স্মরণ- অধ্যাপক ডা. ফজলুল করীম by ফজলুল আলম

বাবা-মায়ের তৃতীয় ছেলে ছিলেন ফজলুল করীম। স্কুলে আমাদের ছয় ভাই, এক বোন—সবাই ভালো রেজাল্ট করতাম। কিন্তু ফজলুল করীমকে প্রতিযোগিতামূলক স্কুলে দিতে আগ্রহী ছিলেন বাবা। তাঁর বদলির চাকরিতে প্রতিবছর স্কুল বদলানোর জন্য লেখাপড়ায় সমস্যা হতো।


অবশেষে সেজো ছেলের জন্য তিনি ফরিদপুরে এক দূর অথচ ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের সঙ্গে ছেলের থাকার ব্যবস্থা করলেন। সেখানকার জিলা স্কুলের হেড শিক্ষক ছিলেন কবি গোলাম মোস্তফা। তিনি ফজলুল করীমকে সাগ্রহে ভর্তি করে নিলেন। সে সময়টা ছিল দেশভাগের ও ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনের সময়। সেই স্কুল থেকে তিনি প্রথম ১০ জনের মধ্যে স্থান পেয়ে (১৯৪৬ সালে) পূর্ণ বৃত্তি নিয়ে ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান অনুষদে ভর্তি হন। তারপর আবার পূর্ণ বৃত্তি নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে, সেখানেও তিনি স্বর্ণপদকে ভূষিত হন। আমার মেজোভাই ফজলুল হক দেশভাগের পর কলকাতা ত্যাগ করে বাবার বগুড়ার বাড়িতে চলে আসেন এবং আজিজুল হক কলেজে ভর্তি হন। সেখানে অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি পান সৈয়দ মুজতবা আলীকে। বগুড়ায় থাকতেই তিনি দেশের সর্বপ্রথম চলচ্চিত্র পত্রিকা সিনেমা প্রকাশ শুরু করেন। দুই বছর পর ঢাকায় চলে আসেন। সে সময় পূর্ব বাংলায় চলচ্চিত্র আন্দোলনের পুরোভাগে তিনি ছিলেন এবং সর্বপ্রথম চলচ্চিত্র সাংবাদিক ও প্রকাশক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
অধ্যাপক এ বি এম ফজলুল করীম অসামান্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। ১৯৫৯ সালে তিনি কমনওয়েলথ স্কলারশিপে ইংল্যান্ডে ক্যানসার-সংক্রান্ত বিদ্যা অর্জনে যান এবং দ্রুত ডিপ্লোমা ইন রেডিওথেরাপি অর্জন করেন। ইংল্যান্ডের জেনারেল মেডিকেল কাউন্সিলের বিশেষ অনুমতিতে তিনি এক বছর পরই একই বিষয়ে ফেলোশিপ পরীক্ষায় বসার অনুমতি পান এবং সসম্মানে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি দেশে ফিরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে রেডিওথেরাপি বিভাগের প্রধান পদে অধিষ্ঠিত হন। নানা মহলের বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি অনুদান জোগাড় করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ক্যানসার রোগীদের রেডিওথেরাপি ট্রিটমেন্টের জন্য কোবাল্ট মেশিন স্থাপন করেন। তাঁকে মেশিন বাসাতে সাহায্য করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান অ্যাটোমিক এনার্জি কমিশনের একজন ইঞ্জিনিয়ারকে পাঠানো হয়েছিল। ঘটনাক্রমে এই ইঞ্জিনিয়ার নাসির আহমেদ (পরবর্তীতে অটোয়া কানাডা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট) ছিলেন আমাদের একমাত্র বোনের স্বামী। দুজনে মিলে মেশিনটি চালু করেন এবং বাংলাদেশে সর্বপ্রথম রেডিওথেরাপির মাধ্যমে ক্যানসারের চিকিৎসা শুরু হয় ১৯৬২ সালে। ফজলুল করীম নিজে মেশিন সেটিং ও অপারেট করতেন এবং একই সঙ্গে সদ্য যোগ দেওয়া টেকনিশিয়ানদের ট্রেনিং দিতেন।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থনের কারণে তাঁর বিরুদ্ধে রাজাকার ও প্রো-পাকিস্তানি চিকিৎসকেরা ষড়যন্ত্র চালালে তিনি কোনোক্রমে পরিবারসহ তেহরানে পালিয়ে যান। সেখানে মাসুদুজ্জামান নামক এক চিকিৎসক বন্ধুর (পরে ইংল্যান্ডে উলভারহ্যাম্পটন হাসপাতালের প্রথম বাঙালি কনসালটেন্ট হয়েছিলেন তিনি, দ্বিতীয় বাঙালি কনসালটেন্ট ছিলেন ওয়ালসাল হাসপাতালের নুরুজ্জামান) সহযোগিতাও পান।
১৯৭২ সালে তিনি হল্যান্ডে ভ্রিজ ইউনিভার্সিটির টিচিং হাসপাতালে ভালো অফার পান এবং সেখানেই তিনি সুদীর্ঘ ৩০ বছর কাটান। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক কর্মজীবন শেষ হয় ২০০২ সালে। সেখানেও তিনি নাম করেন এবং প্রচুর গবেষণা করেন। তাঁর গবেষণার ফল ও রচনা ক্যানসার, ল্যানসেট ও নেচার—এই তিনটি জার্নালে প্রকাশিত হতো এবং স্প্রিংগার ভারলাগ তাঁর গবেষণাগ্রন্থ গ্লিয়োমা প্রকাশ করে। তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদেও উন্নীত হন। তিনিই সম্ভবত ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি টিচিং হাসপাতালের প্রথম বাঙালি অধ্যাপক ছিলেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেডিওথেরাপি মেশিন স্থাপন করার আগেই ফজলুল করীম লিখে যাচ্ছিলেন যে মরণব্যাধি ক্যানসার সারানো যায়। ২০০৩ সালে তাঁর সহজ করে লেখা ‘ক্যানসার: মৃত্যু অবধারিত নয়’ (সময় প্রকাশনা) পড়ে অনেকেই উপকৃত হয়েছেন। তাঁর মেজোভাই ফজলুল হকের সিনেমা পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন এবং হল্যান্ড থেকে রিটায়ার করে দেশে এসে আবার সৃজনশীল লেখায় মনোনিবেশ করেন। এর মধ্যেই তাঁর উপন্যাস, গল্প প্রকাশিত হয়েছে অনেক। তাঁর একটা উপন্যাস নিয়ে চ্যানেল আই চলচ্চিত্র তৈরি করবে বলেছে। তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ এক জীবনের রূপকথা (অনন্যা ২০১০) ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছে।
ফজলুল করীম জীবনের সর্বাপেক্ষা বড় অবদান রেখেছেন কয়েকটি কথা বারবার বলে যে ক্যানসারে ভয় পাবেন না, মিছামিছি বিদেশে যাবেন না (দরকার হলে আমরাই যেতে বলব), ক্যানসার নিরাময় হয়। বাংলাদেশে প্রথম ক্যানসার বিশেষজ্ঞদের নিয়ে অনকোলজি ক্লাব স্থাপন করার কৃতিত্ব বহুলাংশে তাঁর। তা ছাড়া, ক্যানসার হাসপাতাল স্থাপনেও তিনি বিশেষ অবদান রেখেছেন। তাঁর হাতে ভালো হয়ে যাওয়া নারী-পুরুষ রোগীর সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গেছে এবং তাঁর কাছ থেকে প্রশিক্ষিত ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও বাংলাদেশে কম নয়। তিন বছর আগে তিনি অনকোলজি ক্লাব থেকে দুস্থ কয়েকজন নারীকে ক্যানসারের টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন, যাতে তাঁরা জরায়ুর ক্যানসারে আক্রান্ত না হন। এই গবেষণা এখনো চলছে। এ ধরনের আরও অনেক উদ্যোগ তিনি নিয়েছেন। পৃথিবীর এক নম্বর মরণব্যাধি নিয়ন্ত্রিণ করতে আরও অনেক উদ্যোগ দরকার, জাতীয়ভাবে ও আন্তর্জাতিকভাবে —সেটা তিনি করার প্রয়াস নিয়েছেন সারা জীবন। কিন্তু সব কাজ একা কেউ করতে পারে না, তাঁর না করা কাজগুলো করে ফেলার দায়িত্ব বর্তাল এই নতুন আনকোলজিস্টদের হাতে।
ফজলুল আলম

No comments

Powered by Blogger.