ইতিহাস বিকৃতি তরুণ প্রজন্ম ও আমাদের দায় by মো. ফরহাদ হোসেন

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জাতীয় জীবনে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। এই যুদ্ধের মাধ্যমেই বাঙালি জাতি তাদের 'শ্রেষ্ঠ অর্জন' স্বাধীনতা লাভ করে। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পর ৪০ বছর অতিবাহিত হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতি শুরু হয়।


কারণ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি অবৈধভাবে বন্দুকের নলের জোরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে। জাতির পিতাকে খুন করে অবৈধভাবে দখল করা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তাদের বড় অস্ত্র ছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা, যাতে নতুন প্রজন্ম তথা যুব সম্প্রদায় মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ও প্রকৃত ইতিহাস জানতে না পারে। এর ফলে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় যারা ছিল শিশু বা কিশোর এবং স্বাধীনতার পর যাদের জন্ম হয়েছে, স্বাধীনতাযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তারা জানে না। এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ সংগ্রামীজীবনে যে কঠিন শ্রম দিয়েছেন, চৌদ্দ বছর জেলে বন্দি জীবনযাপন করেছেন, সর্বোপরি পুরো জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সর্বাত্মক স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, তা তারা জানে না। তাদের মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতার সঠিক ও তথ্যবহুল ইতিহাস সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। ১৯৭৫ সালের পর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে এমনভাবে বিকৃত করা হয়েছে যে ২৫ বা ৩০ বছরের অনেক যুবক-যুবতী প্রায়ই প্রশ্ন করে থাকে- স্বাধীনতার ঘোষণা আসলে কে দিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান না জিয়াউর রহমান? উলি্লখিত বয়সের যুবক-যুবতীদের এ ধরনের প্রশ্নের প্রধানতম কারণ হলো ইতিহাসবিকৃতি, যা ১৯৭৫-পরবর্তী অবৈধ সরকারকে বৈধতা দেওয়ার অপপ্রয়াস ছাড়া আর কিছুই নয়।
এখন আমাদের প্রধান কাজ হবে, স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতাযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা। আমাদের মনে রাখতে হবে, তরুণ প্রজন্মই হলো জাতির প্রকৃত শক্তি। এরাই ভবিষ্যতে জ্ঞান-বিজ্ঞান, সমাজকর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাজনৈতিকভাবে বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাই ভবিষ্যতে যারা রাষ্ট্রশক্তি নিয়ন্ত্রণ করবে এবং রাষ্ট্রকে উন্নতির পথে পরিচালনা করবে, তাদের অবশ্যই জাতির প্রকৃত ইতিহাস জানতে হবে এবং তাদের মনের মধ্যে যে বিকৃত ইতিহাস উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রবেশ করানো হয়েছে, তা দূর করতে হবে। বিগত নির্বাচনের মতো আগামী নির্বাচনেও এই নতুন প্রজন্ম বা যুব সম্প্রদায় তাদের ভোটের মাধ্যমে রায় দিয়ে নিশ্চিত করবে, কারা এরপর দেশ শাসন করবে। আমরা কোনো প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রক্ষমতায় দেখতে চাই না। এ লক্ষ্যে আমরা আজকের প্রজন্মের কাছে আমাদের বাঙালি জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায় স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরে তাদের প্রগতিশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, যাতে তারা সফলভাবে তাদের কাঁধে ন্যস্ত জাতির ভবিষ্যৎ দায়িত্ব দক্ষতা, নিষ্ঠা ও দেশপ্রেমের মনোভাব নিয়ে পালন করতে পারে। কিন্তু এই তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলার একটি প্রধান উপায় হিসেবে আমরা দেশব্যাপী মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বিভিন্ন ডকুমেন্টারি বা প্রামাণ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শন করতে পারি।
দেশের প্রাণশক্তি তরুণ প্রজন্মকে যাতে যুদ্ধাপরাধী ও তাদের বিচার সম্পর্কে কোনো বিভ্রান্তিমূলক তথ্য বিএনপি-জামায়াত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সরবরাহ করতে না পারে, সে জন্য অবিলম্বে প্রজেক্টরের মাধ্যমে দেশব্যাপী মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ডকুমেন্টারি ও চলচ্চিত্র প্রদর্শন করার কোনো বিকল্প নেই।
আমাদের মনে রাখতে হবে, জাতির অনেক শ্রেষ্ঠ সন্তান যেমন- অধ্যাপক, প্রকৌশলী, সরকারি কর্মকর্তা, সমাজসেবক, খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ, কৃষক-জনতা অর্থাৎ সর্বস্তরের জনগণের মুক্তিযুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ফলেই আজকে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। ৩০ লাখ মানুষ আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে। দুই লাখ মা-বোন তাদের ইজ্জত হারিয়েছে এবং লাঞ্ছিত হয়েছে। তাই তাদের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য উলি্লখিত কাজটি করা উচিত বলে আমরা মনে করি।


লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ।

No comments

Powered by Blogger.