ইটভাটার কাজে যাচ্ছে শিশুশিক্ষার্থীরা by এ বি সফিউল আলম

মিনা ও রিনা দুই বোন। মিনা লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার বড়খাতা আদর্শগ্রাম উৎসাহ রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ ও রিনা পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। তাদের বাবা আনোয়ারুল হক বড় মেয়ে মুন্নির বিয়ে দেওয়ার জন্য ইটভাটায় কাজ করার শর্তে ২০ হাজার টাকা ভাটার মালিকের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন।
আনোয়ারুল হক ওই টাকার দায় শোধ করতে টানা ছয় মাস কাজ করবেন নরসিংদীর ইটভাটায়। সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন স্ত্রীসহ শিশুসন্তানদের। বাসে ওঠার সময় স্বজনেরা বিদায় জানাতে এসে চোখের জল মুছছেন, মাথায় হাত দিয়ে শিশুদের শুভকামনা করে আবার তারা ফিরে আসবে—এ আশীর্বাদ করেছেন। এভাবে প্রায় প্রতিদিনই প্রিয়জনদের কাঁদিয়ে দারিদ্র্য জয়ের স্বপ্ন নিয়ে ইটভাটায় কাজ করতে যাচ্ছে হাতীবান্ধার অনেক পরিবার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে ইটভাটার মালিকেরা শ্রমিক সর্দারের মাধ্যমে অগ্রিম টাকা দেন শ্রমিকদের। সেই টাকা নিয়ে হাতীবান্ধার অনেক হতদরিদ্র পরিবার জীবনের স্বপ্নসাধ পূরণে দায়-দেনা পরিশোধ ও সংসারের অভাব-অনটন মেটানোর চেষ্টা করেন। এখন টাকার দায় শোধ করতে যেতে হচ্ছে ভাটায়। তাই উপজেলার বড়খাতা বাজার এলাকা থেকে প্রতিদিন শ্রমিকদের জন্য ভাড়া করা বাস ছেড়ে যাচ্ছে নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। সঙ্গে আছে সংসারের টুকিটাকি জিনিসপত্র ও সন্তানেরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার অদূরে বড়খাতা রেলগেট থেকে প্রতিদিনই শ্রমিকদের নিয়ে গন্তব্যে ছুটছে বাস। ২১ অক্টোবর নরসিংদী উদ্দেশ্যে বাস ছাড়া আগে কথা হয় হাতীবান্ধার পশ্চিম সারডুবি গ্রামের শ্রমিক আলতাব হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, তাঁর সঙ্গে যাচ্ছেন স্ত্রী আছমা বেগম, মেয়ে বেবী, ময়না ও বুলবুলি। এদের মধ্যে বেবী ষষ্ঠ শ্রেণী, ময়না তৃতীয় ও বুলবুলি প্রথম শ্রেণীর ছাত্রী। ইট বানাতে পরিবারের সাহায্য নিলে আয় বেশি হয়। মেয়েদের পড়াশোনায় সমস্যা হবে কি না, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ছয় মাস পর বাড়িতে ফিরে বাচ্চাদের আবার স্কুলে পাঠাব।’ একই ধরনের কথা বলেন দোলাপাড়া গ্রামের শ্রমিক রবিউল (৩৫), বুদা (৪০), মিন্টুসহ (৩৮) কয়েকজন।
শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চর গড্ডিমারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, সরডুবী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গড্ডিমারী সরকারি বিদ্যালয়, পণ্ডিতপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পিত্তিফাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও নিজ গড্ডিমারী রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার কমে গেছে।
উপজেলার দোলাপাড়া গ্রামে অন্তত ১০ জন সর্দার আছেন, যাঁরা বিভিন্ন ইটভাটায় শ্রমিক সংগ্রহ করে দেন। তাঁদের মধ্যে বাবলু, সফিয়ার, দুলাল, সইদার, সামাদ, খালেক, সিদ্দিক ও সুমন সর্দারের অধীন চলতি মৌসুমে নরসিংদী যাচ্ছে প্রায় আট হাজার শ্রমিক। সুমন সর্দার বলেন, এলাকার শ্রমিকেরা ইটভাটায় কাজ করে বেশ আয়-রোজগার করছে।
বড়খাতা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু হেনা মোস্তাফাজ্জামান বলেন, ‘আমি ওই শ্রমিকদের শিশুদের নিয়ে যেতে বাধা দিয়েছিলাম কিন্তু তারা আমার কথা শোনেনি।’

No comments

Powered by Blogger.