মধ্যপ্রাচ্য আগের চেহারায়আর থাকবে না by এনামুল হক

আগামী ৬ নবেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সে নির্বাচনে কে জিতবেন ওবামা না রমনি? সে প্রশ্নের জবাব এ মুহূর্তে মিলবে না। তবে একটা কথা নিশ্চিতভাবে বলা যাবে যে, যিনিই নির্বাচিত হয়ে আসুন না কেন তাঁর সামনে মধ্যপ্রাচ্য আর আগের চেহারা নিয়ে থাকবে না।


তিনি এক নতুন মধ্যপ্রাচ্যের সম্মুখীন হবেন। সেই মধ্যপ্রাচ্যের বাস্তবতা ও প্রেক্ষাপট হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
মার্কিন সাময়িকী ‘টাইম’-এ এক নিবন্ধে জো ক্লেইন এমন সম্ভাবনা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র স্থানীয় স্বৈরাচারীদের এক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত এমন দিন গত হয়ে গেছে। সেই অবস্থা ওবামা ও রমনি দু’জনের সামনেই রয়েছে। তবে দু’জনই ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেন তা। ‘সিক্সটি মিনিটস’ টিভি অনুষ্ঠানে ওবামা মধ্যপ্রাচ্যের এই আলোড়ন সম্পর্কে বলেছেন, ‘সামনে আমাদের বন্ধুর পথ। সে পথে অনেক ঝাঁকুনি খেতে হবে।’ লাঞ্ছিত, অবদমিত এবং শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর এই অঞ্চলটি মুক্তির দিকে অগ্রসর হওয়ার সুদীর্ঘ সংগ্রামে ব্রতী হয়েছে এমন ঘটনাটিকে তিনি আশাবাদ নিয়ে দেখেছেন। ভেবেছেন এই দেশগুলো এক নায়কতন্ত্রের শিকল ছিঁড়ে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা করবে। সে সম্ভাবনা যেমন আছে তেমনি গোটা অঞ্চলটি বিশৃঙ্খলা বিভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত হওয়ারও সমূহ আশঙ্কা বর্তমান। এ অবস্থায় এ অঞ্চলের জাতীয় সীমানাগুলোও নতুন করে নির্ধারিত হতে পারে, যেমনটি প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে ইউরোপীয়রা কল্পনা করেছিল।
অন্যদিকে রমনির মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ ও হতাশা আছে এবং সেই সঙ্গে আছে অতীতের স্মৃতি কাতরতা। তিনি বলেছেন, সম্প্রতি সেখানে এক মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিহত হয়েছেন। মিসরের নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুড ক্ষমতায় এসেছে। ইরান পরমাণু অস্ত্র করায়ত্ত করার অনেক কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
নতুন মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার যাত্রাপথ যথেষ্ট বন্ধুর ও ঝাঁকুনিপূর্ণ বলে উল্লেখ করলেও ওবামা সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার যে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন সেটাকে অতিশয়োক্তি বলে মনে করেন ক্লেইন। আবার রমনির বক্তব্যের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার আধিপত্যবাদী অতীত নিয়ে স্মৃতিকাতরতাও তার কাছে স্পষ্টতই অসঙ্গত মনে হয়েছে।
ক্লেইন এ প্রসঙ্গে রবার্ট কাপলানের “দি রিভেঞ্জ অব জিওগ্রাফি” নামে একটি নতুন গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন যে, সাবেক অটোমান সাম্রাজ্যকে কিভাবে বিভক্ত করা হবে সে প্রশ্নের এখনও কোন সমাধান পাওয়া যায়নি। কাপলান সেই বইয়ে এমন সম্ভাবনা তুলে ধরেছেন যে, এ অঞ্চলের মানচিত্রে যে স্পষ্ট ও সরল রেখার সীমান্ত দেখা যায় সেগুলো চিরস্থায়ী নাও হতে পারে। “আমরা নিশ্চিত নই কোন কোন ভূখ- নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা কার কার হাতে থাকবে এবং নতুন উপজাতীয় ও সাম্প্রদায়িক বিভাজনরেখা অনুযায়ী ভূখ-ের সীমানা চিহ্নিত করা হবে কিনা। দৃষ্টান্তস্বরূপ সিরিয়া ও ইরাক খুব পুরাতন দুই পৃথক কৃষি অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। তবে এসব সীমান্ত কখনই সুস্পষ্টরূপে চিহ্নিত করা হয়নি।”
বস্তুতপক্ষে ইরাক ছিল চার্চিলের উদ্ভট খেয়ালের ফসল। অটোমান সাম্রাজ্যের তিনটি ধনবান ও শক্তিশালী রাজ্যকে এক করে এটি গঠিত হয়। সম্প্রতি খবর বেরিয়েছে যে, ইরাকের সংখ্যালঘু সুন্নীরা সিরিয়ার সংখ্যাগুরু সুন্নী বিদ্রোহীদের সঙ্গে একই লক্ষ্যে সংঘবদ্ধ হওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। সিরিয়ায় আজ যে হত্যাযজ্ঞ চলছে তার ছয় বছর আগে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ বলেছিলেন যে, তিনি এই ভেবে উদ্বিগ্ন যে তাঁর দেশের কুর্দীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে ইরাকের আধা মুক্ত উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশের সঙ্গে যোগ দিয়ে বৃহত্তর কুর্দীস্তান গঠন করবে। এ ধরনের রাষ্ট্র গঠিত হলে ইরান ও তুরস্কের কুর্দীদের প্রতিক্রিয়া কি হবে কে জানে।
ভূমধ্যসাগর থেকে শুরু করে হিন্দুকুশ পর্বত পর্যন্ত বিস্তৃত এই মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলটিতে এই হলো যুক্তরাষ্ট্রের সামনে সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ। আফগানিস্তানের সমস্যারও শিকড় রয়েছে ১৮৯৩ সালে ব্রিটিশদের চিহ্নিত সীমান্ত রেখার মধ্যে। ঐ সীমান্ত রেখার দ্বারা কুর্দীস্তানের মতো একটি সুসংহত অঞ্চলকে আফগান অংশ ও পাকিস্তানী অংশ এই দুই খ-ে বিভক্ত করা হয়েছে। জর্দানের পাশে যে ভূখ-কে আমরা জানি সেটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের মিত্র হাশেমী রাজবংশকে দেয়া একটি উপহার। ইসরাইল রাষ্ট্রটিও পাশ্চাত্যের কল্পনাপ্রসূত যদিও এর প্রাচীন শিকড় এ অঞ্চলে নিহিত ছিল।

No comments

Powered by Blogger.