স্মরণ- স্মৃতির পটে মিরাজ by কামরুন নেসা হাসান

ছোটবেলা থেকেই শান্ত স্বভাবের। চুপচাপ। হয়তো শবে মেরাজের রাতে জন্ম হয়েছিল বলে মা-বাবা ভালোবেসে নাম রেখেছিলেন আলী মিরাজ খান। সিরাজগঞ্জ জেলার আমলাপাড়া নিবাসী বাবা অ্যাডভোকেট আলী মাহমুদ খান ও মা নূরজাহান বেগমের আট সন্তানের পঞ্চম মিরাজ। শান্ত স্বভাবের বলে পড়াশোনায় অসম্ভব মনোযোগী।
মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকে মেধা তালিকায় প্রথম সারির দিকেই স্থান করে নিয়েছিল। এরপর ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে কলকাতা নীলরতন মেডিকেল কলেজে পড়াশোনার সুযোগ। ডাক্তারি পড়া শেষ করে দেশে ফিরে প্রথমে সেনাবাহিনী মেডিকেল কোরে, পরে ঢাকা শিশু হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে কিছুদিন কাজ করে আলী মিরাজ খান। ১৯৮২ সালে নতুন কর্মস্থল আন্তর্জাতিক কলেরা হাসপাতাল। এ হাসপাতালেই দীর্ঘ ২৬ বছর কর্মরত। নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা ছাড়াও চিকিৎসাবিজ্ঞানে গবেষণার বিষয়েই তার মনোযোগ বেশি ছিল। তাই সারাক্ষণ নতুন তথ্য-বিষয়ে পড়াশোনার মধ্যে মগ্ন থাকত। তরুণ বয়সে অনেকে আড্ডা, খোশগল্প, সিগারেটের নেশায় বা অন্য নেশার টানে বুঁদ হয়ে থাকে। কিন্তু মিরাজ সবকিছু থেকে আলাদা। হাসপাতালের রোগীদের সেবায় নিজেকে একাত্ম করে রাখত সব সময়। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত মরণাপন্ন জীবনের কাতারে দাঁড়িয়ে অবিশ্রান্ত সেবাদানই ছিল মিরাজের জীবনের একমাত্র ধ্যান-ধারণা। আজকাল ডায়রিয়া হলে রোগীদের ওরস্যালাইনের পাশাপাশি রাইস স্যালাইন বা বেবি জিংক দেওয়া হয়। এসব কলেরা হাসপাতালের মিরাজসহ অন্য অনেক চিকিৎসকের গবেষণার ফল। মিরাজের গবেষণার আরেকটি বড় সাফল্য হলো, শিশুর ডায়রিয়া হলে ইনজেকশন জেন্টামাইসিন দিনে তিনবার দিতে হতো, এখন তা দিনে শুধু একবার দিলেও একই উপকার পাওয়া যাবে। এতে করে শিশুদের সুঁই পুশ করতে তিনবার কষ্ট পেতে হবে না—আবার একটা ইনজেকশন কেনায় মা-বাবার আর্থিক সাশ্রয়ও হলো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও অনুন্নত দেশে এ গবেষণাকে দারুণভাবে সাধুবাদ জানানো হয়েছে। সেই সঙ্গে মিরাজকে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের উত্তরোত্তর বিকাশ ঘটিয়ে সাধারণ মানুষকে সেবাদান করার ব্রতই ছিল মিরাজের ভাবনা।
আলী মিরাজ খানের লেখা অনেক গবেষণাসমৃদ্ধ প্রবন্ধ দেশ-বিদেশের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, বর্তমানে ইন্টারনেটেও তার লেখা পাওয়া যাবে। এর সবই সুধীমহলে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় প্রশংসিত হয়েছে।
আলী মিরাজ খান একজন চিকিৎসক, চিকিৎসাবিজ্ঞানে গবেষণারত সারাক্ষণ, কিন্তু নিজের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে খুব উদাসীন ছিল। ২০০১ সালে হূদেরাগে আক্রান্ত হয়ে দিল্লির এসকোর্ট হাসপাতালে তারই এককালের কলকাতার শিক্ষক হার্টের অপারেশন করেন। ভালো হয়ে আবার নিজ পেশায় গভীর মনোযোগ দেয় মিরাজ। মনোযোগ ছিল না নিজের স্বাস্থ্যের। ধীরে ধীরে ভেতরে ক্ষয় হতে থাকল। কোনো অভিযোগ করেনি কখনো, হয়তো মনের ভেতর অনেক অভিমান ছিল। কখনো কষ্টের কথা কারও সঙ্গে আলাপ করত না। নিরলসভাবে কাজ করত, একাকিত্বের মধ্যেই বেশি সময় কাটাত। ২০১১ সালের ১৯ নভেম্বর সন্ধ্যায় ফোনে খবর পেলাম, মিরাজ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে। পরিবারের সবাই ছুটে গেলাম। আইসিইউতে চিকিৎসক তাঁদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন। আমার পরিচিত হাসপাতালের একজন হার্ট বিশেষজ্ঞকে অনেক অনুরোধ করে চেম্বার থেকে ডেকে নিয়ে এলাম। আরেকবার শেষ চেষ্টা করার জন্য। মিনিট দশেক পর ফোন করলে জানালেন, ‘আপা কিছু করতে পারলাম না।’ অতি সহজে অনায়াসেই কথাগুলো বলেছিলেন সেই হূদেরাগ বিশেষজ্ঞ। কিন্তু আমরা মানতে পারিনি। নীরব-নিথর মিরাজের দেহ। কলেরা হাসপাতাল থেকে সবাই ছুটে এলেন। সবাই হতবাক। বিদেশি বিশেষজ্ঞ বললেন, ‘অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেল আমাদের।’ কাউকে কিছু বলে যায়নি। একেবারে নীরবে সেই অজানা গন্তব্যে প্রস্থান, সেখান থেকে কেউ আর ফিরে আসে না। অকালেই ঝরে গেল প্রতিভাবান গবেষক ও চিকিৎসক আলী মিরাজ খান। কিন্তু রয়ে গেছে থরে থরে নথি। ওর আরও অনেক দেওয়ার ছিল। হয়তো ভবিষ্যতে আর কোনো প্রতিভাবান নিবেদিত মানবসন্তান এসে মিরাজের অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করবে।
নভেম্বর মাসের শেষের দিকে সোসাইটি ফর হেলথকেয়ার এপিডেসিওলজি অব আমেরিকা (এসএইচইএ) আলী মিরাজ খানকে তাদের একজন আন্তর্জাতিক দূত হিসেবে মনোনীত করার বিষয়ে ঘোষণা দেয়, যার ফলে স্বাস্থ্যসেবা মহামারি তত্ত্ব এবং সংক্রমণ প্রতিরোধবিষয়ক একটি প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে তার যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা ছিল। দুঃখজনকভাবে এ সম্মাননা সম্পর্কে জানার আগেই ১৯ নভেম্বর মিরাজ ইন্তেকাল করে।
মিরাজকে এসএইচইএর মনোনীত বিষয়টি তার পেশার দক্ষতার পরিচয় বহন করে এবং আমরা কী হারিয়েছি তা স্মরণ করিয়ে দেয়।
কামরুন নেসা হাসান
ডা. মিরাজের বড় ভাবি

No comments

Powered by Blogger.