আমার ঈদ আমার আনন্দ by হাসান ইমাম

ঈদ উৎসব মানেই আমি একজন মহাতারকা! ঈদে আমার জন্য অনেকেই অপেক্ষা করে থাকে। আমার বাড়ি যাওয়ার তারিখের ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে। মা বসে থাকে আমার প্রিয় সব খাবার রান্না করার জন্য।


ছোট বোন তার নতুন জামা বুঝে নিতে মাস খানেক আগে থেকেই তাগাদা দেয়, ‘কবে আসবি, ভাইয়া।’ বন্ধুরা ঘুরতে যাওয়ার স্থান নির্ধারণে ব্যস্ত থাকে শেষ দিন নাগাদ। পাড়ার যত ছেলেপুলে আছে, তারা অপেক্ষায় থাকে কড়কড়ে নতুন টাকা উপহার নিতে। এলাকার বয়স্ক চাচা-দাদারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে, শরীরের কী হাল হচ্ছে বা বিয়ের বয়স হলো কি না। এমন কিছু উৎসুক মুখও অপেক্ষায় থাকবে, যারা ‘আমি বখে যাইনি’ শুনে আবারও মর্মাহত হবে। এত মানুষ যার অপেক্ষায়, সেই আমি কি তারকা নই! ঈদের ছুটিতে আমি বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। ঈদের আগেই মায়ের একচিলতে হাসি আমাকে উৎসবের গাঙে ভাসায়। অপেক্ষায় থাকা অন্য মানুষের মুখ দেখতে তাই গ্রামে ছুটে যাওয়া। উৎসব এলেই আমার মন ভালো হয়ে যায়। ছোটবেলা থেকেই ঈদের দিন খুব ভোরে তপন কাকা (তপন ঘোষ, গোয়ালা) দুধ দিয়ে যায়। মা সেই দুধে সেমাই-পায়েস রাঁধেন। রান্না শেষে তপন কাকাও যোগ দেন আমাদের সেমাই খাওয়ার আয়োজনে। শেষ বেলায় পানি খেতে খেতে কাকা বলেন, ‘বৌদি, এবারের সেমাইটা গতবারের চেয়ে মিঠা মনে হলো।’
এবার তপন কাকা আসবে তো? প্রশ্ন মনে আসার একটা কারণও আছে। তা হলে খুলেই বলি।
ইন্দ্রজিতের (ছদ্মনাম) সঙ্গে আমার পরিচয় অনেকটা গল্পের মতো করে। প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম শহরে এসেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এখানে আসা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনে উঠেছি। কিন্তু তিল ধারণের ঠাঁই খুঁজতে যাওয়াও বোকামি হবে। দাঁড়ানোর চেয়ে মুশকিলে পড়লাম ঘাড়ের ব্যাগটা নিয়ে। সামনের সিটে বসা ছেলেটি হাত বাড়িয়ে দিল। ‘আমার কাছে দিতে পারো’—এই একটা বাক্যই আমাদের দোস্তি হতে সাঁকো বেঁধে দিল। পরের কদিন আমরা ছিলামও একসঙ্গে। দেখলে যে কারোর মনে হবে ইন্দ্রজিৎ আমার অনেক দিনের বন্ধু। অনেক কিছুতে মিল আমাদের। ফিরে আসার দিনে চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে আমাকে ইন্দ্র বলেছিল, ‘বন্ধু ফোন কোরো।’ ফোন করেছিও নিয়মিত। কখনো আমি, কখনো সে। ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রায় নিয়ম করেই আমাদের কথা চলছে। মজার কিছু ঘটলেই বন্ধুকে জানাতে ফোন। বাসায় কিছু ঘটলেও জানাতেই হবে। ঈদের দিন তো সবার আগের এসএমএসটি আসে ইন্দ্রর কাছ থেকে। সে আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। জগতের প্রতিটি জীবের সুখ থাকার প্রার্থনাটা ইন্দ্র আমাকে শিখিয়েছিল। ইন্দ্রের আমন্ত্রণে বার দুই গিয়েছিলাম রামুতে তার বাড়ি। সে আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল তাদের সংস্কৃতি আর পুরোনো বৌদ্ধমন্দিরগুলো। কোন মন্দিরের টিনের চালে তার হাত কেটেছিল; কীভাবে প্রতিটি মন্দির গড়ে তোলা হয়; কেমন জীবনযাপন তাদের। এমনই আরও অনেক কিছু জেনেছিলাম তার কাছে। কেমন একটা শান্তি শান্তি ভাব সব এলাকায়। সবার সঙ্গে সবার ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হই আমি। ফানুস ওড়ানোর ভেতরে যে অসম্ভব ভালো লাগা থাকতে পারে, তা আমি শিখেছিলাম ওই বন্ধুর কাছ থেকেই। আমার ওপর ইন্দ্র একবার অনেক রাগ করেছিল। তাদের উৎসবে একবার আমাকে খুব করে যেতে বললেও আমি যেতে পারিনি, তাই।
কিন্তু এখন কীভাবে যাব? গেলে তো আর আগের মতো করে ঘুরে দেখাতে পারবে না তাদের প্রাচীন সেই মন্দিরগুলো, যা ছিল বাংলাদেশের অনন্য এক পুরাকীর্তি। শেওলা পড়া মন্দিরের টিনের চালা যেখানে ইন্দ্রর হাত কেটেছিল।
সাম্প্রতিক সময়ে রামুর ঘটনার পর থেকে ইন্দ্রর সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। ফোনটা কেন জানি বন্ধ। টেলিভিশনে খবর দেখলাম, ইন্দ্রদের এলাকায় আগুন জ্বলছে। মনটা ছটফট করছিল। টানা এক দিন পর হঠাৎ ফোন। নম্বরটা অপরিচিত, তবে গলাটা বেশ পরিচিত। আধো বাংলা আর আধো পাহাড়ি ভাষায় উচ্চারণ ‘বন্ধু’। ব্যস্ত হয়ে জানতে চাইলাম, ‘কেমন আছ, ইন্দ্র?’ ওপার থেকে শুধু কান্নার শব্দই আসছে। মিনিট খানেক বাদে উত্তর আসে ইন্দ্রর কাছ থেকে, ‘আমাদের বাড়ি পুড়ে গেছে। পুড়ে গেছে আমাদের সেই ঠাকুর আর আমার সেই টিনের চালা।’
আর বলতে পারছি না, কণ্ঠটা আমার দুই পাশ থেকে কেউ মনে হচ্ছে জোরে চেপে রেখেছে।
আসলে ইন্দ্রজিৎ নামে আমার কোনো বন্ধু নেই। তবে ইন্দ্র যেন আমার বন্ধুর চেয়েও বেশি কিছু। ইন্দ্রর সঙ্গে আমার নিশ্চয় কথা হবে, বিশেষ করে ঈদের দিন। ইন্দ্র বলবে, ‘বন্ধু, ঈদ মোবারক।’

No comments

Powered by Blogger.