‘আজীবন ফুটবলের সঙ্গে থাকতে চাই’ by সুজা উদ্দিন

বিকেএসপিতে যখন ভর্তি হন ভাবেননি ফুটবলে ক্যারিয়ার গড়ে এত দীর্ঘ সময় পার করবেন। কিন্তু পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলায় আকুণ্ঠ অবগাহন করে নিজের অজান্তেই তারকা খ্যাতি পেয়েছেন। সতীর্থদের সঙ্গে নিয়ে নিভু নিভু ফুটবলে মিটি মিটি আলো জ্বেলে রেখেছেন।


১৯৯৪ সাল থেকে ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করে মাতিয়েছেন বিভিন্ন বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে। ঘরোয়া ফুটবলে খেলেছেন দেশের সব বড় ক্লাবে। জাতীয় দলের হয়ে অংশ নিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আসরে। সময়ের প্রয়োজনে ও কালের অমোঘ নিয়মে নানা স্মৃতি ধারণ করা দীর্ঘ ১৮ বছরের বর্ণাঢ্য ফুটবল অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটালেন মুক্তিযোদ্ধার অধিনায়কত্বের মাধ্যমে। ৩৮ বছর বয়সী দেশসেরা ডিফেন্ডার ফিরোজ মাহমুদ টিটু ফুটবলে আজ শুধুই অতীত। গত ১৩ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধার হয়ে শেখ জামাল ধানম-ি ক্লাবের বিপক্ষে শেষ ম্যাচটি খেললেন। এরপর সবাইকে স্মুতির সাগরে ভাসিয়ে বুট তুলে রাখলেন সুটকেসে। তবে ফুটবলার থেকে অবসর নিলেও টিটু দূরে যেতে চাননা ফুটবল থেকে। তাই আবেগঘন বিদায় বেলায় দেশের ফুটবলকে জাগিয়ে তুলে হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে ছোটদের নিয়ে কাজ করতে চান তিনি। মাঠে আনতে চান আগামী প্রজন্মকে। ছোটদের জন্য একটি ফুটবল একাডেমি গড়ার পরিকল্পনা জানান প্রতিশ্রতিশীল এ সাবেক ফুটবলার। তার অবসর নেয়ার মুহূর্তটি আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ফুটবলারদের বুট তুলে রাখার সময় এমন অভিনন্দন এখন আর চোখে পড়ে না। সে হিসেবে টিটু নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবতেই পারেন। এদিন অধিনায়ক হয়ে মাঠে নামেন তিনি। ৩৭ মিনিটে আর্মব্যান্ডটা জহিরুলের হাতে বেঁধে দিয়ে যখন মাঠ ছাড়ছিলেন সতীর্থ ও প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়াড়রা তাকে জড়িয়ে ধরে, হ্যান্ডশেক করে অভিনন্দন জানান। এক পর্যায়ে ফুলের মালা পরিয়ে কাঁধে তুলে তাকে মাঠের বাইরে আনেন। এরপর বিভিন্ন ফুটবল সংগঠক, ক্লাব প্রতিনিধি ও সাবেক ফুটবলারদের ফুলেল বিদায়ী অভিনন্দনে সিক্ত হন। একসাথে লাল-সবুজ জার্সি গায়ে খেলা কাঞ্চন ও বিদ্যুতের কাঁধে হাত রেখে এদিন চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি টিটু। গ্যালারীর দর্শকদের উদ্দেশ্যে ফুলের মালা ছুড়ে তাদেরকেও অংশীদার করলেন এ মুহূর্তটির। অবশ্য এমন বেদনাদায়ক সময়টির জন্য টিটু প্রস্তুত ছিলেন না, ‘তিন বছর আগে থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম ফুটবল ছেড়ে দেয়ার। ইনজুরিতে পড়ায় তা অনিবার্য হয়ে গেল। তবে বিদায় বেলা এমন হবে ভবিনি। ঐদিনটার আগ পর্যন্ত মনকে মানিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমি মাঠ ছাড়ার সময় চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলাম না। ফুটবলকে ছেড়ে দিতে কষ্ট হচ্ছিল। আবেগেই কান্না চলে এসেছিল।’ জাতীয় দলের সাবেক স্ট্রাইকার সম্রাট হোসেন এমিলির রয়েছে টানা ছয় মৌসুম ঢাকা প্রিমিয়ার লীগ চ্যাম্পিয়ন দলে খেলার রেকর্ড (১৯৮৪-৮৬ আবাহনী ও ১৯৮৭-৮৯ মোহামেডানে)। টিটুর রেকর্ড তিনবার। অবশ্য ব্যতিক্রমী টিটু! তিন মৌসুম ভিন্ন দলে খেলেছেন। ২০০১ মৌসুমে আবাহনী, ২০০২এ মোহামেডান ও ২০০৩-২০০৪ সালে ব্রাদার্সের কমলা-বেগুনি জার্সি গায়ে চ্যাম্পিয়ন করেছেন দলকে। এরপর সেই যে মুক্তিযোদ্ধায় যোগ দিলেন, হয়ে গেলেন অলরেডদের ‘ঘরের ছেলে’। বাবাও একজন মুক্তিযোদ্ধা হওয়া টানটাও একটু যেন বেশি। তাই তো দলের দুর্দিনে ক্লাব বাঁচাতে সংগ্রাম করেছেন তিনি, খরচ করেছেন পকেটের পয়সা। গত মৌসুমের প্রথম দিকে দলের অধিনায়ক থাকলেও ইনজুরি বাঁধা ছিল তার। বাকি সময় খেলতে পারেননি। এ বছর ফেডারেশন কাপের প্রথম ম্যাচে খেলেননি। দ্বিতীয় ম্যাচে তাকে সম্মান দিয়েই কোচ শফিকুল ইসলাম মানিক তাকে আর্মব্যান্ড পরিয়ে মাঠে নামান। খেলাধুলায় ক্যারিয়ার গড়তে ১৯৯১ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি হন ফিরোজ মাহমুদ হোসেন টিটু। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত বিকেএসপিতে পড়ালেখা করেন। তিন বছর বিকেএসপির ছাত্র থেকে ১৯৯৪ সালে ইয়ংমেন্স ক্লাব দিয়ে ঢাকার ফুটবলে যাত্রা শুরু করেন। খেলোয়াড়ী জীবনে ধানম-ি (বর্তমান শেখ জামাল ধানম-ি ক্লাব), আরামবাগ, আবাহনী, মোহামেডান, ব্রাদার্স ও মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে ঘরোয়া ফুটবলের সর্বোচ্চ আসরে খেলেছেন। খেলেছেন অনুর্ধ-১৬, অনুর্ধ-১৯, অনুর্ধ-২০ ও অলিম্পিক দলেও। ঢাকার ফুটবলে দেড় যুগের ক্যারিয়ারে জাতীয় পতাকা খচিত জার্সি গায়ে চড়িয়েছেন ১০ বছর, ১৯৯৯ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত। ২০০৫এ কলম্বো এসএ গেমসে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক ছিলেন। ২০০৩এ ঢাকা সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য ছিলেন তিনি। ২০০৫এ পাকিস্তানের বিপক্ষে এশিয়া কাপ বাছাই পর্বে অসাধারণ একটা গোল রয়েছে তার। গোল রয়েছে ২০০১ নেহরু কাপে যুগোসেøাভিয়া বিপক্ষেও। রাইট ব্যাক হয়েও ভারত, হংকং, শ্রীলঙ্কা, ভুটানের বিপক্ষেও গোল করেছেন। নিজের ফুটবল ক্যারিয়ার শুরুর কথা মনে করতে গিয়ে টিটু বলেন, ‘বিকেএসপির কোচ ছিলেন অমল চন্দ্র বিশ্বাস। এখন অবসর নিয়েছেন। শারীরিক গঠন দেখে তিনিই আমাকে প্রথমে পছন্দ করেন। রাইটব্যাক খেলার পরামর্শ দেন। সেই থেকে আমি রাইট ব্যাক হিসেবে খেলছি।’ নিজের ফুটবল জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়ের কথাও স্মরণ করেন, ‘২০০৩ সালে সাফ ফুটবলের ফাইনালের কথা। ঢাকায় মালদ্বীপের বিপক্ষে ১-১ গোলে ড্রয়ের পর ম্যাচটি টাইব্রেকারে গড়ায়। ৫-৩ গোলে টাইব্রেকারের জিতে আমরা চ্যাম্পিয়ন হই। আনন্দে সে সময় চোখ দিয়ে কান্না বের হচ্ছিল। খুশিতে দৌড়াতে পারছিলাম না। সবাই আমার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ঐ মুহূর্তটি বার বার স্মরণ হয়। এখনও সে কথা মনে হলে ভাল লাগে। যুগোসøাভিয়ার বিপক্ষেও আমার গোলটি ছিল অসাধারণ।’ ফুটবল থেকে কি পেয়েছেন জানতে চাইলে টিটুর আত্মতুষ্টি উত্তর, ‘ফুটবল আমাকে পরিচিতি এনে দিয়েছে। গোছানো জীবন-যাপনে অভ্যন্ত করেছে। মানুষের ভালবাসা দিয়েছে। অন্য কোন ক্ষেত্রে হয়ত এতকিছু পেতাম না।’ ফুটবল ছাড়লেও মাঠের ভালবাসা ছাড়তে চান না টিটু। ফুটবল একাডেমী গড়ে খুদে ফুটবলারদের মাঠে আনার স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছেন তিনি। টিটুর প্রত্যয়দীপ্ত অভিব্যক্তি, ‘ফুটবল ছাড়া নিজেকে চিন্তা করি না। আজীবন ফুটবলের সঙ্গে থাকতে চাই। ফুটবলের উম্মাদনা ফেরাতে হলে ছোট ছোট ফুটবলারদের মাঠে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য ছোটদের নিয়ে কাজ করতে চাই। ফুটবলকে ছড়িয়ে দিতে হবে তৃণমূলে।’ নিজের পরিকল্পনা তুলে ধরে বলেন, ‘আমার মূল টার্গেট স্থানীয় একাডেমির মাধ্যমে বাচ্চাদের মাঠে আনা। কারণ ভিত তৈরি হয় ছোট বেলা থেকেই। একটা সংগঠনের মাধ্যমে সারাদেশে এটা করতে চাচ্ছি।’ তার এ কাজে সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে মনে করেন তিনি। ফুটবল জীবনে যাদের সঙ্গে মিশেছেন টিটুর স্মৃতিতে এখন ভেসে ওঠে তারা, ‘ক্লাবে যাদের সাথে একসঙ্গে থেকেছি, আড্ডা দিতাম, সবাইকে খুব মিস করি। বিশেষ করে বিকেএসপির সিনিয়র ভাইদের কথা মনে পড়ে। আমার সাথের কাঞ্চন, আলফাজ, হাসান আল মামুন, রজনী, শুভ্র এখনও খেলছেন।’ দেশের ফুটবল জনপ্রিয়তা হারানো ও মাঠে দর্শক না আসার জন্য তিনি মানুষের কর্মব্যস্ততাকে দায়ী করেন তিনি, ‘আগে এত কর্মব্যস্ততা ছিল না। জীবন চালাতে এখন একাধিক চাকরি করতে হয়। আগে এলাকাভিত্তিব বিভিন্ন টুর্নামেন্ট হতো। ফুটবলের জৌলুস থাকত। এখন স্থানীয় উদ্যোগ কমে গেছে। আর ছেলেরা মাঠে যাওয়ার চেয়ে ইনডোরে আড্ডা দেয়া, কম্পিউটারের সামনে বসে থাকা, পড়ালেখার চাপ তো আছেই।’ তবে আগের চেয়ে ফুটবলের মান যে কমে গেছে তা মানতে নারাজ তিনি, ‘এখনকার ফুটবলের ধরন পাল্টেছে, চ্যালেঞ্জ বেশি। তাই হঠাৎ করেই ভাল করা যায় না। এখন ফুটবল যে একেবারে খারাপ হচ্ছে বলা যাবে না। হয়ত প্রোপার ওয়েতে আমরা কাজ করছি না।’ দায়টা কিছুটা নিজেদের কাঁধে নিয়ে বলেন, ফুটবলের গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য তাদের উপরও কিছুটা দায়িত্ব ছিল। সেটা তারা ঠিকভাবে করতে পারেননি। অবশ্য এর পেছনে ফুটবলারদের ফিটনেস সমস্যা অন্যতম। মুক্তিযোদ্ধা পিতা আবুল হোসেন সিকদার ডক্টরেট ডিগ্রিধারী একজন সুশিক্ষিত। অতীশ দিপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির দায়িত্বে আছেন। টিটুও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসএস সম্পন্ন করে পরে এমবিএ করেছেন। এখন পিতার সাথে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি সদস্য ও পরিচালক হিসেবে আছেন বরগুনার কৃতী সন্তান। স্ত্রী শাহরিয়া জামান প্রোপা ও ৫ বছরের মেয়ে তাহসিন সুবাহ তারাসকাকে নিয়ে উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরে সুখেই আছেন।

No comments

Powered by Blogger.