সাদাকালো-দখলদারির এই ধারা আর কত দিন by আহমদ রফিক

জবরদখলের হিড়িক পড়ে গেছে। মনে হয় দেশটির কোনো অভিভাবক নেই; যিনি বলতে পারেন 'অ্যাই, কী হচ্ছে এসব।' শুধু বলা নয়, বলে ব্যবস্থা নিতে পারেন। যদি তেমন কেউ থাকতেন, তাহলে এভাবে অবাধ জবরদখল চলতে পারত?' দীর্ঘদিন ধরে এ নৈরাজ্য চলছে।


'দখলদার' বহু প্রচলিত এ শব্দটি থেকেই অবস্থার ভয়াবহতা অনুমান করা চলে। একসময় এসব দখলদারের নজর ছিল অসহায় দরিদ্রজনের জমি, বসতভিটা; সেই সঙ্গে কখনো দেবোত্তর সম্পত্তি, কখনো শ্মশানঘাট বা এজমালি সম্পত্তি।
এখন সেই লোভ বাড়তে বাড়তে মন্দির, গির্জা হয়ে শেষ পর্যন্ত নদীতে এসে ঠেকেছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এদের টার্গেট। টার্গেট হিন্দু-মুসলমান গরিব মানুষের ভালো অবস্থানের লোভনীয় জমি। বছর কয় ধরে চলছে নদীর ওপর দখলবাজি। কখনো পাড়সংলগ্ন অগভীর অংশে বেড়া দিয়ে মাটি ভরাট, কখনো চরসংলগ্ন অংশ ভরাট করে চর দখল। দেখার কেউ নেই, বলার কেউ নেই। চলছে নদীতে বেড়া দিয়ে মাছ চাষ।
বছর কয়েক আগে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যাসহ ছোট ছোট নিস্তরঙ্গ নদীতে চলেছিল দখলবাজি বা জবরদখল। সে সময় হাইকোর্টের নির্দেশে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের ব্যবস্থা নেওয়া হয় কাঁচপুরের কাছে শীতলক্ষ্যা নদীতে জবরদখলের বিরুদ্ধে। তখন নদীর কান্না নিয়ে কলাম লিখেছিলাম। কিছুদিন পর আবার কাগজে খবর পড়ি : সেই অবৈধ দখল আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এ পর্যায়ে সরকারি ব্যবস্থা গ্রহণ সম্পর্কে আর কোনো খবর প্রকাশিত হয়নি।
বাংলাদেশে জবরদখল এমন রমরমা বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে যে ভাবতে অবাক লাগে সমাজ ও শাসনযন্ত্রের স্তব্ধ নীরবতায়। উচ্চ আদালতের নির্দেশও এদের লোভের আগ্রাসন বন্ধ করতে পারছে না। সম্ভবত ব্যক্তিমালিকানার ভূ-সম্পত্তি দখল প্রায় শেষ হয়ে এসেছে- ছোট্ট বাংলাদেশে কত ভূমিই বা দখল করার মতো অবস্থায় থাকতে পারে- তাই এখন লক্ষ্য জাতীয় সম্পদ, প্রাকৃত-সম্পদ নদী-বিল ইত্যাদি জলাশয়ের দিকে। কারণ জাতীয় সম্পদ দখল সহজ। এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো লোকের অভাব। সরকারি সম্পদের কোনো হিসাব-নিকাশ নেই। যদি থাকত, তাহলে কি প্রকৃতির দান, জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনের পক্ষে অপরিহার্য নিবিড় বনভূমি নির্বিবাদে সাবাড় হতে পারত? কিন্তু হচ্ছে তো। সংবাদপত্রের কল্যাণে আমরা অসহায় চোখে সেসব দেখি।
আমাদের সুশীল সমাজ, কথিত পরিবেশপ্রেমী ব্যক্তি ও সংগঠন 'পরিবেশ বাঁচাও' বলে ধ্বনি তোলে। কিছু কাজও যে করে না এমন নয়। কিন্তু পরিবেশবিনাশী ও প্রাকৃত-সম্পদ দখলবাজদের আগ্রাসন রুখতে নিবেদিতপ্রাণ লাগাতার তৎপরতার অভাব ঠিকই লক্ষ করা যায়। দখলদারদের লোভের হাত থেকে শাসন-কর্তৃপক্ষের অবস্থানস্থল ঢাকা মহানগরও রক্ষা পাচ্ছে না। বুড়িগঙ্গা বা তার বাঁধ থেকে ছোটখাটো সড়ক পর্যন্ত এক শ্রেণীর প্রভাবশালী মানুষের লোভের শিকার।
মাঝেমধ্যে মনে হয়, আর কত দিন ধরে চলবে এ-জাতীয় দখলবাজি- দেশটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কি? দিন কয় আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের এক অধ্যাপক লিখেছেন ঢাকার বুক চিরে একদা প্রবাহিত ধোলাই নদীর কথা- সে নদী ধোলাইখাল হয়ে শেষ পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের কল্যাণে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে একটি পচা ডোবায় পরিণত। ছোট্ট নদীটা পুরনো বাসিন্দাদের জন্যই শুধু নয়; গোটা শহর ঢাকার জন্য আশীর্বাদের মতো হয়ে থাকত। তবে অনাচার এ কালে যে পর্যায়ে বেড়ে চলেছে, তাতে বেঁচে থাকলে গোটা ধোলাইখাল বেদখল হয়ে যেত কি না বলা কঠিন।
কয়েক দিন আগে এই পত্রিকায়ই প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, 'বাকল্যান্ড বাঁধের ওপর দিয়ে গড়ে ওঠা সদরঘাট-শ্যামবাজার-উল্টিনগঞ্জ-পোস্তগোলা সড়কটি দখল করে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে রেখেছে শ্যামবাজার কৃষিপণ্য আড়ৎ বণিক সমিতি। দখলের কারণে সদরঘাট থেকে পোস্তগোলা মহা শ্মশানঘাট পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা অচল।' আমরা জানি না, এর পরিণতি কী? কার হিসাবে কতটা যাবে- প্রভাবশালী ব্যবসায়ী থেকে তুখোড় রাজনীতিবিদ।
আর যে কথা বহুবার বলা ও লেখা হয়েছে তা হলো, সড়ক দখল করা অবৈধ আড়তের শত শত টন আবর্জনা প্রতিদিন উদ্দেশ্যমূলকভাবে বুড়িগঙ্গায় ফেলে পাড়সংলগ্ন অংশ ভরাট করে ফেলা হচ্ছে। এরপর এক মাহেন্দ্রক্ষণে ভরাট বুড়িগঙ্গা দখলের প্রক্রিয়া চলবে; যেমন চলছে একাধিক নদীর ক্ষেত্রে। বুড়িগঙ্গার স্রোত, তার গতি ক্রমেই কমে আসছে, কমছে তার প্রশস্ত ব্যাস। নানাবিধ আবর্জনা ও কারখানার বর্জ্যে (মূলত ট্যানারির) অগভীর ও দূষিত হচ্ছে বুড়িগঙ্গার জলস্রোত। কোথাও কোথাও পানিতে পচা গন্ধ, বিশেষ করে শীতকালে যখন পানির পরিমাণ কমতে থাকে।
একই অবস্থা শীতলক্ষ্যার। তারও আয়তন, স্রোতের গতি ক্রমেই কমে আসছে। তুরাগ একদিন রুদ্ধ হয় ধূসর ভূমি হয়ে উঠলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ আমরা দৃষ্টিহীন, আমরা অচেতন। তা না হলে পরিবেশবাদী ও ঢাকাপ্রেমী মানুষ মিলে 'নর্দমা বাঁচাও'-এর মতো একটি আন্দোলন গড়ে তুলতে পারতেন- স্লোগান : 'বুড়িগঙ্গা বাঁচাও, শীতলক্ষ্যা বাঁচাও'। দুটোই ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন নদী। কিন্তু বাংলাদেশে পরিবেশ আন্দোলনের তেমন কোনো পরিবেশ সচেতনতা দেখা যায়নি, যাচ্ছে না।
আমরা বরাবর পড়ে এসেছি 'নদীমাতৃক বাংলাদেশ'- কথাগুলো। হরহামেশা লিখিও নানা উপলক্ষে। নদীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা যদি বাদও দিই (আমাদের নান্দনিক বোধ তো খতম হয়ে যাওয়ার পর্যায়ে), তাহলেও মানতে হবে, নদী আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রধান অবলম্বন। আর তা নিয়ে ব্যাখ্যারও প্রয়োজন পড়ে না। এ সত্যটা আমরা সবাই জানি। তবু নদীর বহমান জলস্রোত রক্ষায় আমাদের সচেতনতার বড় অভাব। তাই নদীর কান্না আমাদের কানে পৌঁছায় না। সামগ্রিক প্রয়োজনের দিকেও আমাদের নজর কম। সীমাহীন লালসা এক শ্রেণীর মানুষকে বেপরোয়া করে তুলেছে। আমরা প্রতিরোধের ভাষা ভুলে গেছি।
প্রশাসন যেখানে নির্বিকার, উচ্চ আদালতের নির্দেশ কার্যকর করতে সেখানে সাধারণ নাগরিক সমাজ এগিয়ে আসার কথা জাতীয় স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে। কিন্তু আমাদের সমাজ তেমন সচেতনতা দেখাতে পারছে না। বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা তাই অবৈধ দখল থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। একটি লেখায় পড়েছি, বুড়িগঙ্গার ১৫২ কিলোমিটার এলাকায় দুই তীরে ১২৪ জন অবৈধ দখলদার চিহ্নিত হলেও তাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি।
কেন? অবশ্য কায়েমি স্বার্থ ও রাজনৈতিক স্বার্থের টানে। অথচ প্রভাবশালী বা ক্ষমতাবান ঢাকাই নাগরিক (ভিআইপি বা সিআইপি) কেউ ভাবছেন না যে বুড়িগঙ্গার পানি ক্রমেই শোধনের অযোগ্য হয়ে উঠছে, যে পানি ওয়াসা নাগরিকদের জন্য 'পানীয়জল' হিসেবে সরবরাহ করে থাকে। প্রায় অপেয় এই পানির কারণে জলবাহিত রোগের এত প্রাদুর্ভাব।
আধুনিককালের স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ আমরা। 'কোলেস্টেরল-ফ্রি' বা 'ফ্যাট-ফ্রি' খাদ্যের জন্য আমাদের কত হাহাকার। বোতলের পানি খেয়ে ভাবি, আঃ কী বিশুদ্ধ পানি পান করা গেল! ঠিকঠাক খবর নিতে পারলে হয়তো দেখা যেত, ওই বিশুদ্ধ পানির উৎস ওয়াসার ট্যাপ বা তেমনি অগ্রহণযোগ্য উৎস। বহু দিন ধরে বলা হচ্ছে ট্যানারিগুলো ঢাকার বুক থেকে সরিয়ে নিতে, পরিকল্পনাও করা হচ্ছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
বুড়িগঙ্গার সমস্যার কথা যদি বাদও দিই, তবু আমাদের নদীর ওপর অনাচারবিষয়ক জায়গাটা একেবারে স্বস্তিতে নেই। দেশজুড়ে সর্বত্র ছোটখাটো নদীগুলোর ওপর চলছে অবিরাম অনাচার, অবৈধ দখলের কারসাজি। কখনো কখনো একদা প্রমত্তা পদ্মা বা যমুনাও বাদ যাচ্ছে না। নদী সম্পদবিষয়ক কর্তৃপক্ষ কিভাবে চোখ বন্ধ করে বসে আছে, তা ভাবতে পারা যায় না। খবরের কাগজগুলোতে প্রতিদিন না হলেও প্রায়ই নদী জবরদখলের খবর প্রকাশিত হচ্ছে, তবু আমাদের হুঁশ নেই। কখনো দেখা যায় নদীতে বাঁধ।
এই তো কয়েক দিন আগে একটা অদ্ভুত খবর এ কাগজেই প্রকাশিত হয়েছে। 'নদীর ভেতর বাজার'। সুদৃশ্য সচিত্র প্রতিবেদন। 'নদীতে ড্রেজার বসিয়ে বালু ভরাট চলছে। চলছে বাজার স্থাপনের প্রক্রিয়া। এ অপকর্মের সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালীরা।' পাঠক, ভাবতে পারেন নদীর বুকে বাজার! আমাদের লোভ-লালসা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে! এ ঘটনা কিশোরগঞ্জের চৌগঙ্গা বাজারকে কেন্দ্র করে। বাজারসংলগ্ন চারটি শাখা নদী। সেখানে পড়েছে লোভের হাত।
আর বাজার পরিচালনা-সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালীদের লোভের হাত এতটাই প্রসারিত হয়েছে যে নদী দখল করে অর্থাৎ ভরাট করে বাজারের আয়তন দ্বিগুণ করা হয়েছে। তাতে সংলগ্ন হাওরের বুকেও হাত পড়েছে। নদী থেকে বালু-মাটি দুই-ই তোলা হচ্ছে। বিক্রি করে অনেক লাভ, অনেক টাকার আমদানি। যেমন দোকানের সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ায়ও লাভ। নদী থেকে বালু তোলার ফলে পাড় ভাঙছে, নষ্ট হচ্ছে বাড়ি-ঘর।
ঢাকার কাছে বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যার ওপর দখলদারি যদি প্রশাসনের চোখের সামনেই ঘটতে পারে, তাহলে দূর কিশোরগঞ্জে ছোটখাটো নদীর ওপর হামলা কে দেখতে যাবে, কে রুখতে যাবে? কেনই বা রুখতে যাবে, যখন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও স্থানীয় প্রশাসনযন্ত্র কমবেশি জড়িত। নদীমাতৃক বাংলার প্রাণপ্রবাহ, যা অনেকটা মানবদেহের রক্তবহা নালির মতোই, তা যদি একের পর এক শুকিয়ে যেতে থাকে, তাহলে প্রধান স্রোতধারা টিকবে কিভাবে? সব কিছু দেখে এবং বুঝেশুনেও প্রশাসন কি তৎপর হবে না নদী দখল-বাণিজ্য বন্ধ করতে?
নদী দখল বন্ধ করা ছাড়াও এ লেখার আরো একটি উদ্দেশ্য সংখ্যালঘু সম্পত্তি দখলের অনাচার বন্ধে আরো সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানানো। হিন্দু সম্পত্তি তো বেশুমার দখল হয়েছে। এবার দেখা যাচ্ছে মন্দির, শ্মশান ও দেবোত্তর সম্পত্তি ছাড়িয়ে লোভের হাত খ্রিস্টানদের গির্জার ওপর। বরিশাল শহরে দুই একর ৫৩ শতাংশ সম্পত্তি বেদখল হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে স্থানীয় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ অনশনের আশ্রয় নিয়েছে। তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়েছে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের কিছুসংখ্যক মানুষ। উদ্দেশ্য কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। কথিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশের ভাবমূর্তি রক্ষায় সরকার নিশ্চয়ই সচেষ্ট হবে। তবে দেশের নদী রক্ষা করাও যে অতীব জরুরি- এ সত্যও তাদের মনে রাখতে হবে।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.