ট্রাইব্যুনাল বাড়লেও অবকাঠামো বাড়েনি by কুন্তল রায়

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার গতিশীল করতে সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়িয়েছে। কিন্তু এ দুই ট্রাইব্যুনালের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা তেমন বাড়েনি। প্রথম ট্রাইব্যুনালেই জনবল-সংকট ছিল, দ্বিতীয়টি গঠনের পর সংকট আরও বেড়েছে।


গত বছরের নভেম্বরে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো জনবল-প্রস্তাব এখনো অনুমোদন হয়নি। ফলে বিচারকাজে গতি এলেও দাপ্তরিক কাজ ব্যাহত হচ্ছে। ট্রাইব্যুনালের পূর্ণাঙ্গ তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ, গবেষণা সেল ও নিজস্ব ওয়েবসাইট এখনো নেই।
অবকাঠামোগত এসব সমস্যাকে ট্রাইব্যুনালের সুষ্ঠু কার্যক্রমের ক্ষেত্রে বাধা বলে মনে করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির। যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই বছরের বেশি পার হলেও সরকার ট্রাইব্যুনালকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেনি। দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালের জন্য আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়নি। ডিসেম্বরের মধ্যে বিচার শেষ হতে পারে বলে মন্ত্রীরা যে আশা করছেন, তাতে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।’
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ পুরাতন হাইকোর্ট ভবনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল স্থাপিত হয়। চলতি বছরের ২২ মার্চ ট্রাইব্যুনাল-২ স্থাপন করা হয়। ট্রাইব্যুনাল-১-এ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম, বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা চারটি বিচারাধীন। ট্রাইব্যুনাল-২-এ বিচার চলছে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লা এবং বিএনপির নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের বিরুদ্ধে।
ওই ভবনের দোতলায় ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের কার্যালয় এবং এজলাস। নিচতলায় রয়েছে রেজিস্ট্রারের কার্যালয়, আসামিপক্ষের আইনজীবীদের বিশ্রামকক্ষ, মিডিয়া কক্ষ ও হাজতখানা। মানুষের চাপ বাড়লেও ভবনকে উপযোগী করে সংস্কার করা হয়নি।
অবকাঠামো: ট্রাইব্যুনালের ভৌত অবকাঠামো নিয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ করেছেন। ২৯ মে ট্রাইব্যুনাল-১-এ সাকা চৌধুরীর আইনজীবী আহসানুল হক অভিযোগ করেন, আসামিপক্ষের আইনজীবীদের জন্য বরাদ্দ করা কামরা ও প্রসাধনকক্ষ (শৌচাগার) খুবই নিম্নমানের। এ সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের চেষ্টা চলছে। দুটি ট্রাইব্যুনাল হয়েছে, কিন্তু আর কিছু হয়নি।
ওই ভবনে দিনে আইনজীবী, সাংবাদিক, দর্শনার্থীসহ গড়ে প্রায় ১৫০ জন গেলেও প্রসাধনকক্ষ কিছুদিন আগেও ছিল মাত্র একটি। এখন আইনজীবী ও সাংবাদিকদের জন্য আরেকটি করা হয়েছে। কিন্তু নারীদের জন্য আলাদা কোনো প্রসাধনকক্ষ নেই। ট্রাইব্যুনাল-১-এর এজলাসে সব মিলে ৮০ জনের বসার ব্যবস্থা থাকলেও ট্রাইব্যুনাল-২-এর এজলাসে আছে ২০-২৫ জনের। আসামিপক্ষের আইনজীবীদের বিশ্রামকক্ষে আছে কেবল একটি টেবিল ও তিন-চারটি চেয়ার। কিন্তু সাংবাদিকদের জন্য বরাদ্দ মিডিয়া কক্ষে কেবল একটি টেবিল আছে।
জামায়াতের নেতাদের আইনজীবী তাজুল ইসলাম সম্প্রতি আসামিপক্ষের আইনজীবীদের বিশ্রামকক্ষ নিয়ে অভিযোগ করলে ট্রাইব্যুনাল সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন।
গত ২৭ জুন ট্রাইব্যুনাল-১-এর এজলাসের ফলস সিলিংয়ের একটি খণ্ড খসে পড়ে। বৃষ্টির পানি জমে ফলস সিলিং ভারী হয়ে যাওয়ায় এ ঘটনা ঘটে। এ কারণে পরদিন এ ট্রাইব্যুনালে মামলার কার্যক্রম চলেনি।
জনবল-সংকট: ট্রাইব্যুনালের সূত্রগুলো জানায়, জনবল-সংকটের কারণে ট্রাইব্যুনালের দাপ্তরিক কাজ সম্পন্ন করতে বিলম্ব হচ্ছে। এতে নথিপত্র যথাসময়ে প্রস্তুত হচ্ছে না। তাজুল ইসলাম বিষয়টি নজরে আনলে ট্রাইব্যুনাল বলেন, বিকেল চারটা-সাড়ে চারটা পর্যন্ত বিচারিক কার্যক্রম চলে। এরপর বেশির ভাগ কর্মচারীকে পাওয়া যায় না। কেননা, পৌনে পাঁচটার স্টাফ বাস ধরতে কর্মচারীরা চলে যান। এর মধ্যেই দাপ্তরিক কাজ সারতে হয়।
সূত্র জানায়, ট্রাইব্যুনালকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে গত বছরের ২৮ নভেম্বর একটি সাংগঠনিক কাঠামোর প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, ট্রাইব্যুনালের সুষ্ঠু কার্যক্রমের জন্য ৭২ জনবলের এই কাঠামো জরুরি। কিন্তু এখনো তা অনুমোদন হয়নি।
শাহরিয়ার কবির এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘প্রথম ট্রাইব্যুনালেই জনবল-সংকট রয়েছে, এর কোনো সমাধান না করে সরকার দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালের জন্য আলাদা কোনো প্রসিকিউশন প্যানেল (রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী) নিয়োগ করা হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘এ ধরনের বিচারে গবেষণা বলে যে কোনো জিনিসের প্রয়োজন আছে, ট্রাইব্যুনালের দিকে তাকালে তা মনেই হয় না।’
রেজিস্ট্রারের কার্যালয় সূত্র জানায়, ওই কাঠামোতে আইটি বিভাগ ও গবেষণা সেলের প্রস্তাবও রয়েছে। আইটি বিভাগে একজন পরামর্শক ও দুজন কর্মকর্তা এবং গবেষণা সেলে একটি গ্রন্থাগারসহ দুজন গবেষণা কর্মকর্তা রাখার প্রস্তাব রয়েছে। চলতি বছরের শুরুতে আইন মন্ত্রণালয়ের একজন আইটি পরামর্শককে ট্রাইব্যুনালে সংযুক্ত করা হয়েছে। তবে ওই দুটি বিভাগ-সেল হয়নি। গ্রন্থাগার না থাকায় প্রতিবছর ট্রাইব্যুনালে বইপত্র ও সাময়িকী কেনার খাতে বরাদ্দ করা টাকা অব্যয়িত অবস্থায় ফেরত যায়।
সূত্র আরও জানায়, ওই প্রস্তাব পাঠানোর পর ট্রাইব্যুনাল-২ গঠিত হলে জনবল-সংকট আরও বাড়ে। এ সময় কিছুদিন ট্রাইব্যুনালে রেজিস্ট্রার ছিলেন না। ২৩ এপ্রিল জরুরি ভিত্তিতে ছয়জন লোক চেয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায় রেজিস্ট্রারের দপ্তর। চিঠিতে বলা হয়, ট্রাইব্যুনাল-১-এ দায়িত্বরত বেশির ভাগ কর্মচারী যৌথভাবে দুই ট্রাইব্যুনালে দায়িত্ব পালন করছেন। এ জন্য জরুরি ভিত্তিতে আরও ছয়জন কর্মচারীকে ট্রাইব্যুনালে বদলি বা সংযুক্ত করা দরকার। কিন্তু ওই জনবল এখনো পায়নি ট্রাইব্যুনাল। ওই চিঠি অনুসারে ট্রাইব্যুনাল-১-এর জনবল ছয়জন এবং ট্রাইব্যুনাল-২-এর জনবল চারজন।
ওয়েবসাইট নেই: ট্রাইব্যুনালের এখনো নিজস্ব ওয়েবসাইট নেই। ফলে ট্রাইব্যুনাল-সম্পর্কিত তথ্যের জন্য রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে যোগাযোগের বিকল্প নেই। অথচ বিদেশে এ ধরনের সব আদালতের নিজস্ব ওয়েবসাইট রয়েছে।
অবকাঠামো ও জনবল প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার এ কে এম নাসিরউদ্দিন মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েকজন কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন লোক আনার ব্যবস্থা চলছে। অবকাঠামোগত যেসব সমস্যা রয়েছে, সেগুলো সমাধানেরও চেষ্টা চলছে।’

No comments

Powered by Blogger.