বিপাকে প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ

ফ্রান্সের রাজনীতির শীর্ষ মহলে ত্রিভুজ সম্পর্কের জটিলতা ছায়া বিস্তার করে আছে এবং জনমনে নানা ধরনের গুঞ্জনের কারণ ঘটিয়েছে। একদিকে সম্প্রতি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদে, অন্যদিকে তাঁর সঙ্গিনী ও ফার্স্টলেডি


ভ্যালেরি ট্রাইয়ারওয়েইলার এবং আরেক দিকে ওলাঁদের প্রাক্তন স্ত্রী ও জনমোহিনী রাজনীতিক সেগোলেন রয়াল যিনি ২০০৭ সালে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে গিয়েছিলেন। এই দুই রমণীর দ্বন্দ্বে মাঝখান থেকে ক্ষতবিক্ষত ও বিব্রত প্রেসিডেন্ট ওলাঁদে।
ওলাঁদে নির্বাচিত হওয়ার পর ট্রাইয়ারওয়েইলার একদিকে প্রেসিডেন্টের সঙ্গিনী ও অন্যদিকে পেশাগত সাংবাদিক এই দ্বিবিধ ভূমিকা পালনের উদ্যোগ নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন। তারপর জুন মাসে টুইটারে তাঁর একটি মন্তব্য ব্যাপক গুঞ্জনের কারণ ঘটায়। জনমনে এমন প্রশ্ন উঠে যে, এলিসি প্রাসাদে এসব হচ্ছেটা কি! এ তো রীতিমতো ‘ডালাস’ টিভি সিরিজের ফরাসী রূপ যেখানে আছে ক্ষমতার শীর্য মহলে ঈর্ষা, প্রতিহিংসা, দ্বন্দ্ব আর চক্রান্তের নাটকীয় সব ঘটনার সমাবেশ।
প্রেসিডেন্ট ওলাঁদের বয়স ৫৮ বছর। সমবয়সী নারী রয়ালের সঙ্গে তিনি তিন দশকের বেশি ঘর করেছেন। তাদের চার সন্তান। ২০০৫ সালের দিকে রয়াল সোশালিস্ট পার্টির একজন সিনিয়র রাজনীতিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এ সময় ওলাঁদ ট্রাইয়ারওয়েইলারের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং দু’জনের মধ্যে পরকীয়া চলতে থাকে। ট্রাইয়ারওয়েইলার সেসময় প্যারিস ম্যাচ পত্রিকার সাংবাদিক। দু’জনের প্রেমের কাহিনী রয়ালের কানে পৌঁছায়। রয়াল বাধা দেয়ার নানান চেষ্টা চালান। ট্রাইয়ারওয়েইলারকে পত্রিকা থেকে চাকরিচ্যুত করারও উদ্যোগ নেন। কিন্তু ওলাঁদ-ট্রাইয়ারওয়েইলারের প্রেম কোনভাবে ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। শেষে ওলাঁদ ও রয়াল ২০০৭ সালে তাদের ত্রিশ বছরের দাম্পত্য জীবনের অবসান আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন।
এদিকে রয়ালের দিক থেকে প্রেমে বাধা দেয়ার চেষ্টা ট্রাইয়ারওয়েইলার ভুলে যাননি। তাঁর বয়স ৪৭। এর আগে দুবার বিয়ে হয়েছে এবং দুবারই ডিভোর্স হয়েছে। বৈবাহিক সূত্রে তিন সন্তানের জননী তিনি। পরবর্তীকালে ওলাঁদের সঙ্গে প্রণয় এবং পরিণতিতে ফাস্টলেডীর মর্যাদা লাভ। বলাবাহুল্য ওলাঁদ ও ট্রাইয়ারওয়েইলার বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ নন। তবে তাদের সম্পর্ক আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হয়েছে।
গত ১২ জুন টুইটারে ট্রাইয়ারওয়েইলারের একটি মন্তব্য দেশজুড়ে সরস আলোচনা ও গুঞ্জনের জন্ম দেয়। তা থেকে পরিষ্কার হয়ে উঠে ওলাঁদে-ট্রাইয়ারওয়েইলার-রয়ালের সম্পর্ক ঘোরতর জটিলতার আবর্তে ঘুরপাক খেয়ে চলেছে এবং মাঝে মাঝে তা থেকে উদগীর্ণ হচ্ছে যত রকমের ক্লেদ। ট্রাইয়ারওয়েইলারের টুইটারে মন্তব্যটি ছিল একজন নির্বাচন প্রার্থীর প্রতি শুভেচ্ছা। ওলাঁদে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে আসেন মে মাসে। জুন মাসে হয় পার্লামেন্ট নির্বাচন। সোশালিস্ট পার্টির খ্যাতনামা রাজনীতিক ও ওলাঁদের প্রাক্তন স্ত্রী রয়াল নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সোশালিস্ট পার্টি থেকে বেরিয়ে যাওয়া একজন যিনি একনামে পরিচিত হওয়ার মতো কেউ নন। তাঁর নাম অলিভিয়ার ফালোরনি। এমনিতে ট্রাইয়ারওয়েইলারের টুইটার বার্তাটি ছিল বাহ্যত এক নির্দোষ ধরনের শুভেচ্ছা। তিনি কালোরনিকে শুভেচ্ছা কামনা করে বলেছিলেন যে, তাঁকে দোষারোপ করা যেতে পারে এ ধরনের কিছুই তিনি করেননি।
কিন্তু বাহ্যত ওই একটি মাত্র নির্দোষ বার্তাই বোমা ফাটানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। ফ্রান্সের এক নম্বর পরিবারটির ভেতর যে কি পরিমাণ হিংসা, দ্বেষ, বিরাগ, প্রতিশোধস্পৃহা জমা হয়ে আছে তা মুহূর্তে প্রকাশ হয়ে পড়ে। এ নিয়ে দেশজুড়ে ঢি ঢি পড়ে যায়। নানা গুঞ্জন, নানান কেচ্ছার জন্ম হয়। পুরনো প্রেমিকাদের ঝগড়ার ব্যাপারটা সহসা রাষ্ট্রের একটা বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এই সুযোগে বেশ একহাত নিয়ে নেয়। প্রধানমন্ত্রী ফার্স্টলেডির কাছ থেকে আরও বেশি সুবিবেচনার পরিচয় দাবি করেন। সামগ্রিকভাবে এসবের প্রভাব নির্বাচনের ওপর পড়ে। রয়াল ভোটযুদ্ধে হেরে যান। এই পরাজয়ের ফলে রয়ালের কাছে ওলাঁদের ঋণশোধ করা আর হলো না। প্রেসিডেন্ট পদে সোশালিস্ট দলের প্রার্থিতা লাভের জন্য ওলাঁদকে রয়ালের সমর্থন নিতে হয়েছিল। বিনিময়ে ওলাঁদে কথা দিয়েছিলেন তিনি রয়ালকে পার্লামেন্টের স্পীকার বানাবেন। তবে তার জন্য তাকে কোন একটি আসনে জিততে হবে। কিন্তু একটি টুইটার বার্তাই সবকিছু উল্টাপাল্টা করে দিল। রিপোর্টাররা ক্ষমতার শীর্ষ মহলে এই কাদা ছোড়াছুড়ির কাহিনী রসিয়ে রসিয়ে পরিবেশন করলেন। আর দুই নারীর ঝগড়াকে কেন্দ্র করে নিজের ব্যক্তিগত জীবনের এমন গোপন ঘটনাগুলো ফাঁস হয়ে পড়ায় লজ্জায় অপমানে অত্যন্ত বিব্রতকর অবস্থায় পড়লেন প্রেসিডেন্ট ওলাঁদে।
সেগোলেন রয়াল ওই টুইটকে পিঠে বিষ মাখানো ছুরির ফলা বিদ্ধ করার শামিল বলে অভিহিত করেছিলেন। আর ট্রাইয়ারওয়েলার? ওই টুইট দিয়ে তিনি এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছিলেন এবং সফলও হয়েছেন। রয়ালের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে তাঁর দীর্ঘ লালিত প্রতিহিংসা চরিতার্থ হয়েছে। তিনি ভুলে যাননি রয়ালই একবার তাঁকে চাকরিচ্যুত করার চেষ্টা করেছিলেন। শুধু তাই নয়, ২০০৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় রয়াল যখন প্রার্থী তখন তাঁর দিকে ওলাঁদে ঝুঁকে পড়েছিলেন বলে তার মনে হয়েছিল। আর সাম্প্রতিককালের গোপন সমঝোতা তো আছেই। সুতরাং টুইটারের ওই বার্তা দিয়ে ওলাঁদেকেও চপেটাঘাত করা হয়েছে, যা আপাতত হজম করে যাওয়া ছাড়া তাঁর উপায় নেই।
ফ্রান্সের রাজনীতিতে এই ত্রিমুখী সম্পর্ক ও তার পরিণতির ওপর নতুন তিনটি বই বেরিয়েছে। বইগুলো প্রভাবশালী রাজনৈতিক সাংবাদিকদের রচিত। একটির নাম এনত্রে ডিউক্স ফিউক্স, দ্বিতীয়টির নাম লাএক্স এবং অপরটির নাম লা ফেভারিট। তিনটি বইয়েই বলা হয়েছে যে, গত দুটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে এই ত্রিমুখী সম্পর্কের ভূমিকা কম কিছু ছিল না। যেমন ট্রাইয়ারওয়েইলারের সঙ্গে গোপন প্রণয়ের কারণে ওলাঁদেকে হেনস্তা করার জন্যই রয়াল ২০০৭ সালের নির্বাচনে সারকোজির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। নির্বাচনে তার ভরাডুবি ঘটবে নিশ্চিত জেনেও তিনি দলের মনোনয়ন নিয়েছিলেন যাতে এই ভরাডুবির দায়দায়িত্ব সোশালিস্ট পার্টির প্রধান হিসেবে ওলাঁদের ঘাড়ে বর্তায় এবং তার জন্য দলের কাছে তাঁকে হেনস্তা হতে হয়। এই নির্বাচনের পর ওলাঁদে রয়াল দাম্পত্য সম্পর্ক আনুষ্ঠানিকভাবে ছিন্ন হলেও তার বেশ আগেই দু’জনের সম্পর্কে শীতলভাব বিরাজ করার এবং ওলাঁদের জীবনে অন্য নারীর আগমনের কথা গুজব আকারে প্রকাশ পেয়েছিল এবং সারকোজির নির্বাচনী প্রচার কর্মীরা তা পুরোদমে কাজে লাগিয়েছিল। ২০০৬ এর অক্টোবরে নিউজউইক সাময়িকীতে ট্রাইয়ারওয়েইলারের নাম পর্যন্ত বেরিয়ে পড়েছিল। শুধু টুইটার দিয়েই ট্রাইয়ারওয়েইলার স্ক্যান্ডালের জন্ম দিয়েছেন তা নয়। নিজে দুই দশকেরও বেশি সাংবাদিকতা পেশায় জড়িত থাকা সত্ত্বেও এলিসি প্রাসাদে প্রবেশের পর ভোল পাল্টে সাংবাদিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন। তার বিভিন্ন আচার-আচরণ ও কথাবার্তায় ফ্রান্সের মানুষ রীতিমতো বিরক্ত। এক জনমত জরিপে দেখা যায় যে, ফ্রান্সের ৬৭ শতাংশ নরনারী তার সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করে।
চলমান ডেস্ক

No comments

Powered by Blogger.