বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৫৭৩ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শহীদ আবদুর রব চৌধুরী, বীর বিক্রম পাঁচটি গুলি লাগে তাঁর শরীরে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে তুমুল যুদ্ধের পর ২১ নভেম্বর বিলোনিয়ার বেশির ভাগ এলাকা মুক্ত হয়। ফেনী জেলার অন্তর্গত একটি এলাকার নাম বিলোনিয়া।
আবদুর রব চৌধুরীসহ মুক্তিযোদ্ধারা অগ্রসর হন ফেনী অভিমুখে। তাঁরা প্রথমে বিলোনিয়ার মুখ বরাবর বান্দুয়া-পাঠাননগরে অবস্থান নিয়ে ওই এলাকা ব্লক করেন। তাঁদের সঙ্গে ছিল মিত্রবাহিনীর জাঠ ও মারাঠা রেজিমেন্টের সেনারা।
পাঠাননগর-বান্দুয়া ছিল সীমান্ত এলাকা। মিত্রবাহিনীর পরিকল্পনা ছিল সীমান্তে ট্যাংকসহ অন্যান্য ভারী সামরিক যানবাহনের সরব চলাচল ও সেনা সমাবেশের মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বিস্মিত করা, যাতে তারা হকচকিত হয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে মিত্রবাহিনীর জাঠ রেজিমেন্টের সেনারা পশ্চিম সীমান্ত ও মারাঠা রেজিমেন্টের সেনারা পূর্ব সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে।
কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনী মিত্রবাহিনীর অবস্থান বুঝে ফেলে। তারা দ্রুতগতিতে ফেনীর উত্তরে বিলোনিয়ার মুখ বরাবর দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা লাইন তৈরি করে। এ ছাড়া ছাগলনাইয়া-ফেনীর মাঝামাঝি ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত আরেক প্রতিরক্ষা। বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান।
পাকিস্তানি সেনারা ওই এলাকায় মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। দুই পক্ষে গুলিবিনিময় এবং থেমে থেমে কয়েক দিন যুদ্ধ চলে। কখনো পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধা বা মিত্র বাহিনীর অবস্থানে ঝটিকা আক্রমণ চালায় আবার কখনো মুক্তিযোদ্ধা বা মিত্র বাহিনীর সেনারা। এরই ধারাবাহিকতায় ৪ ও ৫ ডিসেম্বর ওই এলাকায় তুমুল পাল্টাপাল্টি যুদ্ধ হয়।
আবদুর রব চৌধুরী ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি উপদলের দলনেতা। ৫ ডিসেম্বর তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক অবস্থানে আক্রমণ চালান। তখন সেখানে দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। কয়েক ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ চলে। যুদ্ধ চলাবস্থায় হঠাৎ তিনি গুলিবিদ্ধ হন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ছোড়া একঝাঁক (ব্রাশফায়ার) গুলির পাঁচটি গুলি লাগে তাঁর শরীরের বিভিন্ন স্থানে।
আহত হয়েও আবদুর রব চৌধুরী দমে যাননি। প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে থেকেই নেতৃত্ব দিতে থাকেন। সহযোদ্ধারা অনুরোধ করা সত্ত্বেও যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে যাননি। কিন্তু একসময় অধিক রক্তক্ষরণে তিনি নেতিয়ে পড়েন। সহযোদ্ধারা তাঁকে দ্রুত পাঠিয়ে দেন চিকিৎসকের কাছে। কিন্তু পথেই নিভে যায় তাঁর জীবনপ্রদীপ।
আবদুর রব চৌধুরীকে সমাহিত করা হয় তাঁর গ্রামের বাড়িতে। তাঁর অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী কয়েকজন সহযোদ্ধা মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে নেওয়ার পর তাঁরা যথাযোগ্য মর্যাদায় মরদেহ সমাহিত করেন। তাঁর সমাধি চিহ্নিত ও সংরক্ষিত।
আবদুর রব চৌধুরী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইএমই কোরে চাকরি করতেন। তাঁর ইউনিটের অবস্থান ছিল সৈয়দপুর সেনানিবাসে। তাঁর পদবি ছিল নায়েক। মার্চ মাসে ছুটিতে বাড়িতে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে গিয়ে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যোগ দেন। পরে ২ নম্বর সেক্টরের রাজনগর সাবসেক্টর এলাকায় যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে, বিশেষত পাঠাননগর-বান্দুয়ার যুদ্ধে অসাধারণ সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য শহীদ আবদুর রব চৌধুরীকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৬৩।
শহীদ আবদুর রব চৌধুরীর পৈতৃক বাড়ি নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার (ডাক সোনাচাকা বাজার) নোয়াখোলা গ্রামে। বিবাহিত ছিলেন। তাঁর বাবার নাম আকরাম উদ্দিন চৌধুরী, মা আকরামজান বানু। স্ত্রী হোসনে আরা বেগম। তাঁর তিন মেয়ে, তিন ছেলে।
শহীদ আবদুর রব চৌধুরীর স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা বর্তমানে ঢাকায় বসবাস করেন। ছেলে মাহবুবুর রহমান চৌধুরী জানালেন তাঁর মা (আবদুর রব চৌধুরীর স্ত্রী) মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পান। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পান। কিন্তু তাঁর বাবার বসতভিটার বেশির ভাগ জায়গা (কবর ও যে অংশে বাড়ি রয়েছে সে অংশ ছাড়া) স্থানীয় প্রভাবশালী কয়েকজন দখল করে নিয়েছে। তিনি ও তাঁর ভাইবোনেরা স্থানীয় প্রশাসনের কাছে কয়েকবার বিষয়টি জানান। কিন্তু তাঁরা কোনো প্রতিকার পাননি। জবরদখলকারীরা দখল করা জায়গায় স্থাপনা নির্মাণ করেছে।
সূত্র: মাহবুবুর রহমান চৌধুরী, মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
ৎashedtৎ@pৎothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.