সরেজমিন : তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা-বাবাকে মারতে দেখে শিশুর কান্না by এস এম আজাদ

রাত সাড়ে ৮টা। রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা। ডিউটি অফিসারের সামনে দাঁড়িয়ে ওয়্যারলেস অপারেটরের হাতে ১০০ টাকার একটি নোট দিলেন এক যুবক। টাকা দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে যুবক বলেন, তাঁর মা সুখেরা বেগম দুই সপ্তাহ ধরে নিখোঁজ। তাই ডায়েরি করতে এসেছিলেন।


এ জন্যই টাকা দেওয়া। যুবকটির নাম মোকাদ্দাস, বাসা কুনিপাড়ায়। মোকাদ্দাসের সঙ্গে কথা বলার সময় হাজতখানার দিক থেকে এক পুলিশ সদস্য বের হয়ে এলেন। সামনে দায়িত্বরত কনস্টেবল খালেককে উদ্দেশ করে বললেন, 'ভিতরে বইসাই গাঁজা বানাইতাছে।' হাজতখানার কাছে গিয়ে দেখা গেল, ভেতর থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে! গাঁজা সেবন করছে কয়েক বন্দি। মুখে উচ্চ স্বরে বাংলা সিনেমার গান। এ প্রতিবেদক থানায় ঢোকেন শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে। ঢোকার মুখে থানার সাইনবোর্ডের সামনে এক জটলা। কথা বলছিলেন দুই নারীসহ পাঁচজন। থানা থেকে মোটরসাইকেলে বের হয়ে এএসআই মোস্তাক জটলার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, 'আজাদ কে?' এক যুবক বলেন, 'আমি স্যার।' সঙ্গে সঙ্গে মোটরসাইকেল থেকে মোস্তাক নেমে যুবকের শার্টের কলার টেনে ধরে বেধড়ক পেটাতে থাকেন। 'শালা, ইয়াবার ব্যবসা করো...' বলে যুবককে টেনে নিয়ে যান ডিউটি অফিসারের কক্ষে। এরপর অনেকটা টানাহেঁচড়া করেন হাজতে।
দূর থেকে এ দৃশ্য দেখছিলেন এক মহিলা। কোলে পাঁচ-ছয় বছরের শিশু। আজাদকে এভাবে মারধর করা আর টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে দেখে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে শিশুটি। মহিলা জানান, তাঁর নাম ফেরদৌসী। থাকেন থানার অদূরে। পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করেন সংসদ এলাকায়। আজাদ তাঁর স্বামী ছিলেন। তিনি মাদকাসক্ত। দাম্পত্য কলহের কারণে তিন বছর আগে আজাদকে তালাক দেন। তাঁদের ছয় বছরের এই মেয়ে বৃষ্টিকে নিজের কাছে নিতে চান আজাদ। কিন্তু ফেরদৌসী ওকে দিতে চান না। এ কারণে থানায় ডায়েরি করতে এসেছিলেন ফেরদৌসী। তাঁর আসার খবর পেয়ে থানার সামনে আসেন আজাদ।
ফেরদৌসী জানান, তিনি নিজের নিরাপত্তার জন্য থানায় একটি ডায়েরি করতে এসেছেন। কিন্তু সেখান থেকে এএসআই মোস্তাক আজাদকে ধরে নিয়ে গেলেন। মেয়েটা এখন আবার বাবার জন্য কাঁদছে। থানার ক্যাশিয়ার রহিম বলেছেন ব্যবস্থা হবে। ফেরদৌসী বলেন, 'আমি তো মামলা করি নাই। আর তা ছাড়া এই বয়সের একটা শিশুর সামনে পুলিশ তার বাবাকে এভাবে মারধর করতে পারে?'
রাত পৌনে ৮টা। ডিউটি অফিসারের কক্ষে এক যুবকের ডায়েরি লিখছিলেন ওয়্যারলেস অপারেটর। ওসি ফারুক আহমেদের কক্ষে বসে কথা বলছেন দুই ব্যক্তি। অপারেশন অফিসার শফিকুল ইসলামের কক্ষে আছেন আরো দু-তিনজন। পরিদর্শক (তদন্ত) ইলিয়াস হোসেন কথা বলছিলেন এক যুবকের সঙ্গে। সবাই ব্যস্ত। থানা ভবনের পূর্ব দিকের কক্ষটি হাজতখানা। সামনে দিয়ে চলে গেছে ছোট একটি রাস্তা। অন্ধকারে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে হাজতখানার এক আসামির সঙ্গে কথা বলছিলেন দুই নারী। হাজতখানায় থাকা যুবকের হাতে কিছু একটা দিলেন দুই নারীর একজন। নারীদের একজন জানান, তাঁর নাম পারভীন। বিকেল ৩টার দিকে তেজগাঁও রেললাইনের হেরোইনের আখড়া থেকে তাঁর স্বামী বশির উদ্দিন বশিকে আটক করেছেন থানার এসআই গোলাম রসুল। পারভীনের সঙ্গে থাকা নারী তাঁর শাশুড়ি নূর নাহার। পারভীন বলেন, 'ও খায়, কিন্তু ব্যবসা করে না। পুলিশ ধরার সময় ওর কাছে কিছু পায় নাই। মামলা হয় কেমনে? যারা বিক্রি করে হ্যাগো ধরে না ক্যান পুলিশ?'
থানা চত্বরে ঘুরছিলেন পারভীন ও নূর নাহার। রাত ১০টার দিকে ডিউটি অফিসার সাইফুর রহমান আড়ালে ডেকে নিয়ে কথা বলেন পারভীনের সঙ্গে। এরপর পারভীন এ প্রতিবেদককে বলেন, 'ডিউটি অফিসার টাকা চায়। নইলে রিমান্ডে আনব। মামলা নাকি হইয়া গেছে। অথচ ওসি তদন্ত স্যার কইছে সকালে ছাইড়া দিব। কী করমু, কার কথা বিশ্বাস করমু বুঝতাছি না।'
রাত সাড়ে ১০টা। হাজত থেকে আজাদকে নিয়ে বের হয়ে আসেন ক্যাশিয়ার রহিম। আজাদকে বলেন, 'সোজা চইলা যাইবা। অনেক ঝামেলা কইরা তোরে ছাড়াইছি।' হাজতের ভেতর থেকে তখনো গাঁজার ধোঁয়া বের হয়ে আসছিল। আজাদ এ প্রতিবেদককে বলেন, 'আমার মাইয়াডারে একটু দেখতে যাই। এই কারণে দালাল দিয়া আমারে ধরাইছে।' হাজতের ভেতরে গাঁজা সেবন করছে কে জানতে চাইলে আজাদ বলেন, 'বাইরে যে দুজন মহিলা ঘুরতাছে ওদের লোক। পুলিশের কাছের লোক ওরা। নইলে থানার মধ্যে গানজা পায় কেমনে, বুঝেন না?'
রাত ১১টা। থানায় আসা রিকুইজিশন করা একটি ট্যাক্সিক্যাব (ঢাকা মেট্রো-প-১১-৪১০০) নিয়ে কথা বলছিলেন কয়েকজন পুলিশ অফিসার। এএসআই আবদুল মালেক ক্যাবচালককে বললেন, 'গাড়ি তোমাকেই চালাতে হবে।' চালক বলেন, 'স্যার, সম্ভব না।' পাশেই সাদা পোশাকে দাঁড়ানো পরিদর্শক (তদন্ত) ইলিয়াস হোসেনের সঙ্গে কথা বলেন এএসআই মালেক। এরপর 'চালাইতে যখন পারবা না তখন সারা রাত এইখানে থাকো' বলে কোমরে ধরে টেনে নিয়ে যান হাজতখানায়। খুঁড়িয়ে হাঁটছিলেন চালক।
রাত সাড়ে ১২টার দিকে থানার ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাত দেড়টার দিকে পরিচয় দিয়ে কথা হয় ডিউটি অফিসার সাইফুরের সঙ্গে। তিনি জানান, রাতে একটি মামলা হয়েছে। তেজগাঁও রেললাইন থেকে ৩০ পুরিয়া গাঁজাসহ বশির নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ১০টা। থানার ডিউটি অফিসার রজিবুল ইসলামের সামনে ডায়েরি করার জন্য একটি কাগজ ধরলেন দুই ব্যক্তি। ডায়েরি নথিভুক্ত করে তাঁদের কাছ থেকে ২০০ টাকা নিলেন রজিবুল। জাকির হোসেন ও বরকত আলী নামের ওই দুই ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এই ২০০ টাকা ছাড়াও ডায়েরি লিখে দেওয়ার জন্য ওয়্যারলেস অপারেটর নিয়েছেন আরো ৩০০ টাকা।
কালের কণ্ঠের সঙ্গে কথা হয় পরিদর্শক ইলিয়াস হোসেনের। তিনি দাবি করেন, এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন ভালো। ৩০ জন তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী থাকলেও তারা এলাকায় থাকে না। মাদকের মামলাই বেশি হয়। গতকাল সকাল পর্যন্ত এই মাসে মামলা হয়েছে ২৭টি, যার মধ্যে ১৬টি মাদকের।

No comments

Powered by Blogger.