দলছুট এক মানুষের গল্প by এইচএম বাবু

ক্লাসের শেষ বেঞ্চে বসে যে দুষ্ট ছেলেটি/ মিছিলের শুরুতে থাকে যে দুরন্ত তরুণ/ অভিমান, অভিযোগ আর আর্তনাদ মুচকি হাসির আড়ালে লুকাতে পারে যে স্বপ্নবান মানুষটি, তিনি আমাদের সঞ্জীব চৌধুরী। ২৫ ডিসেম্বর ১৯৬২। সুবহে সাদেকে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তখন দেশ ছিল আন্দোলন, অধিকার আদায়ে উত্তাল। উঁচু-নিচু আর সবুজের কোলঘেঁষা হবিগঞ্জ শহর।
এর পেটে ছোট নদীতীরবর্তী গ্রাম বানিয়াচং। সেখানকার মাঠ-প্রান্তর, মাঠ পেরোনো সবুজ শৈশব, ডান হাতে ডাঙ্গুলি, দুষ্ট ছেলের দল। এর পর বড়দির হাত ধরে হবিগঞ্জের খাল-বিল, হাওর, নদী, রাতের তারা, হলুদ সরষে ক্ষেত, সবুজ মাঠ ডিঙিয়ে বিচ্ছু সর্দারদের আশ্রয় হয় পুরান ঢাকার উর্দু রোডে।
৯০-এর দশক। উত্তপ্ত রাজপথ। দেশজুড়ে চলছে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র সঞ্জীব। এ সময় বনে গেলেন গণমানুষের গায়ক। তাৎক্ষণিক গান লেখা ও রচনায় পটু। তাজ্জব কমরেডরা! এ ছেলেকেই তো খুঁজছি। গলায় গামছা পেঁচিয়ে হারমোনিয়াম নিয়ে নেমে গেলেন রাজপথে।
'৯১ সালে যোগ দিলেন দৈনিক আজকের কাগজে। উন্মোচন করলেন সৃষ্টিশীলতার নতুন অধ্যায়। কয়েক দশকের কাঠখোট্টা ভাষার অবসান। নতুন ফ্লেভার, নতুন স্বাদ। হাতে পত্রিকা নিয়েই_ 'সঞ্জীব চৌধুরী'! কে এ? দ্রুত নামডাক চতুর্দিকে। পাঠকদের সঙ্গে এত দ্রুত কম্যুনিকেট! '৯২-এ দৈনিক ভোরের কাগজে। এবার সরাসরি পাঠকদের প্লাটফর্ম তৈরির চেষ্টা। সে বছর 'মেলা' শিরোনামে একটি নিয়মিত সাপ্তাহিক বিনোদন পাতা চালু। সাড়াও ফেলে ব্যাপক। এর পর ২০০৫-এ যায়যায়দিনে ফিচার এডিটর হিসেবে নিযুক্ত করেন নিজেকে। রাজনীতি, কবিতা, গান, সাংবাদিকতা_ আর কী প্রয়োজন একজন মানুষের! নামডাকের সঙ্গে সঙ্গে ভক্ত জুটল অসংখ্য। হলেন আড্ডার মধ্যমণি। সঞ্জীব, সঞ্জীবদা...সঞ্জীপন কয়েক সম্বোধনে চেনে সবাই। শুধু তাই নয়। গল্প, নতুন স্বপ্ন বা সাপোর্ট_ সবকিছুতেই এ মানুষ বটবৃক্ষ।
১৯৯৬-এ বাপ্পা মজুমদার ও মিঠুকে নিয়ে গড়ে তোলেন ব্যান্ডদল। নাম দলছুট। নিজের কবিতা, চিন্তা আর ভাবনার ভেলা দলছুট। '৯৮-এ প্রথম অ্যালবাম 'আহ'!। ব্যান্ড জগতের দুঃসময়ে কে ধরল হাল? অনেক শ্রোতার এ প্রশ্ন। সাড়া ফেললেন চতুর্দিকে। ধীরে ধীরে হৃদয়পুর, আকাশচুরি, জোছনাবিহারের মতো অ্যালবামের সৃষ্টি। এ ছাড়াও একক স্বপ্নবাজি। ব্যান্ডজগতে নতুন মাত্রার সংযোজন_ মাটি মানুষ, সঙ্গে বাউলিয়ানা-সুফিয়ানা ভাষার চল। নিঃসঙ্গতার প্রতিচ্ছবি তার 'গাছ' শিরোনাম গানে। 'তোমাকে বলে দেব/ নষ্ট শহর/ স্বাধীনতা/ ফিরে পেতে চাই/ আগুনের কথা বন্ধুকে বলি'র মতো কালজয়ী সৃষ্টি।
বেহিসেবি, বোহেমিয়ান জীবনে নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়_ অভিনয়। এ ঢেঁকিও গিললেন। অভিনয় করলেন জুরিন্দায়। তারপর পরিচালকের আবদার ধারাবাহিক নাটকে। নাটক 'সুখের লাগিয়া'য় অভিনয় করতেই হবে। এখানেও প্রাজ্ঞের ভূমিকায়।
এ হলো একজন কবি, ছড়াকার, গীতিকার, সুরকার, গায়ক, অভিনেতার গল্প। কী নামে পরিচিত তিনি! ধাঁধার জট খুলতে ভেসে ওঠে একটি লাল কেশরের ঘোড়া। জটা ধরা চুল, লম্বা গোঁফওয়ালা, কোটরে ডোবা দুটি চোখ, লম্বা করোটি বাঁকা চোয়াল, ৬ ফুট উচ্চতা, হালকা তামাটে গড়ন, অগোছালো; সর্বদা টি-শার্ট, জিন্স আর কেড্স-কাম শু পরা এক পরিপূর্ণ মানুষ। শিশুর কাছে ছড়াকার। বৃদ্ধের কাছে সাংবাদিক। আসলে একজন লক্ষ্যহীন মানুষের বিস্তৃতি কতখানি_ তার প্রমাণ সঞ্জীব চৌধুরী।
২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর রাত ১২টা। সব স্তব্ধ! নীরব মাতম হাসপাতালের করিডোরে। বাতাস ভারী। এ্যাপোলো হাসপাতালের ৩০৪৯ আইসিইউ কেবিনে সঞ্জীব। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ তার। লাখো ভক্তের প্রার্থনা। মুখে হাত চেপে কান্না থামানোর চেষ্টা। কিন্তু কিছুতেই কিছুু নয়। বাঁচানো গেল না। চলে গেলেন সঞ্জীব। আজ তার পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী।
মাত্র ৪৫ বছর। স্ত্রী নাসরীন শিল্পী আর ৫ বছরের কিংবদন্তিকে নিয়ে ছিল সংসার। এত অল্প সময়ের মধ্যে জগৎ মঞ্চ, রাজপথ, গান-গিটার আর আড্ডা ছেড়ে চলে গেলেন ক্ষণজন্মা মানুষটি। হলেন দলছুট। গিটার বা গানে আর কাঁপাবেন না কারও হৃদয়। হাঁটবেন না ল্যাম্পপোস্ট বা নিয়ন আলোয় নিশুতি রাতে, ঢাকার রাস্তায়-রাস্তায়।
sapnosena@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.