শেষ হলো সাক্ষ্য গ্রহণ- রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী সাক্ষ্য দিলেন সাঈদীর পক্ষে!

জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আসামিপক্ষের সাক্ষী হিসেবে গতকাল মঙ্গলবার সাক্ষ্য দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের তালিকাভুক্ত সাক্ষী গণেশ চন্দ্র সাহা।


তিনি মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নিহত ভাগীরথী সাহার ছেলে।
জবানবন্দিতে আসামিপক্ষের ১৭তম সাক্ষী গণেশ বলেন, তাঁর মাকে হত্যা করেছে পাকিস্তানি সেনারা। সাঈদী তাঁর মাকে মারেননি।
গণেশের সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রথম মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হলো। এই মামলায় পরবর্তী ধাপ যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনের জন্য ৫ নভেম্বর দিন ধার্য রয়েছে। যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন শেষে রায়ের দিন ধার্য করা হবে।
বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ গণেশ চন্দ্র সাহার জবানবন্দি নেন আসামিপক্ষের আইনজীবী মিজানুল হক। এ সময় সাঈদী আসামির কাঠগড়ায় হাজির ছিলেন।
রাষ্ট্রপক্ষ প্রথম আলোকে জানায়, এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীর তালিকায় গণেশ চন্দ্রের নাম ছিল। আসামিপক্ষ প্রথমে তাদের যে ৪৮ জন সাক্ষীর তালিকা ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেছিল, সেখানে গণেশের নাম ছিল না।
সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সৈয়দ হায়দার আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলা চলাকালে আমরা ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ করেছিলাম, রাষ্ট্রপক্ষের কয়েকজন সাক্ষীকে পাওয়া যাচ্ছে না, আসামিপক্ষ থেকে তাঁদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। অর্থের বিনিময়ে তাঁদের সাক্ষ্য দেওয়া থেকে বিরত রাখার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। রাষ্ট্রপক্ষের তালিকাভুক্ত সাক্ষী হয়েও আসামিপক্ষের সাক্ষী হিসেবে গণেশের সাক্ষ্য দেওয়া ওই অভিযোগ প্রমাণ করে। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণের সময় তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।’ তিনি বলেন, গণেশ চন্দ্র সাহাকে টাকার বিনিময়ে আসামিপক্ষ সাক্ষ্য দিতে নিয়ে এসেছে।
এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসামিপক্ষের আইনজীবী তাজুল ইসলাম বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি তাঁর মায়ের মৃত্যু নিয়ে মিথ্যা বলতে পারে না। তাঁর মা ভাগীরথী সাহার নাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, অনেক নাটক ও বইয়ে আছে। তাঁর মায়ের হত্যার সঙ্গে সাঈদীর কোনো সম্পর্ক ছিল না।’ তিনি বলেন, সাক্ষী মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিনের কাছে তাঁর মায়ের মৃত্যুর বর্ণনা দেওয়ার পর তাঁকে সাঈদীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বলা হলে তিনি রাজি হননি। তাই তিনি রাষ্ট্রপক্ষের পক্ষে সাক্ষ্য না দিয়ে সাঈদীর পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দিলেন।
জবানবন্দিতে গণেশ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় পিরোজপুর জেলার বাঘমারা গ্রামে তাঁদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা থাকতেন। তাঁর মা ভাগীরথী সাহা পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে রান্নার কাজ করতেন। সেই ক্যাম্প থেকে বিভিন্ন তথ্য এনে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের দিতেন। কিছুদিন পর তাঁদের গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের যুদ্ধ হয়। ওই যুদ্ধে ১০ পাকিস্তানি সেনা মারা যায়, অন্য সেনারা অস্ত্র ফেলে পিরোজপুরে পালিয়ে যায়। তাঁর মা ওই দিন পিরোজপুরের সেনাক্যাম্পে ছিলেন। ওই দিন মা বাড়ি না ফেরায় তিনি ও তাঁর ভাই কার্তিক চন্দ্র সাহা মায়ের খোঁজে বের হন। দুপুর ১২টার দিকে তাঁরা শোনেন, পাকিস্তানি সেনারা তাঁর মায়ের কোমর ও পায়ে দড়ি বেঁধে গাড়িতে করে নদীর ধারে নিয়ে গেছে। তাঁরা নদীর ধারে গিয়ে মায়ের ক্ষতবিক্ষত লাশ পড়ে থাকতে দেখেন। ওই সময় গাড়িতে বসেছিল খাকি পোশাক পরা পাঁচ পাকিস্তানি সেনা। কিছুক্ষণ পর সেনারা চলে যায়।
আসামিপক্ষের সাক্ষী বলেন, বছর দেড়েক আগে তিনি জানতে পারেন, তিনি এই মামলার সাক্ষী। তাঁর মায়ের মৃত্যুর বিষয়ে কোর্টের লোকজন ও সাংবাদিকেরা তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলেন। একদিন রফিক নামের একজন তাঁকে বলেন, ‘আমার বাবা কি আপনার মাকে মেরেছেন?’ তিনি রফিকের বাবার নাম জানতে চাইলে জবাব দেন, সাঈদী তাঁর বাবা। তখন তিনি রফিককে বলেন, ‘আপনার বাবা আমার মাকে মারেননি।’
জবানবন্দি শেষে গণেশ চন্দ্র সাহাকে জেরা করেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সৈয়দ হায়দার আলী। তিনি সাক্ষীকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিনকে দেখিয়ে জানতে চান, তাঁকে চেনেন কি না। জবাবে সাক্ষী বলেন, চেনেন।
পরে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মত (সাজেশন) দেন, সাক্ষীর মায়ের হত্যাকাণ্ডে সাঈদী প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন এবং তিনি অর্থের বিনিময়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিলেন। এ সময় গণেশ বলেন, এটি সত্য নয়।
গত বছর ৩ অক্টোবর এই মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। ঘটনার জব্দ তালিকা মিলিয়ে রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন ২৭ জন। আসামিপক্ষে সাক্ষ্য দিলেন ১৭ জন। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাগুলোর মধ্যে এই মামলায়ই প্রথম সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হলো।

No comments

Powered by Blogger.