এমএলএম-কার স্বার্থে এই আইন? by ফখরুুল ইসলাম

দেশে দেশে বহুস্তর বিপণন (এমএলএম) পদ্ধতিতে পণ্য কেনাবেচা যখন সরকারিভাবেই নিষিদ্ধ রয়েছে, বাংলাদেশে তখন এই পদ্ধতিটিকে দেওয়া হচ্ছে আইনি বৈধতা। নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য কিনতেই যে দেশের বেশির ভাগ মানুষের আয় ফুরিয়ে যায়, সেখানে বিতর্কিত পদ্ধতিতে অপ্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য করা হচ্ছে নতুন আইন।


প্রস্তাবিত এই আইনের নাম ‘ডিরেক্ট সেল আইন, ২০১২’। প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটি ইতিমধ্যেই আইনটির খসড়া অনুমোদন করেছে।
যেহেতু কোনো আইন নেই, সংগত কারণেই বলা যেতে পারে যে, এমএলএম পদ্ধতিতে পণ্য বিপণন বর্তমানে আইনবহির্ভূত অথবা বেআইনি। অথচ ৭০টি কোম্পানি এই পদ্ধতিতে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এরা নিবন্ধন নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (রেজসকো) থেকে। নিবন্ধন নেওয়ার সময় কোম্পানিগুলোর সংঘস্মারকে ‘এমএলএম পদ্ধতিতে ব্যবসা করতে পারবে’ বলে একটি লাইন রয়েছে শুধু। এটিই হলো এ ধরনের কোম্পানিগুলোর একমাত্র আইনি ভিত্তি। প্রশ্ন হলো, যে পদ্ধতিতে ব্যবসা করার কোনো আইনই নেই দেশে, সেই পদ্ধতিতে ব্যবসা পরিচালনার অনুমোদন দেওয়ার এখতিয়ার রেজসকোকে কে দিল?
এখন যে এমএলএম আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার, তার উদ্দেশ্যটাই বা কী? কাদের প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার জন্য করা হচ্ছে এই আইন? সরকার আবার কোনো ফাঁদে পা দিতে যাচ্ছে না তো? যখন ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সুইডেন, পোল্যান্ডসহ বিশ্বের ৫২টি দেশে এমএলএম পদ্ধতিতে পণ্য বিপণন নিষিদ্ধ!
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সংস্থা ফেডারেট ট্রেড কমিশন (এফটিসি) জনসাধারণকে এমএলএম কোম্পানির প্রতারণা থেকে সতর্ক থাকার জন্য ওয়েবসাইটে একটি পৃষ্ঠাই বরাদ্দ রেখেছে। এতে বলা আছে, ‘এমএলএম পদ্ধতিতে ব্যবসার অর্থ আসবে নতুন পরিবেশকের কাছ থেকে। যার পরিণতি অসংখ্য শূন্য হাত। যতই কোম্পানিগুলো বলুক না কেন, শেষের দিকের ব্যক্তিরাও লাভবান হবেন, প্রকৃতপক্ষে তা অবাস্তব।’
প্রতারণার দায়ে বিশ্বের বৃহৎ এমএলএম কোম্পানি দাবিদার এমওয়ের সব কার্যক্রম ২০১১ সালে বন্ধ করে দেয় ভারত সরকার। যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭৩ সালে ৮০ হাজার মানুষের সঙ্গে প্রতারণার দায়ে হলিডে ম্যাজিককে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। চীন, সুইডেন, পোল্যান্ড, শ্রীলঙ্কায়ও এ রকম উদাহরণ রয়েছে। চীনে এমএলএম কোম্পানি বন্ধের দাবিতে ১৯৯৮ সালে জনরোষ হয়, যা পরে দাঙ্গায় রূপান্তরিত হয়। এরপর ২০০৫ সালে শর্তসাপেক্ষে এমএলএম পদ্ধতিতে পণ্য বেচাকেনার অনুমতি দেয়। যেমন, শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী, ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজ্ঞ, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা ও সরকারি কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ।
ডেসটিনি, ইউনিপেটুইউ, নিউওয়ে, ডোলাঞ্চারসহ বাংলাদেশে যেসব এমএলএম কোম্পানির বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে, তাদের বেশির ভাগ গ্রাহকই (চীনে কেনাবেচায় নিষিদ্ধ ঘোষিত শ্রেণী) নিরীহ ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকেরা। অথচ আমাদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রণীত এমএলএম আইনের খসড়ায় কারা এমএলএম পদ্ধতির ব্যবসায় অংশ নিতে পারবেন না, সে বিষয়ে একটি শব্দও উল্লেখ নেই।
১৯৪১ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার একটি অপ্রচলিত ভিটামিন বিপণনে প্রথম এমএলএম পদ্ধতি ব্যবহূত হয়। বেশির ভাগ এমএলএম কোম্পানিই খাদ্যের পরিপূরক, বলবর্ধক, সৌন্দর্যবর্ধক, ওজনহ্রাসক ইত্যাদি পণ্য বেছে নেয়। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডও একই জাতীয় পণ্যের বিপণন করে। এ জাতীয় সব দেশের কোম্পানিরই ব্যবসায়িক কৌশল হলো, ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিশ্বাসকে পুঁজি করা অর্থাৎ আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা। যাদের পক্ষে পণ্যের গুণাগুণ বা মূল্য যাচাইয়ের কোনো সুযোগ থাকে না।
ব্যবসা-অভিধান অনুযায়ী, কোনো কোম্পানির দ্রব্য বা সেবা যদি কেউ সরাসরি নিজে বা প্রশিক্ষণ দিয়ে দল তৈরির মাধ্যমে বিক্রি করে, সেটাই এমএলএম পদ্ধতি। এর মধ্যে পিরামিড, অ্যারোপ্লেন গেইম, মেট্রিক্স—মোটা দাগে এ তিনটি পদ্ধতিরই বেশি প্রয়োগ হয়েছে। ডাউনলাইন, নেটওয়ার্কিং, চেইন ইত্যাদি নামেও এগুলোকে অভিহিত করা হয়। এ ছাড়া রয়েছে ডিরেক্ট সেল পদ্ধতি। এ পদ্ধতির আবার সেলুলার, ডোর-টু-ডোর, ওয়ান-টু-ওয়ান নামে তিনটি উপপদ্ধতি রয়েছে। যেসব দেশে শর্তসাপেক্ষে ও সীমিত আকারে এমএলএম পদ্ধতি চালু রয়েছে তা হলো ওই ডিরেক্ট সেল পদ্ধতি। বাকি সবই নিষিদ্ধ।
ডিরেক্ট সেলের মধ্যে ডোর-টু-ডোর পদ্ধতিতে মানুষের কাছে সরাসরি গিয়ে পণ্যের গুণাগুণ ব্যাখ্যা করে মানুষকে আকৃষ্ট করা হয়। আর সেলুলার পদ্ধতিতে টেলিফোনে পণ্যের বিবরণ দিয়ে ক্রেতাকে আকৃষ্ট করা হয়। আবার পণ্য কেনার জন্য কোম্পানিতে ফোন বা ই-মেইল করলে ঘরে বসেও ওই পণ্যটি পাওয়া যায়। ওয়ান-টু-ওয়ান পদ্ধতিতে কেউ কোনো পণ্য কিনে সন্তুষ্ট হলে তিনি ওই পণ্যের গুণাগুণ বর্ণনা করে অন্যকে তা কিনতে বলেন।
অন্যদিকে, পিরামিড পদ্ধতি হলো, একজন ব্যক্তি দুজন ক্রেতা খুঁজে বের করবে। ওই দুজন আবার দুজন করে নতুন চারজনকে খুঁজবে। এভাবে ১-২-৪-১৬ করে বাড়তে থাকবে। একপর্যায়ে এমন এক জায়গায় গিয়ে আটকে যাবে, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যাবে। বাস্তবে যা কখনোই সম্ভব নয়। ফলে নিশ্চিতভাবেই শেষের দিকের ব্যক্তিরা প্রতারিত হবে।
অ্যারোপ্লেইন গেইম পদ্ধতিটি পিরামিড পদ্ধতির মতোই। পিরামিডে জ্যামিতিক হারে বাড়লেও এতে বাড়ার কথা বলা হয় গাণিতিক হারে। আর এরোপ্লেইনে একজন পাইলট, দুজন কো-পাইলট, এরপর ক্রু ও শেষে প্যাসেঞ্জার থাকে। এই পদ্ধতিটিও সেই রকম। একজন দুজনকে, সেই দুজন আরও দুজনকে—এভাবে এগোতে থাকে।
ম্যাট্রিক্স পদ্ধতিতে প্রথম দিকের ব্যক্তির একটি লক্ষ্যমাত্রা থাকে। শেষের দিকে ব্যক্তিকে অধিক মূল্যে নিম্নমানের পণ্য ধরিয়ে দিতে পারলেই প্রথম দিকের ব্যক্তি মুনাফা পাবে।
বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের পদ্ধতিটি তিনটি পদ্ধতির সমন্বয়।
গ্রাহক আকর্ষণে বিশ্বের প্রায় সব দেশেরই এমএলএম কোম্পানিগুলোর চরিত্র প্রায় এক রকম। যেমন, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ব্যবসায়ের অংশীদার করা, শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের মাসিক উপঢৌকন দেওয়া এবং সরকার না চাইলেও সেধে গিয়ে বড় বড় ক্রীড়ানুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের স্পন্সর হওয়া। বাংলাদেশেও তাই হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই উদাহরণ তৈরি করেছে ডেসটিনি ও নিউওয়ে। বিপিএল, টি-টোয়েন্টিতে স্পন্সর হওয়ার পাশাপাশি মুম্বাই চিত্রনায়ক শাহরুখ খান, নায়িকা রানী মুখার্জিকে দেশে এনে অনুষ্ঠান করিয়েছে তারা।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে আইনের যে খসড়াটি উঠবে, তাতে অবশ্য বলা হয়েছে, যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, পিরামিডসদৃশ বিক্রয় কার্যক্রম করা যাবে না। অবস্তুগত বা অলীক পণ্য এবং সময়ের ধারাবাহিকতা বা পর্যায়ক্রমিক প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে ভবিষ্যতে বিপণনযোগ্য হবে এমন পণ্য বা সেবা নিয়েও ব্যবসা করা যাবে না। পণ্যও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে গৃহস্থালি, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক, হোম অ্যাপ্লায়েন্স, প্রসাধন ও টয়লেট্রিজ, হারবাল, টেলিমার্কেটিং, কৃষিজ ও কৃষিজাত, টেলিকমিউনিকেশন সেবা বা ব্যবহারযোগ্য পণ্য এবং প্রশিক্ষণসংক্রান্ত সেবা ও পণ্য। অবশ্য এ তালিকা কমানো-বাড়ানোর এখতিয়ার থাকবে সরকারের হাতে।
মজার ব্যাপার হলো, খসড়া আইনে প্রতারণার দায়ে সর্বোচ্চ শাস্তি রাখা হয়েছে মাত্র পাঁচ বছরের জেল ও সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা জরিমানা। বুঝুন অবস্থা! এবার কেউ প্রতারণার মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেও তাঁকে জরিমানা গুনতে হবে ওই ৫০ লাখই।
নব্বইয়ের দশকে বিসিআই, তারপর আইটিসিএল, যুবক ইত্যাদি বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সর্বস্ব খুইয়েছে অজস্র সাধারণ মানুষ। একশ্রেণীর মানুষের লোভের আতিশয্যে চোখের সামনে একের পর এক ঘটনা দেখা সত্ত্বেও অকাতরে ঢেলে দিয়েছে কষ্টার্জিত সব উপার্জন। অজ্ঞানতা, অসচেতনতা ও লোভ-প্রবণতার কারণে প্রতারিত হওয়ার পর মানুষ দায় চাপিয়ে দেয় সরকারের ঘাড়ে; যে ঘাড়ে এমনিতেই অনেক বোঝা।
ফখরুল ইসলাম: সাংবাদিক।
fakhrulharun@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.