গভীর রাতে হাজারীবাগ বৌবাজার বস্তিতে ভয়াবহ আগুন- প্রাণ হারাল ১১ নারী ও শিশু

দেয়ালঘেরা বস্তিটা হয়ে উঠেছিল একটা অগ্নিকুণ্ড। ফটকে আগুন, খাড়া লোহার সিঁড়িতেও হুড়োহুড়ি। প্রাণ বাঁচাতে একদল নারী আর শিশু আশ্রয় নিয়েছিল গোসলখানা ও রান্নাঘরে। সেখান থেকেই গতকাল রোববার উদ্ধার করা হয় ১১ জনের দগ্ধ লাশ। রাজধানীর হাজারীবাগে বৌবাজার বস্তিতে ভোররাতের আগুনে প্রাণ হারানো এই ১১ জন ছয়টি পরিবারের সদস্য।
ওই আগুনে পুড়ে গেছে অন্তত ৭০০ ঘর। আশ্রয় আর সর্বস্ব হারিয়ে এক কাপড়ে খোলা আকাশের নিচে রয়েছে নিম্ন আয়ের অন্তত তিন হাজার মানুষ।
নিহত ১১ জন হলো: সখিনা বেগম (৬০) ও তাঁর নাতনি মোছাম্মৎ ময়না (১৩), হেলেনা আক্তার (৪০), তাঁর মেয়ে মোছাম্মৎ আকলিমা (৯) ও নাতি সাকিব (৪), মুন্নি বেগম (২৫) ও তাঁর মেয়ে মীম (৩), সুরাইয়া বেগম (২২) ও তাঁর মেয়ে জুলি (৭), আনোয়ারা বেগম (৬০) ও আবদুল্লাহ (৬)।
ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণকক্ষ জানায়, শনিবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে বৌবাজার বস্তির একটি রিকশার গ্যারেজে আগুনের সূত্রপাত হয়। আগুন দ্রুত বস্তিতে ছড়িয়ে পড়ে। এতে পুড়ে যায় কয়েকটি পাকা ভবনও। আহত হয় ২০ জন। ফায়ার সার্ভিসের সাতটি স্টেশনের ১৭টি গাড়ি গতকাল রোববার সকাল সাতটার দিকে আগুন পুরোপুরি নেভাতে সক্ষম হয়। এর আগে ভোর পৌনে পাঁচটায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক আবু নাঈম মো. শাহিদউল্লাহ ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, রিকশার গ্যারেজে সিগারেট বা মশার কয়েল থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। সেখানে কেরোসিনের ভ্যান ছিল। এটি আগুনের তীব্রতা বাড়িয়েছে।
মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ সড়কের পাশেই বৌবাজার বস্তি। গতকাল সেখানে গিয়ে দেখা যায়, আগুনে বস্তির টং ও কাঁচা ঘরগুলো ভস্মীভূত হয়ে গেছে। ছাই ও টিনের স্তূপের মাঝে কয়েকটি পাকা ঘরের ইটের কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে সারি দিয়ে থাকা ২০টি দোকানও পুড়ে গেছে। দোকানগুলোর পেছনে রিকশার গ্যারেজে পড়ে আছে রিকশার বাঁকা হয়ে যাওয়া কাঠামোগুলো। স্থানীয় লোকজন ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানান, এই গ্যারেজ থেকেই আগুনের সূত্রপাত। গ্যারেজের কোণে সাইফুর ও উজ্জ্বলের মালিকানাধীন উঁচু দেয়ালঘেরা টিন-কাঠের দোতলা বস্তি। এই সীমানার ভেতর ছিল ৪৬টি ঘর। যার সবই পুড়ে গেছে। এই বাড়ি থেকেই উদ্ধার হয়েছে ১১ জনের দগ্ধ লাশ।
সাইফুর-উজ্জ্বলের বস্তিতে ঢোকার মুখেই রয়েছে ছোট একটি দোতলা স্থাপনা। দোতলার ওপরে একটি মাত্র ঘর। আর নিচে লোহার সদর দরজা, বারোয়ারি রান্নাঘর, গোসলখানা ও পায়খানা।
বস্তির বাসিন্দারা জানান, আগুন লাগার পর চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে তাঁরা বস্তি থেকে বের হতে গিয়ে দেখেন, সদর দরজাসংলগ্ন গ্যারেজে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। পুরুষেরা দেয়াল বেয়ে উঠলেও নারী ও শিশুরা আটকা পড়ে। পরে অনেক নারী সিঁড়ি বেয়ে সদর দরজার ওপর দোতলায় উঠে পাশের বস্তির টিনের চাল দিয়ে নামেন। হুড়োহুড়ির মধ্যে কয়েকজন গিয়ে আশ্রয় নেন পাকা গোসলখানা ও রান্নাঘরে। ওই গোসলখানা থেকে আটজনের আর রান্নাঘর থেকে তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
এই বাড়ির বাসিন্দা রীনা বেগম জানান, রাত আড়াইটার দিকে তাঁর পাশের ঘরের মুন্নীর ডাকাডাকিতে তাঁর ও তাঁর স্বামী রফিকের ঘুম ভাঙে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে না পেরে তিন বছরের মেয়ে মীমকে নিয়ে মুন্নী গোসলখানায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। সকালে গোসলখানায় তাদের লাশ পাওয়া যায়।
শিউলি বেগমের ছেলে আবদুল্লাহর লাশ মিলেছে রান্নাঘরে। তাকে বাঁচাতে গিয়ে আহত হয়েছেন তার বাবা রাজমিস্ত্রী সুমন। শিউলি ও তাঁর ছোট ছেলে সাড়ে তিন বছরের আরমানও আঘাত পেয়েছে। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শিউলি বলেন, ‘আগুন দেইখা ছোডডারে কোলে লইয়া দৌড় পারছি। আমার স্বামী কইল, দেহি ঘরের কিছু বাইর করতে পারিনি। এই সময়ই বড়ডা (আবদুল্লাহ) গিয়া ঢুকছে রান্নাঘরে। হ্যারে বাইর করতে গিয়া দেহি হেইখানেও আগুন, বাইরানের পথ নাই। তহন ছোডডারে কোলে লইয়া কোনো রকমে পাশের বস্তির চালে উডছি। বড় পোলারে বাইর করতে গিয়া পুইড়া গ্যাছে পোলার বাপেও।’
ওই বস্তির পাশে দুটি দেয়ালঘেরা টং দোতলা বস্তি, সামনের একটি কাঁচা বস্তিও আগুনে পুড়েছে। পুড়ে গেছে একটি তিনতলা ও একটি দোতলা বাড়ির কিছু অংশও। আগুনে পুড়েছে গলির ওপারে রং কোম্পানির বস্তি, হানিফ মিয়ার বস্তি ও রিকশার গ্যারেজ, রাজ্জাক মিয়ার দোতলা বাড়ির ছাদের ২০টি কাঁচাঘর ও ভেতরের কয়েকটি ঘর, পাশের ‘ইতালি বাড়ি’র দোতলার ছাদের কাঁচা ঘর ও ভেতরের কয়েকটি ঘর এবং নূর হোসেনের বিশাল একতলা পাকা বাড়ির ছাদের কাঁচাঘরগুলো।
স্থানীয় লোকজন জানান, মাসে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা ভাড়ার এসব ঘরে থাকতেন রিকশাচালক, গাড়িচালক, ট্যানারির শ্রমিক, পোশাকশ্রমিক, গৃহকর্মী, দিনমজুর ইত্যাদি পেশার লোকজন। ঘরে একটি বড় চৌকি কোনোমতে ঢুকত।
গৃহকর্মী জোসনা জানান, দুই বাচ্চা নিয়ে এক কাপড়েই বের হয়ে এসেছেন তিনি ও তাঁর স্বামী। এখন বাচ্চাদের শীত কীভাবে কাটবে, তাই নিয়ে তিনি চিন্তিত। তিনি যেসব বাসায় কাজ করেন, সেসব বাসার লোকেরা কিছু সাহায্য করতে চেয়েছেন।
পুড়ে যাওয়া ঘর থেকে লোহার বাঁকা হয়ে যাওয়া আলনা আর টেবিল ফ্যানের খাঁচাটাই কেবল উদ্ধার করতে পেরেছেন কোহিনূর। খাট, তোশক, নিজের ও বাচ্চাদের কাপড় এবং বেতনের সাড়ে ছয় হাজার টাকা—সবই পুড়ে ছাই।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর, প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী এইচ এম মাহমুদ আলী, রেল প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হকসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারপ্রতি ২০ হাজার টাকা করে ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে তিন হাজার টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য নগদ এক কোটি টাকা ও ১০০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছে। সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাও।
ভোরে হাজারীবাগ থানার পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধার করা লাশগুলো নিয়ে যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে। সেখানে স্বজনেরা পুড়ে যাওয়া লাশগুলো শনাক্ত করেন। লাশ শনাক্তের পর তাঁরা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার শোক: হাজারীবাগে বস্তিতে আগুনে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতিতে শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া। পৃথক বার্তায় তাঁরা এই শোক প্রকাশ করেন।
বাসস জানায়, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ জানান, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘটনাস্থলে দুর্গতদের মাঝে খাবার, কাপড় ও প্রয়োজনীয় ওষুধ বিতরণসহ ত্রাণ তৎপরতা শুরু হয়েছে।
শোকবার্তায় খালেদা জিয়া আহতদের সুচিকিৎসা ও ক্ষতিগ্রস্তদের বাসস্থান নির্মাণ ও ত্রাণসামগ্রী বিতরণের জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান।
এ ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র।

No comments

Powered by Blogger.