে প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ঈদগাহ মাঠও রয়েছে। গ্রামবাসী তাই মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে বলে এ প্রতিবেদককে জানিয়েছে। এ ছাড়া আইনি লড়াইয়ের বিষয়েও তারা চিন্তা-ভাবনা করছে। গতকাল কথা বলার একপর্যায়ে তারা জায়গা রক্ষার জন্য মোনাজাত করে। দুই গ্রামের বাসিন্দারা জানায়, খবর পাওয়ার পর গত ২৪ অক্টোবর সভা করে এ
বিষয়ে আইনি লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ছিদ্দিকুর রহমানের সভাপতিত্বে ওই সভায় যেকোনো মূল্যে ভুয়া দলিলদারিদের প্রতিরোধের ঘোষণা দেয় এলাকাবাসী। গত ৪ নভেম্বর এলাকার লোকজন বিষয়টি মৌখিকভাবে সংসদ সদস্যকেও জানায়।
বনগজ গ্রামে ঢুকতেই প্রাথমিক বিদ্যালয়-সংলগ্ন বাড়ির রুবিনা বেগম নামে এক নারী সাংবাদিক পরিচয় জেনে উচ্চ কণ্ঠে বলেন, 'কেউ যদি এ জমি নিত আইয়ে আমি আমার পাঁচ মাইয়া লইয়া মইরা যামু। এমপি ভোটের সম আইছিল। এরফর আর খোঁজ না থাকলেও অহন ভাইরে দিয়া জাগা দহল করাইত চাইতাছে।'
গ্রামের মহল মিয়া নামে এক ব্যক্তি বলেন, '১৭ শতক জমিতে ধান চাষ কইরা খাই। অহন যদি অই জমি নিত আইয়ে তাইলে ভিক্ষার থলি লওন ছাড়া আমার কোনো উফায় থাকত না। এর আগে আমরা পুলা-মাইয়ারে কাইট্টা ভাসাই দিমু।'
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এই আসনটি কসবা ও আখাউড়া এই দুই উপজেলা নিয়ে গঠিত। সংসদ সদস্য শাহ আলমের বাড়ি বর্ণি গ্রামে।
বনগজ ও তন্তর গ্রামের বাসিন্দারা জানায়, ষাটের দশকে চন্দ্র কুমার ঘোষ, নিরুদা সুন্দরী, জ্যোতি রানী ঘোষসহ অন্যদের কাছ থেকে বনগজ এবং তন্তর এলাকার প্রায় ৭৩ একর জমির বিনিময় সূত্রে মালিক হন চান মিয়া, আবদুল কাদির ও আবদুল হামিদ। তাঁদের মধ্যে একমাত্র জীবিত আবদুল কাদির এখনো এই গ্রামে বসবাস করেন। বাকি দুজন ও তাঁদের ওয়ারিশদাররা অনেক আগেই তাঁদের সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে চলে যান। এসব সম্পত্তি একাধিকবার বিক্রিও হয়েছে।
এদিকে গত ২০ অক্টোবর রেজিস্ট্রি হওয়া আমমোক্তারনামায় যাঁদের নাম দেখা গেছে তাঁদের কোনোদিনও দেখেনি এলাকাবাসী এবং তাঁদের বাড়ি দেশের বিভিন্ন জেলায়। এই ব্যক্তিরা হলেন- চট্টগ্রামের পটিয়ার মানিক মিয়া, গাজীপুরের দক্ষিণ সালনার ফরিদুল ইসলাম, মনির হোসেন, মঞ্জুরা খাতুন, কুমিল্লা নাঙ্গলকোটের রাবিয়া খাতুন, কুমিল্লার ডুমুরিয়া চানপুরের সাফিয়া খাতুন, মুরাদনগরের দুলভী বেগম ও অহেদের নেছা, আখাউড়ার বনগজের ফরিদা বেগম, খাগড়াছড়ির মাটিরাঙার মাফিয়া খাতুন ও পানছড়ির হাবিবুর রহমান। আমমোক্তারনামায় বলা হয়, এই ব্যক্তিরা ওয়ারিশ সূত্রে বনগজ, তন্তর, ধরখার ও ভাটামাথা এলাকার ৬৯ একর ৩৭ শতক নাল, ভিটি, পুকুর, ডোবা ও পাড়ের মালিক এবং ওই জায়গা তাঁদের দখলে আছে। সাংসারিক ও পারিবারিক ব্যস্ততার কারণে দূরবর্তী স্থানে থাকায় উলি্লখিত ভূমি হস্তান্তর ও রক্ষণাবেক্ষণসহ যাবতীয় দায়দায়িত্ব পালনের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার বর্ণি গ্রামের মৃত আবুল বাসারের ছেলে মো. সেলিম ও চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার আজিমপুর শেখপাড়ার সামছুল আলমকে আমমোক্তারনামা নিযুক্ত করেছেন।
তবে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, এসব ভূমিতে কোনো দাতা কিংবা তাদের কোনো ওয়ারিশদার নেই। বনগজ গ্রামের শতাধিক পরিবারই কেনা সূত্রে ওইসব জমিতে বসবাস করছে। রওশন আলী, সালাম মিয়া, মোস্তফা, হামিদুল হক, হারিজ মিয়া, ইউনুস মিয়া, ফজলুল হক, আবদু মিয়া, জসিম উদ্দিন, জাকির মিয়া, রফিক মিয়াসহ আরো অনেকেই জানান, ইতিমধ্যে বিভিন্ন জরিপে তাঁদের নামে এসব জায়গা রেকর্ড হয়েছে। এমনটি তাঁরা নিয়মিত খাজনা পরিশোধ করে আসছেন। এখন সংসদ সদস্যের ভাই প্রভাব দেখিয়ে জায়গাটি দখল করে নিতে চাইছেন।
গ্রামের শাহেদ মিয়া, আবদুল ওহাব, শরাফত আলী বেপারী বলেন, 'বছরের পর বছর ধরে তাঁরা এখানে বসবাস করছেন। মানিক মিয়া ও তাঁর ওয়ারিশদাররাই জায়গা বিক্রি করে দিয়ে গেছেন।' শাহেদ মিয়া বলেন, 'সিএস পর্চায় বর্তমান দখলদারদের নামও আছে। সবাই খাজনা দিচ্ছে। এরপর কিভাবে আমমোক্তারনামা দলিল হলো আমরা তা বুঝতে পারছি না।'
মুক্তিযোদ্ধা অহিদ মিয়া, মাজিদুল ইসলাম. হামিদুল হক বলেন, তাঁরা বিষয়টি নিয়ে এমপি শাহ আলমের কাছে গেলেও কোনো সুরাহা দেননি। এমপি শাহ আলম তাঁদের বলেন, 'আমার ভাই না হয়ে অন্য কেউ হলে তার বেলায় যা করতেন তাই করেন।' একপর্যায়ে তিনি আইনি লড়াইয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
বিনিময় সূত্রে আসা আবদুল কাদির বলেন, 'চান মিয়া, আবদুল হামিদসহ তাঁদের ওয়ারিশদাররা অনেক আগেই এসব জায়গা বিক্রি করে চলে গেছেন। এখন অন্যদের মতো আমার বিশ কানি সম্পত্তিও সেলিম ও শামছুল ইসলামের নামে লিখে দিয়েছে ভুয়া ওয়ারিশানরা। সেলিম এমপির ভাই বলে প্রভাব দেখায়।'
এ ব্যাপারে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে মো. সেলিম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'দাতারা আমার কোনো আত্মীয় নয়। তবে তাঁরা খুবই নিরীহ মানুষ। মৃত চান মিয়া বিনিময় সূত্রে জায়গার মালিক। ভারত থেকে আসার পর চান মিয়ার এক ছেলে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। এরপর থেকে তাঁর পরিবারের লোকজন গ্রাম থেকে সরে যায়। এখন শুধু একজন ওয়ারিশান গ্রামে থাকে। চাঁন মিয়ার ছেলে মানিক মিয়া ও অন্য ওয়ারিশদাররা মনে করছেন, আমার কাছে দায়িত্ব দিলে জায়গাটি বুঝে পাবে কিংবা বিক্রির মাধ্যমে জায়গার মূল্য পাবে। আমাকে ভালো মানুষ ভেবেই তাঁরা হয়তো এ দায়িত্ব দিয়েছে। এখন যদি আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে জায়গা পাই তাহলে আমরা বুঝে নেব। এ বিষয়ে আমার ভাইয়ের (এমপি) কোনো সম্পৃক্ততা নেই।'
আরেক গ্রহিতা শামছুল আলম বলেন, 'দাতারা আমার আত্মীয়। তাঁরা আগে কোনো জায়গা বিক্রি করেননি। আমাদের কাছে বিনিময়ের সব কাগজপত্র আছে।' আমমোক্তারনামায় জায়গাটি দাতাদের দখলে আছে, এ কথা কেন উল্লেখ আছে- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'কোনো কিছু করতে গেলে বা মামলার নিয়ম অনুসারে এভাবেই লিখতে হয়'।
আখাউড়া ভূমি অফিসের সাবরেজিস্ট্রার আবদুর রশিদ মণ্ডল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ওই আমমোক্তারনামা দলিলের দাতারা একসঙ্গে এসে ছবি জমা দিয়ে রেজিস্ট্রি করেছেন। তাঁদের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছিল। তবে জায়গাটি দাতাদের দখলে আছে কি না সেটি আমার জানা নেই।' স্থানীয় ধরখার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. শাফিক বলেন, 'গ্রামবাসীর মাধ্যমে জেনেছি বনগজ, তন্তর, ভাটামাথার অনেক জায়গাই নাকি এমপির ভাই লিখে নিয়েছেন। এখন চিন্তা করছি এ নিয়ে এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয় কি না। আমি গ্রামবাসীকে বলেছি, সব কাগজপত্র দেখে আইনগত ব্যবস্থা নিতে।'
মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে মানিক মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, তিনি যখন ছোট তখনই তাঁর পরিবার বনগজ এলাকা ছেড়ে চলে যায়। তিনি বলেন, 'মায়ের কাছে শুনেছি আব্বাকে জমি বিক্রি করে দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছিল। তবে আব্বা ভয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে চলে আসেন। জমি উদ্ধারের জন্য এখন এমপির ভাইয়ের সাহায্য চেয়েছি।'
তবে সংসদ সদস্যের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও ওপ্রান্ত থেকে কেউ ফোন ধরেননি। এর মধ্যে কয়েকবার রিং হওয়ার পর কল কেটে দেওয়া হয়। কালের কণ্ঠের প্রতিবেদক পরিচয় দিয়ে মোবাইলে ফোনে ম্যাসেজ বার্তা পাঠিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত আরো কয়েকবার ফোন দেওয়া হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে আখাউড়া পৌরসভার মেয়র ও যুবলীগ নেতা তাকজিল খলিফা কাজল বলেন, 'গ্রামের লোকজন আমার কাছে এলে আমি এমপির সঙ্গে কথা বলতে পরামর্শ দিই। যত দূর জানি ভাইয়ের সঙ্গে এমপির সম্পর্ক ভালো নয়। জায়গার বিষয়ে এমপি ভাইকে প্রশয় দেবেন না। এতে ওনার কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলেও আমি দৃঢ়কণ্ঠে বলতে পারি।'

No comments

Powered by Blogger.