বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৪৪২ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। তাজুল ইসলাম, বীর প্রতীক সাহসী এক মুক্তিযোদ্ধা আখাউড়ার অবস্থান ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে। এর ওপর দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেটের রেল যোগাযোগ। খুব কাছেই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা।


১৯৭১ সালে সামরিক দিক থেকে আখাউড়া ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুর্ভেদ্য এক ঘাঁটি।
মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে আখাউড়ায় ৩০ নভেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বর ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর একটি দলে ছিলেন তাজুল ইসলাম। ৩ ডিসেম্বর তাঁরা আক্রমণ চালান আখাউড়ার পার্শ্ববর্তী আজমপুর রেলস্টেশনে। তখন সেখানে রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
এই যুদ্ধে তাজুল ইসলাম ও তাঁর সহযোদ্ধারা যথেষ্ট সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন। তাঁদের সাহসিকতায় মুক্ত হয় আজমপুর রেলস্টেশন। পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সেদিন রক্তক্ষয়ী ওই যুদ্ধে তাঁদের বি কোম্পানির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট ইবনে ফজল বদিউজ্জামানসহ (বীর প্রতীক) আট-নয়জন সহযোদ্ধা শহীদ এবং ২০ জন আহত হন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২২ জন হতাহত হয়।
আখাউড়ার পতনের পর তাজুল ইসলাম তাঁর দলের সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যান। সেখানে কয়েক দিন অবস্থানের পর নরসিংদী হয়ে ঢাকা অভিমুখে রওনা হন। পথে বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁদের ছোটখাটো সংঘর্ষ হয়। ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তাঁরা মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরীর (বীর বিক্রম, পরে মেজর জেনারেল) নেতৃত্বে ঢাকায় পৌঁছান।
১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে তাজুল ইসলামের দলের অবস্থান ছিল ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তখন রেসকোর্স ময়দান)। সেখানে অবস্থানকালে তাঁদের দলের ওপর ২৯ জানুয়ারি নির্দেশ আসে মিরপুরে অভিযান চালানোর। মিরপুর তখনো বিহারিদের দখলে ছিল। এই অভিযানে গিয়ে তাজুল ইসলামসহ তাঁর সহযোদ্ধা অনেকে বিহারিদের পাল্টা আক্রমণে শহীদ হন।
স্বল্প পরিসরে এ ঘটনার বর্ণনা আছে মইনুল হোসেন চৌধুরীর এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য বইয়ে। তিনি লিখেছেন, ‘২৯ তারিখে ক্যাপ্টেন হেলাল মোরশেদের নেতৃত্বে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে এক কোম্পানি সেনা মিরপুরে যান। রাত শেষে ৩০ জানুয়ারি সকালে পুলিশ এসে সেনাসদস্যদের সঙ্গে যোগ দেয়। এরপর তাঁরা ১২ নম্বর সেকশনে যান।
‘আনুমানিক বেলা ১১টার দিকে চতুর্দিকের বিভিন্ন বাড়িঘর থেকে অতর্কিতে একযোগে সেনা ও পুলিশের ওপর বিহারিরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র, হ্যান্ডগ্রেনেড ইত্যাদি নিয়ে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। এই অতর্কিত আক্রমণের জন্য পুলিশ ও সেনাবাহিনী মোটেই প্রস্তুত ছিল না।
‘চারদিকের প্রচণ্ড আক্রমণের মধ্যে পড়ে পুলিশ ও সেনারা হতাহত হন। তাঁরা পাল্টা আক্রমণের তেমন সুযোগই পাননি। লেফটেন্যান্ট সেলিম, সুবেদার মোমেন, নায়েক তাজুলসহ (ইসলাম) অনেকে ঘটনাস্থলে নিহত হন। কোম্পানি কমান্ডার হেলাল মোরশেদও আহত হন।’
তাজুল ইসলাম চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। তখন তাঁর পদবি ছিল নায়েক। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে পুনর্গঠিত হয়ে প্রথমে ৩ নম্বর সেক্টরে, পরে এস ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য তাজুল ইসলামকে মরণোত্তর বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১১৮।
তাজুল ইসলামের পৈতৃক বাড়ি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার বাগানবাজার ইউনিয়নের গার্ডপাড়া (পুরাতন রামগড়) গ্রামে। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। তাঁর বাবার নাম নাদেরুজ্জামান।
সূত্র: প্রথম আলোর ফটিকছড়ি (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি এস এম আক্কাছ উদ্দিন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর-৩।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.