তাঁর প্রয়াণে by হাসান আজিজুল হক

এখনকার মিডিয়ার দক্ষতাকে মাঝে মাঝে দুয়ো দিতে ইচ্ছে করে। সব খবরই কি এত দ্রুত চালাচালি করা ঠিক? কাল রাত ২টায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ঘুমের মধ্যেই চলে গেছেন। এই নিদারুণ দুঃসংবাদটি কি সকাল ৮টার মধ্যেই না পেলে চলছিল না।


আমি তখন ঘুম থেকে উঠে সবরকমেই অপ্রস্তুত, দেহ-মন কোনোটাই পুরোপুরি চালু হয়নি। ঠিক এই সময়ে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো সুনীলের মৃত্যুর সংবাদ! সুনীলকে চিরকাল এত সুস্থ দেখে এসেছি, এত শান্ত সমাধিতে সমাহিত আত্মস্থিত মানুষ বলে জেনে এসেছি, যে একটা অকস্মাৎ তাঁর জীবনের পূর্ণচ্ছেদ আমার কল্পনাতেও ছিল না। তাঁর অসুস্থতার কোনো খবরই পাইনি। আন্দাজ করছি তিনি অসুস্থও ছিলেন না। মৃত্যু এসেছে ঘুমের প্রশান্তির মধ্যে, আহ! এই খবর যদি আরো বিলম্বিত হতো, আমরা হয়তো এভাবে ধাক্কা খেতাম না।
সুনীলের অকালমৃত্যু হয়নি। এ দেশের হিসাবে কেন, উন্নত দেশগুলোর হিসাবেও তাঁর বয়সোচিত প্রয়াণই হয়েছে। তাঁকে নিয়ে খেদ করার কিছু নেই। কিন্তু মন তো সান্ত্বনা মানে না। শান্তভাবে এ খবর মেনে নেওয়া কঠিন।
সুনীলের সঙ্গে আমি খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম এ কথা বলা চলবে না। তবে সম্পর্ক দীর্ঘকালের। প্রায় ৫০ বছরেরও বেশি। সেই ষাটের দশকে। তাঁকে দেখার আগেই নাম শুনেছিলাম। লেখা পড়িনি। আমরা তখন লেখালেখির ঝোঁকে ৩ নম্বর ছাগলছানার মতো চারদিকে ছুটে বেড়াচ্ছি। তরুণরা কে কতটা অদ্ভুত হতে পারে তাঁর প্রতিযোগিতায় নেমেছি। নতুন সাহিত্য সৃষ্টি করতে হবে। প্রায় পত্রিকায় দেখছি সুনীলদের ছবি। মাঝরাতে মাতলামি করার অপরাধে শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কী সব রাগি তরুণ! তাদের নিয়ে অদ্ভুত সব গল্প বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। মাঝরাতে বাসডিপোয় পাঞ্জাবি ড্রাইভারের সঙ্গে দোস্ত পাতিয়ে শক্তি একা একটা বাস নিয়ে চলেছে বাড়িতে। কল্পনা করা যায় দোস্তকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে পাঞ্জাবি ড্রাইভার বাস বের করেছে কলকাতার রাস্তায়। যাত্রী একা শক্তি চট্টোপাধ্যায়। নিজের বাড়িতে নেমে দরজায় কড়াঘাত করে নিজেকেই ডাকাডাকি, শক্তি বাড়িতে আছিস, উঠে আয়, দরজা খোল, এদের তুলনায় শুনতে পাই সুনীল শান্ত-শিষ্ট। অতিশয় ভদ্র সৌম চেহারা তাঁর। যথেষ্ট ব্যক্তিত্ব আছে। বেসামাল বন্ধুদের তিনি মৃদু ধমকেই শান্ত করে দিতে পারেন। এসব গল্প শুনি। একদিন আমি, হায়াৎ মামুদ আর জ্যোতি প্রকাশ দত্ত একটি রেস্টুরেন্টে দুপুরে গিয়েছি ভাত খাওয়ার জন্য। আমাদের মধ্যে কে যেন কথায় কথায় বলল, আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যের ভবিষ্যৎ কী? অম্লান বদনে হায়াৎ মামুদ বললেন, ব্লিক (bleak)। আমার দীর্ঘশ্বাস পড়ল। তাহলে পশ্চিম বাংলার অবস্থা কী হায়াৎ? তখন এক নতুন সাহিত্যের কথা উঠে পড়ল। একদল সাহিত্যিক পুরনো সব কিছু ভেঙে ফেলতে চাইছেন। সুনীল একালের যুবক-যুবতীদের নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন 'আত্মপ্রকাশ'। প্রায় আধাঘণ্টা ধরে হায়াৎ সেই উপন্যাসের গল্পটা শোনালেন। মনে পড়ছে আমি খানিকটা চমকে গিয়েছিলাম। তারপর সুনীল পড়া। 'আত্মপ্রকাশ' তো বটেই 'যুবকযুবতীরা', 'অরণ্যের দিনরাত্রী', 'প্রতিদ্বন্দ্বী', 'অর্জুন' এসব তো বটেই, সেই সঙ্গে তাঁর ছোট গল্প, কিছু কবিতা। পড়ে 'সেই সময়' বিশাল উপন্যাসটি- এই উপন্যাসটি পড়ে মনে হয়েছিল এক বড় সাহিত্যিকের আর্বিভাব ঘটেছে। আমার মনে এই ধারণাটি নানা সময়ে নানাভাবে বিপর্যস্ত হয়ে গেছে বটে 'প্রথম আলো', 'পূর্বপশ্চিম' টানা পড়েছি এমন দাবি করব না, কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রিয় সুখপাঠ্য লেখার প্রতি আমার আগ্রহ কখনো নষ্ট হয়নি। তাঁর কলম স্বচ্ছন্দ। তাঁর গদ্য স্বচ্ছ ও সুপরিবাহী। বুদ্ধির একটা স্নিগ্ধ আলো তাঁর সব লেখাতেই আছে। কবি হিসেবে তিনি প্রথম শ্রেণীর। উপন্যাসের চেয়ে কিছু যেন আরো ভালো। এসব চুলচেড়া মূল্যায়ন এখন নয় যে মানুষটিকে ভালোবাসতাম। তাঁর কাছ থেকে মাঝে মাঝে চিঠিপত্র আসত, এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে পরস্পরকে ঠেস দিয়ে কথা বলতাম, একসঙ্গে সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছি- সেই মানুষ অকস্মাৎ চলে গেলেন এ বেদনা রাখি কোথায়?

No comments

Powered by Blogger.