ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্যান্য by ইকবাল আজিজ

যে শান্তি, উন্নয়ন, কল্যাণ ও ঐক্যের লক্ষ্য নিয়ে একদিন ইউরোপীয় ইউনিয়ন যাত্রা শুরু করেছিল অনেক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে; অবশেষে তার পথ চলার স্বীকৃতি পাওয়া গেছে। একটি শান্তিপূর্ণ ইউরোপ গড়ার ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনের স্বীকৃতি হিসেবে এবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন পেয়েছে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার।


ইউরোপের প্রতিটি শান্তিকামী মানুষ এ পুরস্কারের গৌরবময় অংশীদার। একসময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের কথা কল্পনা করা যেত না। প্রায় এর সহস্র বছরেরও বেশি সময় ধরে ইউরোপের ছোট বড় নানা রাষ্ট্রের মধ্যে অশান্তি, অবিশ্বাস ও যুদ্ধ ছিল একটি স্বাভাবিক ঘটনা। অনেক রাষ্ট্রেই রাজতন্ত্র ছিল অত্যাচারী, হিংস্র ও যুদ্ধবাজ। নিজেদের ক্ষমতাকে সুসংহত করার স্বার্থে শাসকশ্রেণী সারা ইউরোপকে প্রায়শই পরিণত করতেন যুদ্ধক্ষেত্রে। তবে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া স্পেনসহ ইউরোপের ছোট বড় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যুদ্ধ, কূটনীতি ও দ্বন্দ্বের পাশাপাশি একে অপরকে জানার আগ্রহ ছিল প্রচুর। বিশেষ করে এসব দেশের সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, ইতিহাস, দর্শন ও বিজ্ঞানচর্চার উৎকর্ষ একটি ‘ইউরোপীয় কল্যাণকামী বোধ’ সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছিল। তবে শাসকশ্রেণীর সঙ্কীর্ণতা ও রাজনৈতিক বিরোধিতা ঐক্যবদ্ধ ইউরোপের ধারণার সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারণে-অকারণে বহুবার ইউরোপে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে। যুদ্ধের কারণে লাখ লাখ নিরপরাধ নারী, শিশু ও পুরুষের মৃত্যু হয়েছে। হিংসা ও দ্বন্দ্বে ক্ষত-বিক্ষত ইউরোপ এখন একটি কার্যকর ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন’ গড়ার পথে অনেকটা অগ্রসর হয়েছে। যদিও তাদের সমস্যার শেষ নেই; কিন্তু জনগণের মধ্যে শান্তি, কল্যাণ ও মমত্ববোধ গড়ার ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখন রীতিমতো সাফল্যের প্রতীক। সেই তুলনায় আমাদের দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা সংস্থা ‘সার্ক’ কেবল একটি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান; নানা ক্ষেত্রে এর ব্যর্থতা এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা জোরদারের ক্ষেত্রে হতাশার সৃষ্টি করেছে।
মাত্র কিছুকাল আগেও সাবেক যুগোসভিয়ার কসভোতে যে সংঘাত ও অশান্তি ছিল, তা এখন আর নেই। ইউরোপে জাতিগত যুদ্ধ ও সংঘাত এখন অতীতের বিষয়; এসব দেশে শান্তি ও মৈত্রী স্থাপনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন অনেকখানি কার্যকর ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয়েছে। দীর্ঘকাল ধরে যে, জার্মানি ও ফ্রান্স ছিল একে অপরের ঘোর দুশমন; তারা এখন ইউরোপে শান্তি ও মৈত্রীরু অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। উল্লেখ্য, ১৯৯৩ সালে ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন’ প্রতিষ্ঠায় সে সময়ের জার্মান চ্যান্সেলর হেলমুট কোহল ও ফরাসী প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি। ওই বছরই স্বাক্ষরিত মাসট্রিখট চুক্তির আওতায় ‘ইইউ’ গড়ে উঠেছিল। পরবর্তী বছরগুলোতে ক্ষমতা, কলেবর ও আওতা বেড়ে এর সদস্য সংখ্যা বর্তমানে ২৭-এ দাঁড়িয়েছে। সদস্য দেশগুলোর আলোচনার ভিত্তিতে নেয়া আন্তঃসরকার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পরিচালিত হয়। এর গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে ইউরোপিয়ান কমিশন, ইউরোপিয়ান কাউন্সিল, কোর্ট অব জাস্টিস অব দ্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক। একটি শক্তিশালী পার্লামেন্টও রয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের। সদস্য দেশগুলোর জনগণের ভোটে প্রতি ৫ বছর অন্তর নির্বাচিত হয় ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মৈত্রীর অভিন্ন প্রতীক হয়ে ইউরোপের ১৭টি সদস্য রাষ্ট্রে চালু রয়েছে অভিন্ন মুদ্রা ‘ইউরো’। অন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলো অবশ্য এখনও তাদের দেশে ‘ইউরো’ চালু করেনি। তবে ইউরোপে শান্তি, কল্যাণ ও সহযোগিতার মনোভাব যেভাবে জোরদার হয়েছে, তাতে দু’এক বছরের মধ্যে এসব দেশেও ‘ইউরো’ চালু হবে; ইতিহাসের সুনির্দিষ্ট গতিকে কেউ অন্যদিকে ফেরাতে পারবে না বলে ধরিণা করা যায়। কারণ বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রয়েছে সর্ববৃহৎ অভিন্ন বাজার। ক্রেতা-বিক্রেতা, পণ্য, সেবা ও পুঁজির অবাধ প্রবাহ রয়েছে এই বাজারে। বিশ্বের অন্য যে কোন অঞ্চলের জন্যই এসব ব্যবস্থা এখনও কল্পনাতীত। স্বরাষ্ট্র ও বিচার ব্যবস্থায় রয়েছে সদস্য দেশগুলোর অভিন্ন আইন। কৃষি, বাণিজ্য, মৎস্য সম্পদ ও আঞ্চলিক উন্নয়নের একই নীতি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের লোকসংখ্যা বর্তমানে ৫০ কোটিরও বেশি। বিশ্বের জিডিপিতে বর্তমানে ইইউর অবদান প্রায় ২০ শতাংশ।
বস্তুত একবিংশ শতকের প্রথম দশক পার হয়ে ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন’ সারাবিশ্বে সহযোগিতা ও শান্তির যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা দক্ষিণ এশিয়ায় সার্কভুক্ত দেশগুলোর জন্য প্রেরণার একটি বড় উৎস হতে পারে। শুধু শাসকদের আধিপত্যবাদী ও স্বেচ্ছাচারী মানসিকতার কারণে বিগত শতাব্দীতে ইউরোপে দু’টি বিশ্বযুদ্ধে কয়েক কোটি লোকের মৃত্যু হয়েছে, অসংখ্য ঘরবাড়ি ও কলকারখানা বিধ্বস্ত হয়েছে। সেখানে বছরের পর বছর যুদ্ধ চলেছে; সেদিন ইউরোপের ঘরে ঘরে কান্নার রোল উঠেছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানে শান্তি নিশ্চিত হয়েছে; সেখানে আগামীতে ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগে শান্তিবাদী আন্দোলন আরও জোরদার হবে। ইউরোপ বর্তমানে অনেকাংশে দারিদ্র্যমুক্ত; আগামীতে এমন এক গভীর শান্তিপূর্ণ ও মঙ্গলময় ইউরোপ গড়ে উঠবে যেখানে কোন অন্যায় ও অবিচার থাকবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি তার বর্তমান উন্নয়নমূলক ও কল্যাণমূলক কার্যক্রম অব্যাহত রাখে; তবে আগামীতে তারা দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শান্তিস্থাপন ও উন্নয়নে অনেক বেশি অবদান রাখতে সক্ষম হবে। তাই ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন’কে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান এ সময়ের একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা।
মাত্র কয়েক বছরে ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন’ যেভাবে এগিয়ে গেছে, তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। আসলে ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দ নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ ভুলে ইউরোপীয় জনগণের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন; তারা বৃহত্তর ইউরোপীয় কল্যাণের বিষয়টিকে সবার উপরে স্থান দিয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিন্ন মুদ্রা ‘ইউরো’ ইউরোপের ১৭টি দেশের জীবনযাপনকে বদলে দিয়েছে। অভিন্ন মুদ্রা ‘ইউরো’ সঙ্গে নিয়ে ইউরোপ ভ্রমণ এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি সহজতর হয়েছে। অভিন্ন সার্কমুদ্রা চালু হলে এ অঞ্চলের মানুষ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার সুফল অনেক বেশি ভোগ করবে।
বস্তুত আধুনিক বিশ্বে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার কোন বিকল্প নেই। ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন’ বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় আর কতকাল অবিশ্বাস ? সার্কভুক্ত দেশগুলো কবে শান্তি, কল্যাণ ও বন্ধুত্বের মন্ত্রে আরও উজ্জীবিত হবে? ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন’ আমাদেরকে এসব বিষয়ে ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে। ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার’ বিজয়ী ইউরোপীয় ইউনিয়নকে অভিনন্দন।

No comments

Powered by Blogger.