বিচারাধীন বিষয়ে সতর্ক হয়ে কথাবার্তা বলুন ॥ মন্ত্রী এমপিসহ সবার প্রতি ট্রাইব্যুনাল -যুদ্ধাপরাধী বিচার

ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন বিষয়ে মন্ত্রী, এমপিসহ প্রসিকিউশন ও ডিফেন্সের আইনজীবীদের সতর্ক হয়ে কথা বলার আহ্বান জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। সোমবার ট্রাইব্যুনালের সদস্য বিচারপতি মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন এ মন্তব্য করেন।


একই ট্রাইব্যুনালে মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে সাফাই সাক্ষী হিসেবে তার ছেলে মাসুস সাঈদীর জবানবন্দী অনুষ্ঠিত হয়েছে।
অন্যদিকে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তা মনোয়ারা বেগমের জবানবন্দী ও জেরা শেষ হয়েছে। আজ আরেক তদন্ত কর্মকর্তা মোঃ রাজ্জাক খানের জবানবন্দী গ্রহণ করা হবে। মনোয়ারা বেগম জেরায় বলেন, আমি আক্কু চৌধুরীর কাছ থেকে জল্লাদখানা, বধ্যভূমি এবং মুসলিম বাজার বধ্যভূমির ভিডিওচিত্রের সিডি সংগ্রহ করেছি। চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএ ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জার্তিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ এই জেরা অনুষ্ঠিত হয়েছে। জেরার সময় আব্দুল কাদের মোল্লা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে দ্রুত হাসাপাতালে পাঠানোর নির্দেশ প্রদান করে ট্রাইব্যুনাল।
সতর্ক হওয়ার নির্দেশ
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন বিষয়ে মন্ত্রী, এমপিসহ প্রসিকিউশন ও ডিফেন্সের আইনজীবীদের সতর্ক হয়ে কথা বলার আহ্বান জানিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ নিজামুল হক নাসিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন এ মন্তব্য করেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে তার ছেলের মাসুদ বিন সাঈদীর জবানবন্দী দেয়ার শুরুতে কথা প্রসঙ্গে বিচারক এ কথা বলেন। সম্প্রতি ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে কয়েক জনের বিচার শেষ হচ্ছে এমন শিরোনামে বেশ কিছু জাতীয় পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে আদালত এ বিষয়ে সতর্ক হয়ে বক্তব্য দেয়ার জন্য বলে।
এ প্রসঙ্গে বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ট্রাইব্যুনালের আইনের সঙ্গে অনেকের যোগাযোগ নাই অথচ এ সম্পর্কে দেশে-বিদেশে অনেকেই মন্তব্য করছেন, যা দুঃখজনক। এ সময় তিনি মন্ত্রী এমপিসহ সকলকে ট্রাইব্যুনালের মামলা বিষয়ে বক্তব্য দিতে সতর্ক হওয়ার আহবান জানান। এ সময় প্রসিকিউশনের সৈয়দ হায়দার আলী, সুলতান মাহমুদ সীমনসহ প্রসিকিউশন ও ডিফেন্সের আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। বিচারাধীন বিষয়ে প্রসিকিউশন থেকে এমন কোন শব্দ উচ্চারণ করা হয়নি বলে দাবি করেন প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন।
জেরার মুখে কাদের
মোল্লা অসুস্থ

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতের ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা বিচারকার্যক্রম চলাকালে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ তাঁকে বারডেম হাসপাতালে পাঠানোর নির্দেশ দেয়।
ট্রাইব্যুনালের তাৎক্ষণিক নির্দেশ মতো কাদের মোল্লাকে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে নেয়া হয় বলে জানা গেছে। মঙ্গলবার জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মনোয়ারা বেগমের জেরা চলাকালে তার আইনজীবী কাদের মোল্লার অসুস্থতার কথা ট্রাইব্যুনালকে জানান।
এ সময় ট্রাইব্যুনাল-২-এর সদস্য বিচারক শাহিনুর ইসলাম বলেন, আপনার চিকিৎসার জন্য আমরা আদেশ দিয়েছি। আমাদের দেয়া আদশ মতো আপনাকে বারডেমে নেয়া হয়নি? কাদের মোল্লা বলেন, আমাকে বারডেমে নেয়া হয়নি। তিনি কাশিমপুর কারাগারে হার্টের চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা না থাকায় আমার চিকিৎসা হচ্ছে না। ওই সময় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান তাকে এজলাস কক্ষ থেকে নিচে নামিয়ে হাজতখানায় বসার ব্যবস্থা করতে বলেন। এবং জেলখানায় পাঠানোর জন্য বলেন।
কাদের মোল্লাকে হাজতখানায় নেয়ার পরে আসামি (ডিফেন্স) পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক উপস্থিত হয়ে আবারও বিষয়টি উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, মাননীয় আদালত কাশিমপুরে যেতে কমপক্ষে দুই ঘণ্টা সময়ের দরকার। এই সময়ের মাঝে ওনার কি হয় বলা যাচ্ছে না। তার যে কোন দুর্ঘনা ঘটতে পারে রাস্তায়। এর চেয়ে যদি আপনারা বলেন (বারডেম) হাসপাতালে ডাক্তারকে দেখানোর পরে নিয়ে যাক। আদালত জানতে চান কিভাবে? তখন রাজ্জাক বলেন গোলাম আযম ও সাঈদী এমন অসুস্থ হয়েছিলেন। এবং ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে তাদের সরাসরি চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল। এ সময় ট্রাইব্যুনাল তাকে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে নেয়ার লিখিত নির্দেশ দেন।
পরে তার অনুপস্থিতিতেই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মনোয়ারা বেগমকে জেরা করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী আব্দুস সোবহান তরফদার। আসামি পক্ষের আইনজীবীরা জেরায় তদন্ত কর্মকর্তা মনোয়ারা বেগম বলেন, আমি এই মামলার তদন্ত করিনি কিন্তু মোমেনার জবানবন্দী গ্রহণ করেছি। মোমেনার জবানবন্দীতে দোয়ারীপাড়া গ্রাম উল্লেখ রয়েছে। তিনি বলেন, আমি তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে সাক্ষীদের জবানবন্দী রেকর্ড করেছি। এক্সপার্ট উইটনেস হিসেবে আমি এখানে বর্ণিত ১০ জনের মধ্যে ৭ জনকে পরীক্ষা করেছি। ভুক্তভোগী হিসেবে ৩ জনের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেছি। ভক্তভোগী ৩ জন হলেন- ফেরদৌসী বেগম ওরফে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনী, সখিনা হেলাল ও মোমেনা বেগম।
জবানবন্দী রেকর্ড করার সময় আমি শুনেছি মোমেনা বেগম বিবাহিত ছিলেন। আমি মোমেনা বেগমের জবানবন্দী রেকর্ড করার সময় তিনি তার স্বামীর নাম বলেছিলেন এবং সেইভাবে জেনেছি তিনি বিবাহিতা ও তাঁর পরিচয়পত্র দেখেও জেনেছি তিনি বিবাহিতা। এটা সত্য নয় যে, আমি যে মোমেনা বেগমকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি তিনি হাবিবুর রহমানের স্ত্রী নন বা শহীদ হযরত আলী লস্করের কন্যা নন।
এটা সত্য নয় যে, ১৯৭১ সালে মিরপুরের ১২নং সেকশনের ব্লক ডি-এর লেন-৫ এর ২১নং বাড়িটি মোমেনার বাবার ছিল না বা তারা সেখানে বসবাস করতেন না। এটা সত্য নয় যে, আমি শহীদ হযরত আলী লস্করের কন্যা হিসেবে যে ভুক্তভোগী মোমেনা বেগমের বক্তব্য লিপিবদ্ধ করেছি তিনি প্রকৃত মোমেনা বেগম নয় বা তিনি একজন ভুয়া মোমেনা বেগম।
এটা সত্য নয় যে, আমি রিকুইজিশন মোতাবেক সঠিকভাবে তদন্ত করিনি। এটা সত্য নয় যে, আমি ঘটনাস্থলে না গিয়ে অফিসে বসে মনগড়া জবানবন্দী লিপিবদ্ধ করেছি। আমি ১৯৭৭ সালে ১ আগস্ট সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে পুলিশ বিভাগে যোগদান করি। ৭৭ সালের ১ আগস্ট থেকে ৮৭ সালের ১ জুন পর্যন্ত আমি বিভিন্ন থানায় কর্মরত ছিলাম এবং কোর্টে সিএসআই হিসেবে কর্মরত ছিলাম।
আমি ৮৭ সালের ১ জুন থেকে সম্ভবত ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ঢাকা সিএমএম আদালতে কোর্ট ইন্সপেক্টর হিসেবে কাজ করি। তবে এর মধ্যে কিছু দিন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে ছিলাম এবং কিছু দিন রিজার্ভ অফিস ইন্সপেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। ঢাকা সিএমএম আদালতে কোর্ট ইন্সপেক্টর থাকাকালে ঢাকা নর্থ জিআর সেকশনের দায়িত্ব পালন করতাম এবং এসি প্রসিকিউশনের পক্ষে ঢাকা জজকোর্টের দায়িত্ব পালন করেছি। আমি এই মামলা সংশ্লিষ্ট কোন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করিনি। মূল তদন্ত কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। আমি আমার তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনাকালে যখন যা পেয়েছি তা যথাসময়ে মূল তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জমা দিয়েছি। এই মামলার সংশ্লিষ্টতায় তিনি কোন্গুলো ব্যবহার করেছেন সেটা তার ব্যাপার। তবে আমি আক্কু চৌধুরীর কাছ থেকে জল্লাদখানা, বধ্যভূমি এবং মুসলিম বাজার বধ্যভূমির ভিডিওচিত্রের সিডি সংগ্রহ করে তাকে দিই।
আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় আমি কিছু জমা দিইনি- কারণ প্রয়োজন ছিল না। আমার জবানবন্দী ওনি রেকর্ড করেছিলেন কি না তা আমি জানি না। এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আমাকে একবারই জিজ্ঞাসাবাদ করেছে তা সঠিক নয়। যেহেতু আমি ওনার রিকুইজিশন মূলে মামলাটির কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করেছি, সেহেতু প্রায়শই ওনার সাথে আমার মতবিনিময় হতো। আমি তাকে সময়ে সময়ে আমার কার্যক্রমের অগ্রগতি অবহিত করেছি।
এই মামলার একজন আংশিক তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে আমি সাক্ষ্য দিলাম। এটা সত্য নয় যে, আমি রিকুইজিশন মোতাবেক সঠিক তদন্ত করিনি। উল্লেখ্য, ২৮ মে আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে পৃথক ৬টি ঘটনায় অভিযোগ গঠন করা হয়। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে গত ১ নবেম্বর জমা দেয়া তদন্ত প্রতিবেদনে হত্যা, খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়।

No comments

Powered by Blogger.