রিকশা পুড়ে শেষ ওরা নিঃস্ব অভুক্ত by রেজোয়ান বিশ্বাস

হাজারীবাগ বেড়িবাঁধ লাগোয়া শাজাহান মিয়ার রিকশা গ্যারেজ। এ গ্যারেজ পেরিয়েই বৌবাজার বস্তি। রবিবারের ভয়াবহ আগুনের সূত্রপাত এ গ্যারেজ থেকে বলেই স্থানীয়রা মনে করছে। গ্যারেজের মালিক শাজাহানও তা স্বীকার করে কালের কণ্ঠকে জানান, আগুনে তাঁর গ্যারেজে থাকা ছয়টি অটোরিকশা এবং দেড় শতাধিক রিকশাভ্যান ও রিকশা পুড়ে গেছে। এর মধ্যে কেরোসিন কনটেইনার বোঝাই দুটি রিকশাভ্যান ছিল।
ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিতে গিয়ে দেখা যায়, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে সারি সারি রিকশা ও রিকশাভ্যান। সেগুলো এখন আর চেনা যায় না। সব কিছু পুড়ে লোহার কঙ্কালে পরিণত হয়েছে। তারই পাশে দাঁড়িয়ে চোখের পানি মুছছিলেন বাসু মিয়া (৩৫)। তিন বছর ধরে টাকা জমিয়ে রিকশা কিনেছিলেন তিনি। বৌবাজার বস্তিতে দুই ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে থাকতেন তিনি। ভালোভাবেই সংসার চলছিল। কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখা তাঁর স্বপ্নকে ছাই করে দিয়েছে। স্ত্রী-সন্তানসহ প্রাণে বাঁচলেও পুড়ে গেছে সেই রিকশা। অনেকটা সন্তানতুল্য সেই রিকশার কঙ্কাল চেহারা দেখে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন বাসু।
স্থানীয়রা জানায়, বৌবাজার বস্তির বেশির ভাগ বাসিন্দা ছিলেন রিকশাচালক। পাশেই গ্যারেজ থাকায় এখানে বসবাস করতে তাঁদের সুবিধা হতো। এখন সেই গ্যারেজে কিছু টিন আর লোহা রয়েছে। রাতে রাখা রিকশাগুলো সবই পুড়ে শেষ। রিকশাচালক আসলাম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, 'ঘর পুড়ে গেছে। বাসন-কোসন, জামাকাপড় কিছুই আর নেই। পেট চালানোর জন্য যে রিকশা ছিল, তাও পুড়ে শেষ। এখন কী করব?'
হাজারীবাগের পুরনো বাসিন্দা ইসমাইল হাওলাদার জানান, ২০ বছর ধরে একে একে ঘর উঠে বস্তি হয়েছে। এখানে মূলত গ্যারেজের রিকশাওয়ালাদের পরিবার বেশি থাকে। এখন এ দিনমজুররাই পড়বে সমস্যায়। অভুক্ত থাকতে হবে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে।
'আমার কী সর্বনাশ হলো রে। আমার পোলারে আইনা দাও তোমরা। সর্বনাশা আগুন আমার সব শেষ কইরা দিছে'_এভাবে ধ্বংসস্তূপের পাশে দাঁড়িয়ে আহাজারি করছিলেন সবজি বিক্রেতা মামুন সিকদার। যমজ দুই ছেলের মধ্যে রাকিব ও স্ত্রীকে নিয়ে পাশেই একটি বস্তিতে থাকেন তিনি। এক ছেলে শাকিব থাকত নানা-নানির সঙ্গে শামসু প্রফেসরের বস্তিতে। রাতে চিৎকার-চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে শামসু প্রফেসরের বস্তিতে আগুন দেখতে পান তাঁরা। মায়ের কাছে থাকা আরেক ছেলে শাকিবকে উদ্ধারের জন্য স্বামীকে নিয়ে এগোনোর চেষ্টা করলেও তাঁরা ব্যর্থ হন। গভীর রাতে আগুনের সময় তাঁর সাড়ে তিন বছর বয়সী ছেলে শাকিব, শাশুড়ি হেলেনা বেগম (৪০) ও শ্যালিকা আকলিমা আক্তার (১১) আগুনে পুড়ে মারা গেছে।
গাইবান্ধা সদরের বাসিন্দা শমসের আলী। এক বছর আগে ঢাকায় এসে রিকশা চালানো শুরু করে হাজারীবাগের বস্তিতে পরিবার নিয়ে বাস করা শুরু করেন। শনিবার রাতে লোকজনের চিৎকার শুনে ঘুম থেকে উঠে আগুনের লেলিহান শিখা দেখতে পান। মুহূর্তে ঘর থেকে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে বেরিয়ে আসেন। গতকাল দুপুরে পোড়া বাঁশের খুঁটি ও ছেঁড়া কাঁথার মধ্যে মানবেতর অবস্থায় তাঁকে দেখা যায়। জমানো টাকা-পয়সা, কাপড়-চোপড় সবই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
শমসেরের মতো বৌবাজারের পুড়ে যাওয়া বস্তিতে প্রায় এক হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু এখন খোলা আকাশের নিচে বাস করছে। তাদের চোখের সামনে এখন শুধু হাহাকার। নিলু আক্তার, সাবিহা, রমজান, আতাউর, আলমগীরসহ অন্যরা বলেন, 'আগুনে আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে। আমাদের আর কিছুই নেই। আমরা এখন নিঃস্ব। টাকা-পয়সা, জামা-কাপড়সহ সব কিছুই শেষ হয়ে গেছে। আমরা এখন কী নিয়ে বাঁচব?'
রাতের আগুনের পর গতকাল বিকেল পর্যন্ত শুধু ত্রাণের খিচুড়ি খেয়ে আছে বৌবাজার বস্তিবাসী। শাহজাহান নামে একজন বলেন, তাঁর আর কিছুই নেই। ঘরে থাকা টাকাসহ সব পুড়ে গেছে। এ সময় চোখে পড়ে, বস্তি পরিদর্শনে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যাঁরাই আসছেন, বস্তির লোকজন ছুটে যাচ্ছে তাঁদের কাছে। একদিকে স্বজনহারাদের হাহাকার, অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্তদের ছোটাছুটি, সব মিলিয়ে বৌবাজার বস্তিতে এখন মানবেতর পরিবেশ।
গতকাল বিকেলে দেখা যায়, বস্তিতে যেখানে যার ঘর ছিল, সেখানেই বাঁশের খুঁটি গেড়ে ও চাদর ঝুলিয়ে অবস্থান নিচ্ছেন। মাথা গোঁজার বিকল্প ঠাঁই না পেলে সেখানেই রাত কাটাবেন তাঁরা।

No comments

Powered by Blogger.