এল আনন্দ দিন by ফারজানা শারমীন

‘জানো...জানো...আমাদের গরুটা না লাল!’—ঝুঁটি দোলাতে দোলাতে গত ঈদে আমাকে এই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি জানিয়েছিল পিচ্চি এশা। সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যপটের পরিবর্তন। বাজনার তালে তালে যেন বিগত সময়ের কিছু সুখদৃশ্যের চলমান প্রদর্শনী শুরু হয়ে গিয়েছিল আমার চোখের সামনে।


ওই তো লাল নীল পুতুলের রাবার ব্যান্ড দিয়ে ঝুঁটি করা ছোট্ট আমি। সেই সময় আমার কাছে কোরবানির ঈদ মানেই ছিল দুই দিনের জন্য বড় বড় চোখের একটা আস্ত গরুর মালিকানা পেয়ে যাওয়া, যার শিং দুটিকে আমার ভয়ও করত। আবার দেখতে মজাও লাগত। কী সুন্দর শার্পনার দিয়ে শার্প করা দুটি চোখা চোখা শিং! বাবা গরু কিনে আনার মুহূর্ত থেকেই গরুটার সঙ্গে আমার হাম্বা ভাষা এবং বাংলা ভাষায় কুশলাদি বিনিময় শুরু হয়ে যেত। কোরবানির ঈদে তো কেউ জামা কেনে না, তবে গরুকে সাজুগুজু করানোর জন্য অনেক কিছু কিনতে হয়—এটা জানতাম। তাই আমাদের গরুটাকে কাগজের মালা, চকচকে বেগুনি-লাল-নীল-জরির মালা দিয়ে সুন্দর করে সাজানোর চেষ্টা চালাতাম। বেলায় বেলায় গরুর আশপাশে ঘুরঘুর করতাম। আর মাকে বারবার তাগাদা দেওয়া তো চলতই, ‘আম্মু, এখনো তুমি গরুটাকে মাড় দিচ্ছ না কেন? আমাদের গরুটা তো মরেই যাবে!’ আজন্ম শহুরে ব্যাং আমি। এত বড় একটা জলজ্যান্ত প্রাণী নিয়ে তাই আমার চোখেমুখে জমাট বাঁধত কৌতূহল। ড্যাব ড্যাব করে দেখতাম কীভাবে সে লেজ নাড়ে, কীভাবে বালতিতে মুখ ডুবিয়ে পানি খায়, বেশি বেশি গুঁতাগুঁতি করলে কীভাবে চোখ পাকিয়ে তাকায়!
ঈদের আগের দিন গোল গোল করে হাতের তালুতে বাটা মেহেদি লাগিয়ে দিত বড় আপু। আমার কাছে এ এক অদ্ভুত ম্যাজিক তখন! লাগিয়ে দিলাম সবুজ, হয়ে গেল কমলা। তাই কঠোর সাধনা আমার। হাত ব্যথা করছে। তবু মেহেদি ওঠাব না। হাত নড়ালেই তো সমস্যা।
শৈশব কালের ধুলো পড়া দরজাটায় কড়া নাড়তে নাড়তে আবারও শুরু হলো ঈদের আনাগোনা। চলে এল আনন্দ-দিন। একটি গোমড়া মুখের শহরকে এই দিনটি আবারও বানিয়ে দেবে আনন্দনগর। এখন আর ড্যাব ড্যাব করে গরু দেখব না, বাটা মেহেদির ম্যাজিকও ফুরিয়ে গিয়েছে। এখন এই ম্যাজিকটা দেখার জন্য অপেক্ষা করছি। আনন্দ দিন-আনন্দ পথ এবং আনন্দনগরের ম্যাজিক। মেহেদি বাটার সবুজ সবুজ ঘ্রাণ, মাংসের ঝাঁজালো বাষ্প, যান্ত্রিক কোলাহলের আপাত-স্থবিরতা, আটপৌরে জীবনের বৃত্ত থেকে একটু ছুটি, দৌড় দৌড় সময়কে থামিয়ে একটু শ্বাস নেওয়া এবং সম্পর্কের ঢিল হয়ে আসা সুতাগুলোতে গিঁট দেওয়া—এসবই তো ঈদ! যদিও একটা জলজ্যান্ত প্রাণীকে নিজ হাতে কাঁঠালপাতা খাওয়ানোর সেই ইছের সলতেটা এখন নিভু নিভু। বড় হয়েছি না! তবু ঈদ আসছে। আর তাই অপেক্ষা করছি। পিচ্চি এশা আবারও দৌড়ে আসবে। বলবে, ‘জানো...জানো...আমাদের গরুটা না...’
 ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.