বিধানসভা নির্বাচন-জনগণমন

ভারতের পূর্ব ও দক্ষিণের চারটি রাজ্য এবং একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের বিধানসভা নির্বাচনের ফল তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী দুই রাজ্যের একটি পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী ক্যারিশমাটিক নেতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় সাড়ে তিন দশকের বাম দুর্গের অবসান ঘটিয়েছেন।


এই রাজ্যের জনগণ পরিবর্তন চেয়েছে এবং তৃণমূল থেকে উঠে আসা রাজপথের সাহসী এক যোদ্ধা হিসেবে তিনি এই জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। আসামে কংগ্রেস সরকার টানা তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় ফিরে এসেছে এবং স্পষ্টতই উলফার সঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়ার পক্ষে মিলেছে জনগণের বিপুল অনুমোদন। দক্ষিণের রাজ্য তামিলনাড়ূতে গণরায় স্পষ্টতই দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে। এর প্রভাব পড়েছে পার্শ্ববর্তী কেন্দ্রশাসিত পণ্ডিচেরিতেও। কেরালায় সিপিএম পরিচালিত ক্ষমতাসীন বাম জোট ও কংগ্রেস জোটের লড়াই হয়েছে হাড্ডাহাড্ডি। শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছে পরিবর্তন প্রত্যাশীদেরই। এই নির্বাচন কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন ইউপিএর স্থায়িত্বের ওপর তেমন প্রভাব ফেলবে বলে আপাতভাবে প্রতীয়মান হয় না। তবে ভোটের ক্ষেত্রে জনগণই যে শেষ কথা বলার অধিকারী, ফের এর স্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছে এবং মনমোহন সিং ও সোনিয়া গান্ধীসহ সব দলকেই বিষয়টি আমলে না নিয়ে উপায় নেই। বলাবাহুল্য, গণরায় কোনো দল কিংবা প্রার্থীর জন্য নিশ্চিত নয়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং তার মন্ত্রিসভার বেশিরভাগ সদস্য নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছেন। সিপিএম দলের কর্মীবাহিনী বিশাল। কিন্তু ভোটাররা নিজেদের বিবেচনা অনুযায়ী ভোট দিয়েছে। তামিলনাড়ূর মুখ্যমন্ত্রী এম করুণানিধির ডিএমকে দলের বিরুদ্ধে যে দুর্নীতির অভিযোগ, ভোটাররা তা যথার্থ বলেই মনে করেছে এবং তাদের ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়েছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে। নেতাদের অদক্ষতা এবং ঔদ্ধত্য সহ্য করতেও আমজনতা রাজি নয়। ভারতের এসব অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিকদেরও অনেক কিছু শেখার রয়েছে। প্রতিটি রাজ্যেই পরাজিত পক্ষ এমনকি সব আসনের ফল প্রকাশের আগেই নির্বাচনের ফল মেনে নিয়ে নতুন সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। কোনো রাজ্যেই কারচুপির অভিযোগ উত্থাপিত হয়নি, বরং গণরায় শ্রদ্ধার সঙ্গে মাথা পেতে নেওয়ার ঘোষণা এসেছে বিনয়ের সঙ্গে। বাংলাদেশের টানা তিনটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা গেছে জনগণের রায় মেনে নিতে পরাজিত পক্ষের প্রবল অনীহা। ভারতের নির্বাচন কমিশনের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বও আমাদের জন্য অনুসরণযোগ্য। জনপ্রিয় নেতা-নেত্রী কিংবা সুবৃহৎ রাজনৈতিক দল সবাই সেখানে কমিশনের সিদ্ধান্তকে অবনতমস্তকে গ্রহণ করেছে। নির্বাচনের সময় রাজ্যে ক্ষমতায় ছিল রাজনৈতিক দলীয় সরকার, কিন্তু কার্যত প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং ভোটের সঙ্গে যুক্ত সব পক্ষের নিয়ন্ত্রণ ছিল নির্বাচন কমিশনের হাতে। নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর কোনো পক্ষই কমিশনের ক্ষমতার বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উত্থাপন করেনি।
পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশের বৃহৎ প্রতিবেশী রাজ্য। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সহযোগিতার মাত্রা ব্যাপক। আবার কিছু সমস্যাও রয়েছে। সহযোগিতা বাড়ানো কিংবা সমস্যার পারস্পরিক গ্রহণযোগ্য নিষ্পত্তি, প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই রাজ্যের রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। ত্রিপুরা ও আসামের ক্ষমতাসীন সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থানকেও একইভাবে আমাদের বিবেচনায় রাখতে হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের বিজয়ে যে তাৎক্ষণিক অভিনন্দন জানিয়েছেন তা নিছক পূর্ব পরিচয়ের সূত্রে নয়, বরং সুদূরপ্রসারী কূটনৈতিক লক্ষাভিমুখী, সেটা বুঝতে তাই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। পশ্চিমবঙ্গে একটি জমানার অবসান ঘটেছে এবং বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য নতুন শাসকদের সহযোগিতার দরকার রয়েছে। বাংলাদেশ তাদের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তারাও একইভাবে এগিয়ে আসবে, এটাই প্রত্যাশা।
 

No comments

Powered by Blogger.