বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৫৫০ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক সাহসী দলনেতা কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের রাতে সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমসহ মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকজন দলনেতা (কোম্পানি অধিনায়ক) সমবেত হন অনেক গাছের নিচে।


তারায় তারায় খচিত আকাশ। চারদিকে থমথমে নীরবতা। মাঝেমধ্যে শুধু ঝিঁঝি পোকার ডাক। দলনেতা সবার মধ্যে চরম উত্তেজনা। অধিনায়কের (ব্যাটালিয়ন কমান্ডার) সঙ্গে কথা বলে তাঁরা যাঁর যাঁর অবস্থানে যান।
ভোররাতে শুরু হবে মুখোমুখি যুদ্ধ। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে তাঁরা আক্রমণ করবেন। এ রকম যুদ্ধে রক্তপাত, মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী। অনেকে মারা যাবেন, আহত হবেন। যুদ্ধকালে অবচেতন মনে মৃত্যুচিন্তা যোদ্ধার নিত্যসঙ্গী। সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বিচলিত হননি। সব ভয় লুকিয়ে রাখেন আশাবাদী আচরণে, যাতে তাঁকে দেখে সহযোদ্ধারা অনুপ্রাণিত হন।
নির্ধারিত সময়ে ভারত থেকে শুরু হয় দূরপাল্লার গোলাবর্ষণ। একনাগাড়ে অনেকক্ষণ ধরে চলে। চারদিকের মাটি কেঁপে ওঠে। গোলাবর্ষণ শেষ হওয়া মাত্র ইবরাহিম সহযোদ্ধাদের নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওপর। শুরু হয় মেশিনগান, রাইফেলসহ অন্যান্য অস্ত্রের অবিরাম গোলাগুলি। দুই পক্ষে সমানতালে যুদ্ধ চলে।
একপর্যায়ে পাকিস্তানিদের পাল্টা আক্রমণের তীব্রতা প্রচণ্ডভাবে বেড়ে যায়। এ রকম অবস্থায় দলনেতার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ইবরাহিম অত্যন্ত দক্ষতা এবং যথাযথভাবে তাঁর দায়িত্ব পালন করেন। প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে নিজের জীবন বাজি রেখে সহযোদ্ধাদের মনে তিনি সাহস জুগিয়ে তাঁদের ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় সহযোদ্ধারা অনুপ্রাণিত হয়ে সাহসিকতার সঙ্গে পাল্টা আক্রমণ চালান। তাঁদের বীরত্বে থেমে যায় বেপরোয়া পাকিস্তানি সেনাদের অগ্রযাত্রা। যুদ্ধ চলতে থাকে।
এ ঘটনা আজমপুরে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আখাউড়া রেলজংশন ঘিরে যে প্রতিরক্ষা বূহ্য তৈরি করেছিল তার উত্তর অংশ ছিল এই আজমপুর। ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট রেলপথে আখাউড়া। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত। এর অদূরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা। আখাউড়া তখন সামরিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই আজমপুর দখলের মাধ্যমেই শুরু হয় আখাউড়া দখলের যুদ্ধ। ১ ডিসেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত আজমপুর, সিংগারবিল, মুকুন্দপুর ও আখাউড়ায় তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
৪ ডিসেম্বর ভোরে আখাউড়া মুক্ত হয়। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অন্যান্য দলসহ ‘সি’ কোম্পানির দলনেতা ইবরাহিমও সহযোদ্ধাদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সেই যুদ্ধে। পাকিস্তানি প্রতিরক্ষার ট্রেঞ্চে থাকা সেনাদের বধ বা অপসারণ করতে মুক্তিযোদ্ধারা ৩ ডিসেম্বর সারা দিন ও রাত কদমে কদমে অগ্রসর হন। ইবরাহিমের সাহসী নেতৃত্বে তাঁর দলের মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন অসম্ভবকে সম্ভব করেন।
ইবরাহিম ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এর অবস্থান ছিল জয়দেবপুর রাজবাড়িতে। তখন তাঁর পদবি ছিল সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট (মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে লেফটেন্যান্ট হিসেবে পদোন্নতি পান)। ২৫ মার্চের পর মেজর কে এম সফিউল্লাহর (বীর উত্তম, বালাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম সেনাপ্রধান, পরে মেজর জেনারেল ও রাষ্ট্রদূত) নির্দেশে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে।
প্রতিরোধযুদ্ধে ইবরাহিমের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় তিনি হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। এরপর ভারতে যান। সেখানে আবার সংগঠিত হওয়ার পর তিনি প্রথমে ৩ নম্বর সেক্টরের অ্যাডজুট্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর ‘এস’ ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘সি’ (চার্লি) কোম্পানির অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তেলিয়াপাড়া, মাধবপুর, আখাউড়া, লালপুর ও ডেমরার যুদ্ধ তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধে বিশেষত আখাউড়ার যুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ১৮।
ইবরাহিম স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতেই কর্মরত ছিলেন। ১৯৯৬ সালে কথিত অভ্যুত্থানের অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত ও চাকরিচ্যুত হন। তখন তাঁর পদবি ছিল মেজর জেনারেল এবং যশোরে জিওসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
তাঁর পৈতৃক বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার উত্তর বুড়িশ্চর গ্রামে। এখন স্থায়ীভাবে বাস করেন ঢাকার মহাখালী ডিওএইচএসে (বাসা ৩২৫, লেন ২২)। তাঁর বাবার নাম এস এম হাফেজ আহমেদ, মা শামসুন নাহার। স্ত্রী ফোরকান ইবরাহিম। তাঁদের এক মেয়ে, এক ছেলে।
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, ‘যুদ্ধে সাহসিকতা প্রদর্শন এবং শত্রু নিধন উভয় কর্মই যেমন ব্যক্তিগত, তেমনই সমষ্টিগত। আমি সব সময় আমার তখনকার সহকর্মীদের সাহসিকতাকে স্মরণ করি। স্বল্প পরিসরে সবার কথা বলার সুযোগ না থাকায় শুধু একজনের কথা উল্লেখ করছি প্রতীকী অর্থে।
আজমপুরে যুদ্ধ চলাকালে ৩ তারিখ বিকেল আনুমানিক চারটার দিকে আমি পাশের কোম্পানি কমান্ডার লেফটেন্যান্ট ইবনে ফজল বদিউজ্জামানের সঙ্গে ফিল্ড টেলিফোনে কথা বলি। এর কয়েক মিনিট পর আমাদের পজিশনের দক্ষিণ দিক থেকে অর্থাৎ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দিক থেকে বদিউজ্জামানের দলের ওপর আক্রমণ আসে। এ সময় পাকিস্তানিরা ব্যাপক আর্টিলারির গোলাবর্ষণ করে। সাহসী ও কর্তব্যপরায়ণ বদিউজ্জামান নিজ দলের মুক্তিযোদ্ধাদের তদারক করার জন্য সামনে যান। মিনিটের মধ্যে তিনি গোলার আঘাতে দিখণ্ডিত হয়ে যান। কয়েক মিনিট পর আমি সেখানে গিয়ে তাঁকে ওই অবস্থায় পাই। এ ঘটনা আমাকে এখনো আলোড়িত করে, এটা আমি ভুলতে পারিনি।’
সূত্র: সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক, মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক, রাফিয়া চৌধুরী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
ৎashedtৎ@pৎothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.