শ্রদ্ধাঞ্জলি-দেদীপ্যমান দুটি নক্ষত্র by কামাল লোহানী

লেখক-সাংবাদিক ও গীতিকার আবিদুর রহমান; দুই. দেশের বরেণ্য-জনপ্রিয় শিল্পী বিদিত লাল দাস। তারা দু'জনই সঙ্গীতাঙ্গনের দেদীপ্যমান নক্ষত্র। তাদের দু'জনের মৃত্যুসংবাদ দারুণভাবে শোকাহত করেছে আমাদের। দু'জনই ছিলেন সংগ্রামী এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মানুষ।


লেখক, সাংবাদিক ও গীতিকার আবিদুর রহমান ছিলেন সফল শিল্পোদ্যোগীও। দেশে-বিদেশে আবিদুর রহমান নানাভাবে সমাদৃত হয়েছেন। বৈষয়িক অঙ্গনেও তার সাফল্য তাকে আরও বেগবান করেছে এবং তিনি বিত্তের মাধ্যমেও চিত্তকে সমৃদ্ধ করেছেন নিজের দেশপ্রেম, কল্যাণচিন্তা দিয়ে। বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি নিজ শক্তিতে চলতে-ফিরতে পারতেন না, তাকে হুইল চেয়ারের সাহায্য নিতে হতো।
আবিদুর রহমানের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় আজ থেকে প্রায় ৫৬ বছর আগে। আমি তখন সবে ফরিদপুরের প্রখ্যাত ধনাঢ্য-রাজনীতিবিদ ইউসুফ আলী চৌধুরীর (মোহন মিয়া) মালিকানাধীন পত্রিকা দৈনিক মিল্লাতে একজন সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগ দিয়েছি। তখন আবিদুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র। ছোটদের জন্য গল্প, কবিতা লেখা ছাড়াও সাহিত্যচর্চায় নিবেদিতপ্রাণ এক মানুষ। তিনি দৈনিক মিল্লাতের ছোটদের পাতা 'কিশোর দুনিয়া' চালাতেন। তখন এই শিশু বিভাগ পরিচালনার জন্য তিনি সম্মানী পেতেন ২৫ টাকা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান ছাত্রজীবন উত্তরণের পরপরই যেন সফলতার স্বর্ণদ্বারে উপনীত হয়েছিলেন। আমার মনে হয়, তিনি জীবনের প্রথম উজ্জ্বল পথরেখার সন্ধান পেলেন 'আকাশ আর মাটি' চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা এই বাণীচিত্রের কাহিনীটা ছিল আবিদুর রহমানের। যার চিত্রনাট্য করেছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের প্রবাদপুরুষ বিধায়ক ভট্টাচার্য। ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন দেশের তখনকার চলচ্চিত্রকার ফতেহ লোহানী। যদিও 'আসিয়া' তার প্রথম চিত্রপ্রয়াস, তবু 'আকাশ আর মাটি'ই প্রথম নির্মিত হয়েছিল। আবিদুর রহমানের সম্পৃক্ততা এভাবেই সিনেমা জগতের সঙ্গে। কিন্তু ছড়া, কবিতা এবং গল্প লেখার অভ্যাসটা ক্রমে সমৃদ্ধ হয়েছে। বাণিজ্যের পরে পিচ্ছিল পথে তিনি সতর্ক পায়ে হেঁটে হেঁটে সফলতার স্বর্ণদ্বার স্পর্শ করেছিলেন। যেদিকে তিনি তাকিয়েছেন, সেদিকেই সোনালি ফসল ফলিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবেও আবির্ভূত হলেন। তিনি তো গীতিকার ছিলেনই, কিন্তু দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ আবিদুর রহমান কত যে গান লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের কাল থেকে তার হিসাব নেই। শুধু লেখাই নয়, সুরে-পরিবেশনায় ধন্য হলেন প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখার্জির মতো গুণীজনের সানি্নধ্যে। অসংখ্য গান লিখেছেন যেমন, তেমনি গাইয়েছেন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পীদের দিয়ে। তাদের মধ্যে শ্যামল মিত্র, মান্না দে প্রমুখের নাম না করলে অপরাধ হবে। গান কেবল গাওয়াই নয়, তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে যে হৃদ্যতাপূর্ণ ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তা বর্ণনা দিয়ে বোঝানো যাবে না। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সুবাদেই তার কলকাতা যাওয়া এবং সেই সুবাদেই এমন গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠা। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা তপন মজুমদার ও খ্যাতিমান অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায়সহ বহুজনের সঙ্গে যে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তা ছিল ঈর্ষণীয়। মুক্তিযুদ্ধকালে আবিদুর রহমানের কাব্যিক অবদান এবং সুর-সঙ্গীতের মাধ্যমে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, কোনো সরকারই তার মূল্যায়ন করেনি। কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মানও জোটেনি এমন একজন গুণী লেখক-গীতিকার এমনকি লক্ষ্মীর বরপুত্র হিসেবেও।
সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের জ্ঞানার্জনে সমৃদ্ধ আবিদুর রহমান পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে ইংরেজি দৈনিক 'পিপল' প্রকাশ করলেও পরে ভাবলেন, মাতৃভাষা বাংলায়ও একটি পত্রিকা প্রকাশ করা প্রয়োজন। তিনি প্রকাশ করলেন 'গণবাংলা' দৈনিক হিসেবে। পাকিস্তানি দুঃশাসন, অর্থনৈতিক বৈষম্য, শোষণ-বঞ্চনা এবং সাধারণ মানুষের মনের দুঃখ-কষ্টের কথাগুলো তুলে ধরতেই এ দুটি দৈনিকের আত্মপ্রকাশ। যথার্থ সাংবাদিকতা এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে নানা লেখা ও প্রতিবেদনের মাধ্যমে জনগণের মনে স্থান করে নিলেও আবিদুর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রোষানলে পড়েছিলেন। তাই তো ১৯৭১-এর মার্চে বঙ্গবন্ধুর ডাক, অসহযোগ আন্দোলন এবং সর্বাত্মক যুদ্ধ করার প্রস্তুতি যখন শুরু হলো পূর্ববাংলার সব সংবাদপত্রে (দু'একটি বাদে) তখন ২৫ মার্চ রাতেই 'দি পিপল' ও 'গণবাংলা' অফিস পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিল সংবাদ ও ইত্তেফাকের সঙ্গে সঙ্গে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর রোষাগি্ন ঢাকায় কাগজ পুড়িয়ে দিতে পারলেও আবিদুর রহমানের দেশপ্রেম এবং বঞ্চনা-লাঞ্ছনা-অবমাননার বিরুদ্ধে ক্ষোভকে তো আর পোড়াতে পারেনি। তাই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই তিনি কলকাতা থেকে গণবাংলা সম্ভবত সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশ করেছিলেন।
দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর তিনি সংবাদপত্র প্রকাশে উদ্যোগী না হয়ে ব্যবসায়ে মনোনিবেশ করেন এবং লন্ডনে চলে যান। ব্যবসায় প্রবল সফলতার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ডড়ৎষফ ঞরসবং নামে ইংরেজি সাপ্তাহিক প্রকাশ করেন। যার সঙ্গে ভাষাসংগ্রামী এবং বিবিসি ভাষ্যকার-সাংবাদিক ফজলে লোহানীও এই প্রকাশনায় সম্পৃক্ত ছিলেন। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও ব্যবসায়ী সফলতা নিয়ে গড়ে উঠেছিল তার জীবন এবং বিত্ত।
আরেক বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী বিদিত লাল দাস। বিত্তশালী পরিবারের সন্তান। আদরে লালিত। সিলেটের লোকসঙ্গীতের ধারার সূত্র ধরে শিল্পীসত্তায় আবির্ভূত হলেন। গড়ে তুললেন 'বিদিত লাল দাস ও সহশিল্পীবৃন্দ' নামে একটি গোষ্ঠী। ষাটের দশকের শেষ দিকে তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন নানা গান গেয়ে। সিলেটের সীমানা ছাড়িয়ে দেশব্যাপী তার দলের নাম ছড়িয়ে পড়ল। তার সঙ্গীত পরিবেশনা গ্রহণযোগ্য হলো সাধারণ মানুষের কাছে। তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করলেন। দেশ ছাড়িয়ে যশস্বী শিল্পীর ডাক আসতে থাকল। তার সঙ্গী যারা ছিলেন তারাও গুণপনায় অতুলনীয় ছিলেন। এই দলে ছিলেন দেশের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দী, আকরামুল ইসলাম, হিমাংশু বিশ্বাস প্রমুখ।
'লাউয়ের আগাগো খাইলাম' গানটি সেকালে যে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল তা সত্যিই অতুলনীয়। এ গানটি বিদিত লাল, রাসবিহারী চক্রবর্তী, হিমাংশু গোস্বামীদের এক সমষ্টিগত রচনা বা সৃষ্টি। এ ছাড়া সিলেটের লোকসঙ্গীতকে যেভাবে তিনি গলায় তুলে নিয়েছিলেন তাই তাকে সম্যক পরিচিতি এনে দিয়েছিল। কিন্তু এই মহান শিল্পীর সৃষ্টিকে গ্রাহ্য করে তাকেও মূল্যায়ন করা হয়নি কোনোকালেও। মুক্তিযুদ্ধকালে বিদিত লাল ভারতে চলে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে দলকে সংগঠিত করতে চেষ্টা করেছেন। সঙ্গীতাঙ্গনে দৃঢ় পদক্ষেপে চলতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু আশির দশকে স্বৈরাচারের রোষানলে পড়তে হয়েছিল জমিজমা নিয়ে। দখল করতেও চেয়েছিল। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি অসুস্থ ছিলেন। আমার সঙ্গেও দেখা বছর তিন-চারেক আগে সিলেটের এক মতবিনিময় সভায়। তিনি মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সঙ্গীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ, সিলেটের সভাপতি ছিলেন।

কামাল লোহানী :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
 

No comments

Powered by Blogger.