এবং বাদল সরকার by নিশাত জাহান রানা

১৯৮৫ সাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষভাগে তখন আমরা। আমাদের আবৃত্তি সংগঠন স্বননের আমন্ত্রণ এলো কলকাতা থেকে, ২৫ বৈশাখের অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার জন্য। আমরা ৪ সদস্যের একটি দল কলকাতায় গেলাম। অনেক অনুষ্ঠান হলো। একদিন আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো অঙ্গনমঞ্চে নাটক দেখতে_ 'শানা বাউরির কথকতা'।


সেই প্রথম আলাপ হলো বাদল সরকারের সঙ্গে। অন্যরকম নাটক, অন্যরকম নাট্যউপস্থাপন, অন্যরকম মানুষ। তারপর এই ২৬ বছরে দেখা হয়েছে অনেকবার, কাজে-অকাজে, কারণে-অকারণে। সব শেষে ২০০৯ সালে হায়দরাবাদ থেকে ফেরার পথে যখন তার সঙ্গে দেখা হলো, তখন তার শরীর কিছুটা অশক্ত। চিরদিনের মেদহীন সুঠাম শরীর অনেকটা ভারী। বললেন, ঘর থেকে বেরোন না ঠিকই কিন্তু লিখছেন দু'হাতে। শেষ সময়টুকুতে নাটক ছাড়া অন্যান্য লেখাই লিখছিলেন বেশি। আত্মজীবনীমূলক লেখা এবং অন্যান্য।
কিছু কিছু মানুষ আছেন যারা প্রচলিত ধারার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন না। সীমাকে ছাড়িয়ে চলে যান অনেক দূরে। বানিয়ে তোলা নিয়মকে অগ্রাহ্য করেন প্রবল দাপটে। নির্মাণ করেন নতুন পথ। সাধারণ মানুষের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে উল্টে দেন বিধিব্যবস্থা। সময় এবং সভ্যতা ঋণী থেকে যায় তাদের কাছে। বাদল সরকার সেই অসাধারণ সংশপ্তকদের একজন, যিনি নিজের সমস্ত জীবন দিয়ে লড়াই করেছেন তার বিশ্বাসের মূল্য দিতে। এই বিশ্বাস তিনি অর্জন করেছিলেন তত্ত্ব এবং প্রয়োগের অব্যাহত চর্চার মাধ্যমে।
ষাটের দশকের শেষভাগে আকাশবাণী প্রচারিত নাটক 'এবং ইন্দ্রজিৎ' যে আলোড়ন তুলেছিল আজও তা মুগ্ধতার সঙ্গে স্মরণ করেন সেই সময়ের শ্রোতারা। এই নাটকের জন্য ১৯৬৮ সালে সঙ্গীত নাটক আকাদেমি কর্তৃক পুরস্কৃত হন নাট্যকার বাদল সরকার। কিন্তু নাটককে রেডিও বা প্রচলিত ধারার মঞ্চ বা প্রসেনিয়ামের ভেতর আটকে রাখার প্রতিবাদে বাদল সরকার অল্প কিছুকাল পর থেকেই শুরু করলেন এক নতুন নাট্যধারার নির্মাণ, যার নাম 'তৃতীয়ধারার নাটক'।
'গ্রামভিত্তিক দেশজ লোকনাট্য আর পাশ্চাত্য দেশ থেকে আমদানিকৃত নগরভিত্তিক মঞ্চনাট্য_ আমাদের দেশের এই দুটি প্রধান নাট্যধারার বিকল্প একটি ধারা তৃতীয় থিয়েটার নামে সাধারণভাবে পরিচিত। এই থিয়েটার প্রচলিত মঞ্চে হয় না, হয় উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে অথবা কোনো বড় ঘরের মেঝের ওপর দর্শকদের সঙ্গে অভিনয়ক্ষেত্র ভাগ করে নিয়ে। এ থিয়েটারে টিকিট বিক্রি হয় না, সরকারি বা বেসরকারি অনুদান বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের অর্থ সাহায্য গ্রহণ করা হয় না এখানে, অভিনয় শেষে দর্শকদের স্বতঃস্ফূর্ত দান এর পাথেয়। সে হিসেবে টাকার ওপর নির্ভরশীল নয় এ থিয়েটার। সবচেয়ে বড় কথা_ এ থিয়েটারে বিষয়বস্তু (কনটেন্ট) হলো প্রথম কথা। আঙ্গিক (ফর্ম) আসে পরে। কোনো সামাজিক বা রাজনৈতিক বক্তব্য নেই_ এমন কোনো নাটক এই থিয়েটারে উপস্থিত করা হয় না।' তার নিজের এই বক্তব্যের ভেতরেই প্রতিফলিত তার নাট্যদর্শন। নাটককে তিনি নিয়ে যেতে চেয়েছেন মানুষের কাছে। সহজভাবে।
আমার সৌভাগ্য হয়েছে অনেকবার তার নাটক দেখার_ ঢাকায় এবং কলকাতায়। সবসময়ই সেসব নাটক উপস্থাপিত হয়েছে খোলা জায়গায়, এমনকি কোনো মাইক্রোফোনও ব্যবহার হয় না সেখানে। যে কেউ বিনামূল্যে তা দেখতে পারে। সারাজীবন এই তৃতীয়ধারার নাটক নিয়েই সংগ্রাম করেছেন তিনি। অর্থাভাবে অনেক কষ্ট পেয়েছেন কিন্তু কোনোদিন মাথা নোয়াননি তার বিশ্বাসের, মূল্যবোধের বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পদ্মশ্রী ইত্যাদি পেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু নির্লোভ, নিবেদিত এই মানুষটির কাছে সেসব ছিল নিতান্তই মূল্যহীন।
স্পার্টাকাস, মিছিল, ভোমা, হট্টমালার ওপারে, সুখপাঠ্য ভারতের ইতিহাস এমনি আরও অনেক নাটকের রচয়িতা বাদল সরকার নিজে অত্যন্ত উঁচুমাপের একজন অভিনেতা এবং প্রশিক্ষকও বটে। বাদল সরকার বাংলাদেশে আসেন বেশ কয়েকবার। মূলত এখানকার নাট্যকর্মীদের জন্য কর্মশালা পরিচালনা করতে। যারা তার কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেছেন তারা জানেন কী অসাধারণ শিক্ষক ছিলেন তিনি। তার শিক্ষাপদ্ধতি ছিল অত্যন্ত অংশগ্রহণমূলক, বৈজ্ঞানিক এবং আবেগীয় কৌশলের সমন্বয়। গণসাহায্য সংস্থা ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর আয়োজনে ১৯৯৮ সালে অনুষ্ঠিত হয় এক পথনাটক উৎসব। এ উৎসবে বাদল সরকার অংশ নেন তার সংশ্লিষ্ট ৩টি দল_ শতাব্দী, আয়না ও পথসেনাকে নিয়ে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিনা মাইক্রোফোনে হাজার দর্শকের সামনে তার পরিচালনায় অভিনীত হয় প্রায় ১০টি নাটক। মন্ত্রমুগ্ধের মতো উপভোগ করেন দর্শকরা। তিনি নিজেও অভিনয় করেন দাপটে। তখন তার বয়স ৭২। রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী তার তত্ত্বাবধানে উপস্থাপিত হয় সম্পূর্ণ এক নতুন আঙ্গিকে। পরে তার স্বকণ্ঠে রক্তকরবীর পাঠ সিডি আকারে বাংলাদেশে বের করে মিডিয়া সেন্টার লিমিটেড।
বাংলাদেশে তার ৪টি নাটকের একটি সংকলন (এবং ইন্দ্রজিৎ, সারারাত্তির, পাগলা ঘোড়া ও ভোমা) প্রকাশ করে যুক্ত ২০০৮ সালে। বাদল সরকারের নাটক বাংলাদেশের কিছু নাট্যদল উপস্থাপন করেছে নানা সময়ে, যেমন হট্টমালার ওপারে, মিছিল ইত্যাদি।
তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর আর স্বননের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কাটানো সময় তার সুখের স্মৃতি ছিল পরবর্তী সময়ে। ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত দৃঢ় মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষটি কখনও তার সঙ্গে আপস করেননি, যা তিনি বিশ্বাস করতেন না। তরুণদের সঙ্গে খুব দ্রুত বন্ধুত্ব হতো তার। চিরকালই তার দেখার চোখ ছিল তরুণ, স্বচ্ছ আর মনটা ছিল সবুজ। তাই তো সমাজের অচলায়তনসদৃশ মানবিকতাবিরুদ্ধ বিধিব্যবস্থাগুলোকে তিনি চ্যালেঞ্জ করেছেন বারবার। পালাবদলের দিন আজ পশ্চিমবঙ্গে। ৩৪ বছর পর কমিউনিস্টদের রাজত্ব শেষ করে আসছে নতুন শাসন, নতুন নেতৃত্ব। রাজনৈতিক এই পালাবদলের মুহূর্তে নাট্যজগতের এক নক্ষত্রের অবসান হলো, যিনি চ্যালেঞ্জ করেছিলেন প্রচলিত থিয়েটারকে। প্রচলিত অমানবিক নিয়মকানুনকে।
আমার অগ্রজ বন্ধু, শ্রদ্ধাভাজন, প্রিয় মানুষ বাদল সরকার চলে গেলেন ১৩ মে/৩০ বৈশাখ, তার সঙ্গে পরিচয়ের ঠিক ২৬ বছর পর। তার জন্য ভালোবাসা, শ্রদ্ধা চিরকাল।
 

No comments

Powered by Blogger.