বিধ্বস্ত 'হলুদ ফুলের দেশে' by অদিতি ফাল্গুনী

"আপনারা বাঙালিরা এই এলাকাকে বলেন রামু। কিন্তু আমাদের রাখাইন ভাষায় আমরা এই এলাকাকে বলি 'প্যান-ওয়া', যার অর্থ 'হলুদ ফুলের দেশ'। আজ দেখেন, এই হলুদ ফুলের দেশের কী পোড়া আর বিধ্বস্ত চেহারা!"


বললেন রাখাইন ভান্তে ছেকা ছারা। রামুর শ্রীফুল বৌদ্ধবিহারের দোতলা কাঠের ঘরের মেঝেতে অর্ধভগ্ন ও অর্ধদগ্ধ বুদ্ধ মূর্তিগুলোর সামনে বসে বলেন বৃদ্ধ ভান্তে। ভান্তে ছেকা ছারা রামুর তিনটি বৌদ্ধ মন্দির দেখাশোনা করে থাকেন। এই তিনটি বৌদ্ধ মন্দিরের নাম হলো যথাক্রমে সাদা চিং (রাখাইন ভাষায় চিং অর্থ হীরক বা হীরা), লাল চিং এবং শ্রীফুল পুরাতন বৌদ্ধবিহার। তিনটি মন্দিরের ভেতর শ্রীফুল বৌদ্ধবিহারই সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত মনে হলো। যেহেতু ২৯ সেপ্টেম্বরের ভয়াবহ রাতে শ্রীফুল বৌদ্ধবিহারের পার্শ্ববর্তী মুসলিম বাড়ি এবং দোকানগুলোর মালিকরা নিজ আবাসস্থল ও ব্যবসাস্থান রক্ষার স্বার্থেই সাম্প্র্রদায়িক আক্রমণকারীদের রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু শ্রীফুল বিহারের পার্শ্ববর্তী দুই মন্দির সাদা চিং ও লাল চিং বৌদ্ধবিহারের অবস্থা সত্যিই ভয়াবহ।
এটি ছিল ১২ অক্টোবর, শুক্রবার দুপুর ২টা। কক্সবাজার থেকে আমাদের মাইক্রোবাস রামুর সাদা চিং মন্দিরের সামনে থামতেই পোড়া ছাই, কাচের টুকরো, বুদ্ধের ভাঙা মস্তক আর মন্দির প্রাঙ্গণে সমবেত হওয়া বৌদ্ধ উপাসকদের বিস্মিত, আতঙ্কিত এবং বিপন্ন মুখচ্ছবি নজরে এলো আমাদের। তাদের নিঃশব্দ দৃষ্টিই বলে দিচ্ছিল সহস্র কথা। 'নতুন করে কী আর বলব! সংবাদপত্র থেকে এতদিনে নিশ্চয়ই জেনে গেছেন সব; তাই না?' বললেন প্রদীপ বড়ূয়া এবং ছোটন বড়ূয়া। বিশের কোঠায় বয়স তাদের। "আসলে নতুন করে তেমন কিছুই বলার নেই। চৌমুহনী স্টেশন থেকে ২৯ তারিখ রাত ৮টা থেকে সাড়ে ৮টা নাগাদ দুইশ' জনের একটি মিছিল প্রথম বের হলো। মাত্র ২০ মিনিটের মাথায় তিন হাজার মানুষ তাদের সঙ্গে যোগ দিল। মিছিলের স্লোগান ছিল ভয়ঙ্কর_ 'উত্তম বড়ূয়ার গালে গালে/ জুতা মারো তালে তালে। বড়ূয়ার দুই গালে/জুতা মারো তালে তালে। বিহারগুলো পুড়িয়ে দাও/জ্বালিয়ে দাও, জ্বালিয়ে দাও।' মিছিল শুরু হওয়ার আধা ঘণ্টা আগেই স্থানীয় ইমাম মাইকে মুসলিমদের আক্রমণ শুরুর আগে আট ঘণ্টা সময় নিতে বললেন। আ-ট ঘণ্টা? আধা ঘণ্টার ভেতরেই শুরু হয়ে গেল উত্তেজিত জনতার আক্রমণ। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আগুন নেভাতে এসেও আক্রমণকারীদের বাধার মুখে পালিয়ে গেল। আমাদের কিছুই করার ছিল না। নিশ্চুপ দেখতে হলো আমাদের পবিত্র মন্দিরের আগুনে পুড়ে যাওয়া।" বললেন প্রদীপ এবং ছোটন।
সীমা বিহার মন্দিরের গায়ে লেখা 'জয়তু বুদ্ধ শাসনম, রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহার। স্থাপিত ১১১২ বাংলা, ১৭০৬ ইংরেজি, মংলোয়া, রামু, কক্সবাজার।' কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই একটি অদ্ভুুত দৃশ্য চোখে পড়ল। স্তূপাকৃতি কাচ, কাঠের টুকরো আর ছাইয়ের মাঝেই পুরুষ এবং নারী ভক্তরা বুদ্ধ প্রতিমা ও ভান্তেকে মধ্যাহ্নের প্রণাম জানাতে এসেছেন। সত্যিই কি উপাসনাস্থল ভাংচুর করলে বা পোড়ালেই ভক্তের ভালোবাসা আর বিশ্বাস নষ্ট হয়? বিশ্বাস কি অত অল্পতেই ধ্বংস হয়? কেউ কেউ বিগ্রহের ছবি তুলছিলেন। আবার কেউ কেউ ভিডিও করছিলেন। দোতলা কাঠের মন্দিরের এক পাশে পালি ও বর্মী ভাষায় লেখা বৌদ্ধ ধর্মীয় গ্রন্থে পরিপূর্ণ আলমারির কাচের পাল্লা শাবল দিয়ে ভেঙে গুঁড়ো করা হয়েছে।
'লুটতরাজকারীরা পালি ও বর্মী ভাষায় লিখিত প্রচুর বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ পুড়িয়ে দিয়েছে'_ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন বিহারের ভান্তে পাইঞ্যা দীপ মহাথেরো এবং উ ওয়াই নেই শ্রমণ নামে এক কিশোর ভিক্ষু। রাখাইন বুড্ডিস্ট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের এক সদস্য আমার হাতে কয়েকটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, 'এখানে মাত্র তিনটি মন্দিরে ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ আছে। সময় পেলে পড়ে দেখবেন।' এরপর যতই এগোতে থাকি ততই বাড়তে থাকে গোটা জনপদের মানুষের দীর্ঘশ্বাস আর হাহাকারের টুকরো টুকরো আর্তি।
'হ্যাঁ, ছয় ট্রাক মানুষ আমাদের পাড়ায় এসে মন্দিরে বিগ্রহের ওপর গানপাউডার ছিটিয়ে আগুন ধরালো। না, পুলিশ তো কোনো ট্রুপ সঙ্গে সঙ্গে পাঠায়নি। বরং পুলিশ বলেছে, মুসলিমদের তাদের কাজ শেষ করতে দাও। হ্যাঁ, এই সীমা বিহারই রামুর সবচেয়ে বড় মন্দির। আক্রমণকারীরা এখানে রাত সাড়ে ৯টায় এলো। আর রাত ১২টা পর্যন্ত তাণ্ডব চলল। আমরা বৌদ্ধরা তো সংখ্যায় কম। তাই কিছুই করতে পারলাম না।' বললেন এক চায়ের দোকানি উজ্জ্বল বড়ূয়া।
প্রজ্ঞামিত্র বনবিহারের সামনে বিষণ্ন মুখে বসে থাকা নির্মল বড়ূয়া জানান, 'দেখেন, প্রতিরোধ কী করব? হয়তো একটা পাল্টা দেওয়া যেত। কিন্তু আমরা সবার আগে আমাদের মা-বোনদের, আমাদের নারীদের নিরাপত্তার কথা ভেবেছি। যেন সশস্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠরা আমাদের নারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে না পড়ে! তাই নিঃশব্দে সবকিছু হজম করতে হয়েছে।' প্রজ্ঞামিত্র বনবিহারের ভিক্ষু জ্যোতিমিত্র বললেন, 'সরকার আমাদের ৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকা দিয়েছে ক্ষতিপূরণ হিসেবে। এই বিহার প্রাঙ্গণে দেখতে পাচ্ছেন মোট তিনটি মন্দির রয়েছে। প্রজ্ঞামিত্র বনবিহার ভিক্ষু সীমা ১৭৬৭ সালে স্থাপিত হয়েছিল। আড়াইশ' বছরের বেশি পুরনো এই মন্দিরে ২৯ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৯টায় হামলা শুরু হলেও সেনাবাহিনী সাহায্য করতে এগিয়ে আসে রাত সাড়ে ৩টায়। আক্রমণকারীরা এসেছিল দা, হাতুড়ি, লোহার রড এবং অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে। আমাদের এই বিহার তো শহরের এক প্রান্তে। কিন্তু রাত ৮টা কি সাড়ে ৮টা নাগাদ শহরের অন্য জায়গা থেকে অন্য বৌদ্ধরা আমাদের মোবাইল ফোনে জানায়, মূল শহরে মিছিল ও আক্রমণ শুরু হচ্ছে। আমরা তখনি নিরাপত্তার জন্য অন্যত্র পালিয়ে যাই।'
১১ অক্টোবর রামুর বিধ্বস্ত মন্দিরগুলো ঘুরে দেখার পর ১২ অক্টোবর সকালে আমাদের দল রওনা করে উখিয়া এবং টেকনাফ অভিমুখে। এখানেও পরিস্থিতি এতটুকু ভালো নয়।
'এই মন্দিরকে আমরা বলি দীপাঙ্কুর আশ্রম'_ বললেন উখিয়ার পশ্চিম মারিচ্যার বিজলী বড়ূয়া। 'আমরা ৩০ সেপ্টেম্বর হামলার শিকার হই। সকাল ৭টার দিকে এলাকার বাজার থেকে একটা মিছিল আসতে দেখি। সেই মিছিলে প্রচুর মুসলিম। আমাদের এই গ্রাম থেকে থানা ৮ কিলোমিটার দূরে। এই এলাকায় আজ অবধি কোনো বৌদ্ধ মন্দির পোড়ানো হয়নি। এমনকি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরাও আমাদের কোনো বিহার পোড়ায়নি। কিন্তু ৩০ সেপ্টেম্বর সকালে সেই অদ্ভুত ঘটনাই ঘটল। প্রায় ৭-৮শ' মানুষ এসে আমাদের আক্রমণ করল। বিহারে আগুন দেওয়ার পাশাপাশি আমাদের ঘরবাড়ি থেকে কাপড়চোপড়, বাসনপত্র, গরু-ছাগলও লুট করল। এ যেন এক দুঃস্বপ্ন।'
পশ্চিম মারিচ্যার বৌদ্ধরা আরও বললেন, স্থানীয় মুসলিমরা তাদের এই বলে আরও ভয় দেখাচ্ছে যে, সরকার থেকে তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য বিজিবির এই প্রহরা কতদিন থাকবে? নিরাপত্তা বাহিনী চলে গেলেই তারা বড়ূয়াদের টুকরো টুকরো করে কাটবে। এই অভিযোগ আগের দিন রামুর বিভিন্ন পাড়াতেও শোনা গেছে।
১৮৪৮ সালে স্থাপিত উখিয়ার মরিচ্যা পালং পশ্চিম রত্ন শাসনকীর্তি সুদর্শন বৌদ্ধবিহারটি রক্ষা পেলেও রক্ষা পায়নি অনতিদূরের রাজা পালং জাদি বৌদ্ধবিহার। ১৮৬৭ সালে স্থাপিত এই বিহারের মূল বিগ্রহ পদ্মাসনে শায়িত বুদ্ধ মূর্তিটি ৩০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ২-৩ হাজার মানুষ মাটিতে গুঁড়িয়ে দেয়।
উখিয়ার মরিচ্যা পালং এবং রাজা পালং এলাকা পরিদর্শন শেষে আমাদের দু'দিনের যাত্রার শেষ গন্তব্য টেকনাফের হ্লী-লা ইউনিয়নের হোয়াইকং গ্রাম। এটি একটি হিন্দু গ্রাম। ৩০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় এই গোটা হিন্দু গ্রামটিই লুটতরাজ, ভাংচুর ও অগি্নসংযোগের শিকার হয়। হোয়াইকং গ্রামের অষ্টম শ্রেণী পাস এবং রামুতে একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় মাঠকর্মী পদে কর্মরত দীপু মলি্লক বললেন, 'এটা ছিল সন্ধ্যাবেলা। মনে হচ্ছিল, আমাদের ওপর একটি আক্রমণ হতে পারে। গ্রামের অধিকাংশ নারী-পুরুষ ততক্ষণে পালিয়ে পেছনের পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু আমি অফিস থেকে ফিরে খুব ক্লান্ত ছিলাম বলে বাসাতেই থেকে গেলাম। হঠাৎ দেখি, হাজার দেড়েক সশস্ত্র মানুষ আমাদের গ্রামের দিকে আসছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল ফোনে আমার বড় দাদাকে ফোন করলাম। বড় দাদা আমাকে ধান বা খড়ের গাদার পেছনে লুকাতে বলল। আমি তাই করলাম। উঠানের একটা খড়ের গাদার পেছনে লুকালাম। হামলাকারীরা এসে আমার চোখের সামনে আমাদের ঘরের জিনিসপত্র লুট করছে দেখেও আমি কিছু বলিনি। কিন্তু যখন তারা আমাদের ঘরে আগুন দিতে গেল, তখন আমার সহ্য হলো না। আমি তাদের সামনে গিয়ে কেঁদে পড়ে বললাম, 'তোমরা সবকিছু লুট কর। কিন্তু আগুন দিও না। এ কথায় তারা রেগে গিয়ে আমাকে লাঠি দিয়ে একটা প্রচণ্ড বাড়ি দিল।'
'মন্দির আর বিহার পোড়ানোর আগুন হয়তো শেষ পর্যন্ত নিভে গেছে। কিন্তু আমাদের মন যে চিরতরে পুড়ে ছাই হয়ে গেল! আশা করি, সরকার দ্রুতই গোটা নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞের প্রকৃত হোতাদের মুখোশ উন্মোচনে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করবে।' এমন আশা জানালেন রামু বৌদ্ধ সমিতির সাধারণ সম্পাদক তরুণ বড়ূয়া।

অদিতি ফাল্গুনী : কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.