আসলেই তারা গণদুশমন... by লে. কর্নেল কাজী সেলিমউদ্দিন (অব)

জনকণ্ঠ ৮ সেটেম্বর, ২০১২ সংখ্যায় ‘এক নম্বর গণদুশমনদের পরাস্ত করুন’ শিরোনামে প্রকাশিত নিবন্ধে আমি আমাদের প্রতিদিনকার খাদ্যে বিষ মিশ্রণের কারণে ভবিষ্যতে জাতির ভয়ানক দুর্দশার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছি।


তাতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণপূর্বক এর প্রতিকারে অবিলম্বে ও বিলম্বে গ্রহণীয় প্রস্তাব করা হয়েছে। তাতে আরও উল্লেখ করা হয় যে, নাগরিক হিসেবে এ ব্যাপারে আমাদেরও কর্তব্য রয়েছে। এ প্রবন্ধে আলোচ্য সঙ্কট মোকাবেলায় সম্ভাব্য করণীয় সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করা হচ্ছে
১. সংবাদ মাধ্যম : এঁরা জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্যে, খাদ্যে ভেজাল প্রয়োগের সব দিক প্রচার করছেন। এতে উল্লেখযোগ্য গণসচেতনতাও সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এ সচেতনতাকে নিরাপদ খাদ্য লাভের গণদাবিতে পরিণত করতে হলে আরও কিছু করণীয় রয়েছে। ছবি এবং লেখনী আরও আকর্ষণীয়, তথ্যপূর্ণ, মনোগ্রাহী, সংবেদনশীল এবং নিয়মিত হতে পারে।
২. ব্যবসা ও বাণিজ্য সংস্থা : উৎপাদক, প্রস্তুতকারক, পাইকারি ব্যবসায়ী, খুচরা বিক্রেতা, এমনকি ফুটপাথ দোকানি সবাই ব্যবসায়ী। কৃষি উৎপাদনে অতিমাত্রায় বিষ প্রয়োগ, মিল-কারখানা ও বিভিন্ন বিক্রয় পর্যায়ে খাদ্যে ভেজাল হিসেবে বিষ ব্যবহার সব দায়িত্ব তাঁদের। জাতীয় অস্তিত্ব বিপন্নকারী এহেন মুনাফার লিপ্সা অবশ্যই সংযত এবং প্রতিহত করতে হবে। সব ব্যবসায়ীই মুনাফালিপ্সু নয়, তবে অনেকেই অনুরূপ। ব্যবসায়ী সম্প্রদায় যাতে বিধি-বিধান, নৈতিকতা অনুসরণ করে তা নিশ্চিতের দায়িত্ব তাদের সমিতি ও বাণিজ্য এবং শিল্প সংস্থাদির। সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ঢাকা শহরে একটি বাজারে ফরমালিন ও কার্বাইড পরীক্ষা কিট সরবরাহ করেছে। কিন্তু গোটা জাতি মারাত্মক যে দুর্দশার মুখোমুখি তার মোকাবেলায় এ উদ্যোগ খুবই নগণ্য। তাদের আরও বিশাল ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের ভূমিকা উৎপাদন পর্যায় থেকে খুচরা বিক্রয় পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়া দরকার। শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিষাক্ত বর্জ্য বিষমুক্ত করেই পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়ার বিষয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্য করা, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে উন্নত দেশসমূহের ব্যবহার-নিষিদ্ধ রাসায়নিক দ্রব্যাদি খাদ্যপণ্যে না মেশানো এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে ব্যবহার উপযোগী রাসায়নিকদ্রব্য ব্যবহারে অবশ্যই অনুমোদিত মাত্রাসীমার মধ্যে থাকা বিষয় নিশ্চিত করা, দেশের হাটে বাজারে তরি-তরকারি, ফল-ফলাদি, মাছ ইত্যাদি বিষাক্ত রাসায়নিক মিশ্রিত কিনা তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সক্ষমতা উন্নয়ন, স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং হাটবাজার কমিটিগুলোকে সম্পৃক্ত করে এই দায়িত্ব ন্যস্ত করা যেতে পারে। এফবিসিসিআইয়ের গৃহীত উদ্যোগটি আপাতত প্রধান প্রধান শহরের বাজারগুলোতে সম্প্রসারিত করা যেতে পারে; যাদের দায়িত্ব হবে ‘নিরাপদ খাদ্য’ বিষয় সরকারের বিবেচনার ।
৩. ছাত্রসমাজ : ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং উনিশ শতকের প্রথমদিকে একনায়কত্ব বিরোধী আন্দোলনে গৌরবময় অগ্রণী ভূমিকা ছাত্রদের ছিল। এসব আন্দোলনে তারা নেতৃত্ব প্রদান এবং বীরোচিত ভূমিকা পালন করে। আমরা ছাত্রনেতৃত্ব ছাড়া কোন আন্দোলন কল্পনাও করতে পারি না। তাদের প্রতি অনুরোধ, তারা আপন দ্বিধাবস্থা থেকে বের হয়ে আসবে এবং আমাদেরকে ধীরক্রিয়াশীল বিষপ্রয়োগের কবল থেকে রক্ষা করবে, জাতিকে মানসিক এবং শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থেকে বাঁচানোর জাতীয় দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হবে। নিজেরা সংগঠিত হবে এবং প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিরাপদ খাদ্যের দাবিতে সোচ্চার হবে।
৪. বেসরকারি সংস্থাসমূহ : তারা জাতি গঠনে উল্লেখযোগ্য সেবা দিয়েছে এবং দিচ্ছে। তারা তৃণমূল পর্যায়ে কর্মরত থেকে দারিদ্র্য বিমোচন, শিশুমৃত্যুর হার হৃাস, নিরক্ষরতা নিরসন, পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম বাস্তবায়ন ইত্যাদিতে সরকারকে সহযোগিতা করছে। তাদের উচিত সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়ে নিরাপদ খাদ্য প্রকল্প গ্রহণ করা, তাদের কর্তৃত্বাধীন উপায় উপকরণাদি রাসায়নিক ব্যবহার এবং ভেজালমিশ্রিত আমাদের প্রাত্যহিক খাদ্যের ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা, তাদেরকে অনুরূপ খাদ্য বর্জন করতে উদ্বুদ্ধ করা, তরি-তরকারি ও ফলের বিষ নষ্ট করার পদ্ধতি শিক্ষা দেয়া, ভূমিতে রাসায়নিক সার ব্যবহারের দরুন আমাদের ওপর এর গড় ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া প্রচার করা, রাসায়নিক কীটনাশক ওষুধের বদলে ফসলের কীট ও মড়ক প্রতিরোধক ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করা এবং কৃষক আপন কৃষিক্ষেতে নির্বিচারে অতিমাত্রায় রাসায়নিকদ্রব্য প্রয়োগের মাধ্যমে জাতির কী পরিমাণ ক্ষতি সাধন করছে, তা প্রচারের কাজে ব্যবহার করা। সর্বোপরি কৃষকবান্ধব ব্যবহারোপযোগী অধিক লাভজনক এবং ব্যয়সাধ্য রাসায়নিক বিকল্প প্রচলন করা।
৫. রাজনৈতিকদলসমূহ : সরকারী, বেসরকারী, বড়-ছোট, মতাদর্শে ভিন্ন সব রাজনীতিক জনগণের সেবায় কাজ করছেন। কিন্তু জাতির আলোচ্য দুর্দশার মুহূর্তে তারা সুস্পষ্টভাবে নীরব। জনগণ তাদের কাছে আশা করে তারা আলোচ্য এক নম্বর জাতীয় শত্রুদের পরাভূত করার কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন এবং জনগণের নিরাপদ খাদ্য লাভের অধিকারের দাবি আদায়ে কাজ করবে। অনিরাপদ খাবারের মাধ্যমে নীরব গণহত্যা বন্ধের জন্য তাদেরকে সরকারের নিকট দাবি উত্থাপন করা উচিত। কিন্তু হায়! রাজনীতিকদের এ বিষয়ে কথা বলার সময় নেই। তাদের প্রতি আমাদের অনুরোধ, স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে অসহায় জনগণের সাহায্যে এগিয়ে আসুন।
৬. সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী সংগঠন : শিক্ষক, কৃষক, ডাক্তার, আইনজীবী, প্রকৌশলী, শ্রমজীবী, পেশাজীবী সংগঠন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংস্থা, সমিতিসমূহ সবারই এ ব্যাপারে বিরাট কর্তব্য রয়েছে; তারা আপন আপন সদস্য ও জনগণকে নিরাপদ খাদ্য লাভের দাবিতে এমনভাবে সচেতন ও সোচ্চার করতে পারে, যাতে দেশময় এই দাবি উচ্চারিত হয়। ভোক্তা সমিতি, পরিবেশ এবং মানবাধিকার সমিতিসমূহ এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। আশা করি তাদের কার্যক্রম অচিরেই জেলা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে।
৭. উপাসনালয় এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানাদি : সম্মানীয় ইমাম, পাদ্রী, পীর, বিভিন্ন দরবার এবং আলেম সবারই জনসাধারণের ওপর বিরাট প্রভাব রয়েছে, পাশাপাশি রয়েছে ধর্মীয় বিধানে খাদ্যে ভেজালদাতার জন্য পাপের ঘোষণা। তাদের কাছে অনুরোধ মানুষের খাদ্য, তরিতরকারি, ফলমূল, দুধ, মাছ প্রভৃতিতে বিষ প্রয়োগের মতো পাপকার্যের সঙ্গে জড়িতদেরকে তা থেকে বিরত রাখার জন্য ব্যক্তিগতভাবে সচেষ্ট থাকবেন। তাবলিগ জামাত এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে।
৮. জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশ : এটা এখনও গঠন পর্যায়ে রয়েছে; তারা নানাবিধ মানব সম্পদ ও অর্থ সম্পদের অপ্রতুলতার মধ্যে কাজ করছে। তা সত্ত্বেও আমাদের নিরাপদ খাদ্যের অধিকার মারাত্মক বর্বরতার শিকার বিধায় বিষয়টি তাদের কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কমিশনকে অনুরোধ করব। কারণ ওয়েবসাইটে দেয়া কার্যতালিকা অনুযায়ী ২০১৫ সাল পর্যন্ত নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি তাদের কর্মসূচীতে নেই।
আমাদের নিরাশ বা হতাশাগ্রস্ত হয়ে বসে থাকলে চলবে না। আকাশ থেকে এর কোন প্রতিকার আসবে না। মহৎ জাতীয় স্বার্থে এটা আমাদেরই যুদ্ধ। ’৭১-এর চেতনায় প্রদীপ্ত সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অবশ্যই আমরা আমাদের এক নম্বর দুশমনকে পরাভূত করতে পারবই পারব। নীরব গণহত্যা বন্ধের লক্ষ্যে রাসায়নিক সন্ত্রাস অবশ্যই রুখতে হবে।
আমাদের সব কর্মকা- অবশ্যই শান্তিপূর্ণ হবে। এ বছর জুন মাসে বিষাক্ত কীটনাশক মিশ্রিত লিচু খেয়ে দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁওয়ে ১৪ শিশু মারা গেছে। আসুন! আমরা প্রতিবছর ১৪ জুন তারিখে ‘বিষক্রিয়া দিবস’ পালন করি। আমাদের কেবল দু’টি বিকল্প রয়েছে বিজয় অথবা বিলুপ্তি। আসুন, বিষমুক্ত বাংলাদেশ গড়ি।

e-mail: bishmukto.bangladesh@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.