প্রশাসক বসানোর আইনে আতঙ্কিত ব্যবসায়ীরা

কোম্পানি আইন সংশোধন নিয়ে আতঙ্কিত ব্যবসায়ীরা। তাঁদের আশঙ্কা, এর অপব্যবহার হবে এবং আইনটি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধেই ব্যবহূত হবে। এতে বিনিয়োগও নিরুৎসাহিত হবে। কোম্পানি আইনের সংশোধন নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার দিনভর নানা ধরনের তৎপরতা চলেছে।


সরকারের পক্ষ থেকেও বারবার ব্যবসায়ী নেতাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা হয়েছে। ব্যবসায়ী নেতারা নিজেরাও বৈঠক করে এর বিরুদ্ধে যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন।
বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনসহ (এফবিসিসিআই) সাত শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন গতকাল এক যৌথ বিবৃতিতে কোম্পানি আইনের প্রস্তাবিত ধারাটিকে ‘অগণতান্ত্রিক ও নিয়ন্ত্রণমূলক’ উল্লেখ করে তা কার্যকর না করার দাবি জানিয়েছে।
ব্যবসায়ীদের মতে, বর্তমান সরকারসহ পরবর্তী যেকোনো সরকার নতুন ধারাটিকে রাজনৈতিক হয়রানির কাজে ব্যবহার করতে পারে। যেকোনো কোম্পানিতে প্রশাসক বসানোর এই ধারাটি মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী এবং সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
আইনের অপব্যবহারের উদাহরণ দিয়ে গতকাল এক অনুষ্ঠানে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ বলেছেন, রিটার্ন দাখিল না করলে কোম্পানি আইনে জরিমানার পাশাপাশি ফৌজদারি মামলায় ছয় মাসের জেল হওয়ার বিধান রয়েছে। বহু আগের আইন হলেও রিটার্ন দাখিল না করার কারণে কেউ শাস্তি পেয়েছে বলে কখনো শোনা যায়নি। কিন্তু গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এটিকেই ব্যবহার করা হয়েছে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। প্রশাসক বসানোর এই আইনটির ভবিষ্যতে এভাবে অপব্যবহার করা হবে।
ব্যবসায়ীদের তীব্র আপত্তির মুখে গতকাল বিকেলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় খানিকটা সরে আসার আভাস দেয়।
বাণিজ্যসচিব গোলাম হোসেন বিকেলে সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে জানান, ডেসটিনির মতো প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যেসব কোম্পানি জড়িত, প্রকৃতপক্ষে সেগুলোতেই প্রশাসক বসানোর জন্য আইনে নতুন ধারা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘ডেসটিনিতে প্রশাসক নিয়োগ হবেই। কোম্পানি আইনে নতুন ধারা সংযোজন করেই হোক অথবা বিদ্যমান আইনের আওতায়ই হোক।’ আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে ডেসটিনির প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রশাসক নিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান সচিব।
গতকাল ব্যবসায়ীদের তৎপরতা শুরু হয় কোম্পানি আইন প্রণয়ন নিয়ে একটি পরামর্শমূলক কর্মশালায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ক্লাইমেন্ট ফান্ডের (বিআইসিএফ) যৌথ আয়োজনে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে কর্মশালাটি অনুষ্ঠিত হয়। আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ এতে প্রধান অতিথি এবং এম জহির সম্মানিত অতিথি ছিলেন।
বাণিজ্যসচিব গোলাম হোসেনের সঞ্চালনায় গতকাল অনুষ্ঠিত এ কর্মশালায় আলোচকেরা বেশির ভাগ কথাই বলেন বেসরকারি কোম্পানিতে সরকারের প্রশাসক নিয়োগের উদ্যোগটি নিয়ে। সচিব নিজেও এ আলোচনায় যোগ দেন। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে ভুল-বোঝাবুঝি হচ্ছে। এখনো চূড়ান্ত কিছু হয়ে যায়নি।
মাঝখানে কর্মশালা থেকে বেরিয়ে গিয়ে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ অন্য ব্যবসায়ীদের নিয়ে এ বিষয়ে ভিন্ন এক বৈঠক করেন সোনারগাঁও হোটেলেই। মধ্যাহ্নভোজের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি। বিজিএমইএর সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, বিটিএমএর সভাপতি জাহাঙ্গীর আলামীন প্রমুখ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেন, মূলত প্রতারক কোম্পানিতে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হবে। প্রকৃত ব্যবসায়ীদের চিন্তার কোনো কারণ নেই। অপব্যবহার রোধের যথেষ্ট রক্ষাকবচ রেখেই আইনে নতুন ধারা সংযোজনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আইনমন্ত্রী বলেন, কোম্পানি আইনের আওতায় নিবন্ধিত হয়ে কিছু প্রতিষ্ঠান বিপুল জনগোষ্ঠীকে ধোঁকা দিচ্ছে। পাঁচ হাজার টাকায় গাছ কিনলে দু-তিন বছর পর দ্বিগুণ, তিন গুণ মুনাফা দেওয়ার লোভ দেখানো হচ্ছে মানুষকে। প্রশাসক নিয়োগের উদ্দেশ্য হলো নির্দোষ জনগণকে সুরক্ষা দেওয়া, আর কিছু নয়।
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের বলেন, বেসরকারি কোম্পানিতে সরকারি প্রশাসক নিয়োগের উদ্যোগে ব্যবসায়ী মহল অতিশয় উদ্বিগ্ন। অংশগ্রহণমূলকের পরিবর্তে সরকার একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে স্বার্থান্বেষী মহল সুযোগ নেবে এবং অগণতান্ত্রিক শক্তি ব্যবসায়ীদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে প্রলুব্ধ হবে।
কর্মশালা শেষে বিকেলে হঠাৎ সচিবালয়ে এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন ডাকেন বাণিজ্যসচিব গোলাম হোসেন। গোলাম হোসেন এ সময় বলেন, সোমবার মন্ত্রিসভায় কোম্পানি আইনে প্রশাসক নিয়োগে অধ্যাদেশ জারির খসড়া নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে, চূড়ান্ত অনুমোদন নয়। এ বিষয়ে গণমাধ্যমে উঠে আসা প্রতিবেদনগুলোতে তথ্য ঘাটতি রয়েছে। প্রশাসকের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন আমলযোগ্য না হওয়ার কোনো প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় উপস্থাপিতই হয়নি। শেষ মুহূর্তে তা বাদ দেওয়া হয়েছিল।
কোম্পানি আইনের কর্মশালায় ব্যবসায়ী মহল ও আইনজীবীদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আলোচনা করে কিছু নতুন বিষয় খুঁজে পেয়েছেন জানিয়ে সচিব বলেন, ডেসটিনিতে প্রশাসক নিয়োগ হবেই। আইনে নতুন ধারা যুক্ত না করেও যদি সম্ভব হয়, তা এখন পরীক্ষা করে দেখা হবে।
নাম উল্লেখ না করে গোলাম হোসেন জানান, কাল বৃহস্পতিবার দুজন আইনজীবীর সঙ্গে এ বিষয়ে বৈঠবে বসবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ঈদের পর ৩০ অক্টোবর বড় আকারের বৈঠক করা হবে শীর্ষ ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে। এরপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
প্রস্তাবিত ধারার আওতায় রাজনৈতিক হয়রানির শঙ্কা থেকে যায় বলে সোমবারের মন্ত্রিসভায়ও আলোচনা হয়েছে বলে স্বীকার করেন বাণিজ্যসচিব। প্রশাসক নিয়োগের উদ্যোগটি মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী কি না, জানতে চাইলে গোলাম হোসেন বলেন, ‘স্বীকার করি। কিন্তু জনস্বার্থে সরকার যেকোনো পদক্ষেপ নিতেই পারে। বিশেষ করে এমএলএম পদ্ধতির ডেসটিনি, কথিত ও অস্তিত্বহীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বা হায় হায় কোম্পানির ক্ষেত্রে। নিবন্ধন নিয়ে এরা পিরামিড পদ্ধতিতে ব্যবসা করছে। এগুলোকে বাস্তবে কোম্পানি বলা যায় কি না, সেটাও দেখতে হবে।’
আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে ডেসটিনির প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রশাসক নিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান সচিব।
সোমবার প্রশাসক নিয়োগের অধ্যাদেশ জারির খসড়া অনুমোদনের এক মাস আগে এমএলএম আইনের খসড়া অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। এই আইনের আওতায় এমএলএম কোম্পানির প্রতারণার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় কি না, জানতে চাইলে সচিব বলেন, ‘সামাজিক অস্থিরতা তৈরির আশঙ্কা থেকে সরকারের শীর্ষ মহল থেকে বিষয়টি নিয়ে শিগগিরই কিছু করার তাগিদ রয়েছে।’
সাত ব্যবসায়ী সংগঠনের যৌথ বিবৃতি: এফবিসিসিআইসহ সাত বাণিজ্য সংগঠন গতকাল যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগ ও তার দায়মুক্তির বিধান রেখে কোম্পানি আইন সংশোধনের যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে, ব্যবসায়ীরা তা সমর্থন করেন না।
সংগঠনগুলো বলছে, কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতারণামূলক বা জনস্বার্থহানিকর কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করার জন্য ওই প্রতিষ্ঠানে যদি প্রশাসক নিয়োগ করতে হয়, তা হওয়া উচিত বর্তমান কোম্পানি আইন, ১৯৯৪-এর আলোকে, আদালতের আদেশের মাধ্যমে। সরকারের প্রশাসনিক পদক্ষেপ হিসেবে তা করা উচিত নয়।
যৌথ বিবৃতিতে সই করেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ, সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, আইসিসিবির সভাপতি মাহবুবুর রহমান, এমসিসিআইয়ের সভাপতি আমজাদ খান চৌধুরী, ডিসিসিআইয়ের সভাপতি আসিফ ইব্রাহীম, বিজিএমইএর সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, বিটিএমএর সভাপতি জাহাঙ্গীর আলামীন এবং বিকেএমইএর সভাপতি এ কে এম সেলিম ওসমান।
বিবৃতিতে বলা হয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগের বিধান ব্যবসায়ীরা সমর্থন করেন না। তবে অবৈধ লেনদেন, আর্থিক অনিয়ম ও প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত বহুস্তর বিপণন (এমএলএম) প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রশাসক নিয়োগবিধি-সংক্রান্ত পৃথক যে আইন আছে, তাতে ব্যবসায়ীদের সমর্থন থাকবে।
লক্ষ্য অর্জনে একতরফা নিয়ন্ত্রণমূলক পন্থা অবলম্বন করা সঠিক পথ নয় মন্তব্য করে ব্যবসায়ীরা বলেন, কোনো বিধান বা নীতিতে পরিবর্তন আনতে হলে সবার অংশগ্রহণে ও আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন।
শীর্ষ ব্যবসায়ীরা মনে করেন, প্রস্তাবিত সংশোধনীতে প্রশাসকের চূড়ান্ত দায়মুক্তির বিধান রাখা হয়েছে। প্রশাসকের দায়মুক্তির বিধান কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। কেননা, এতে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা থাকে না। পাশাপাশি দুর্নীতির ব্যাপক সুযোগ থেকে যায়।
সরকারের এমন একপক্ষীয় সংশোধনী স্বার্থান্বেষী মহল অপব্যবহার করতে পারে বলে আশঙ্কা করে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো বলছে, এতে বাংলাদেশের ব্যবসায় পরিবেশে যে বাজারভিত্তিক এবং প্রতিযোগিতামূলক ধারা শুরু হয়েছে, তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগও কমে যেতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.