আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি-পুলিশ কি শোধরাবে না? by আবু সাঈদ খান

পুলিশ যা-ই করুক, তার দায় সরকারের ওপর বর্তাবেই। তাই এ বিষয়ে সরকারের একটি নীতিগত অবস্থান জরুরি। সেটি হচ্ছে, তারা হীন রাজনৈতিক স্বার্থে পুলিশকে ব্যবহার করবে না; নিয়োগ-পদোন্নতি-পোস্টিংয়ের ক্ষেত্রে আত্মীয়তা, আঞ্চলিকতা, দলীয় আনুগত্য বিবেচনায় আনা যাবে না।


পুলিশ হবে সরকারের দলীয় প্রভাবমুক্ত নিরপেক্ষ সেবক বাহিনী।
পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মনে রাখতে হবে যে, তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী; কোনো দলের আজ্ঞাবহ নয়। সেবার সংস্কৃতিই পুলিশের ভূলুণ্ঠিত ভাবমূর্তি ফিরিয়ে দিতে পারে; অন্য কোনোভাবে তা সম্ভব নয়

আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন পুলিশ। তবে কোনো ইতিবাচক ভূমিকার জন্য নয়, মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে তারা আলোচিত ও সমালোচিত। গত সপ্তাহে তিন তিনটি অঘটন ঘটিয়ে পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে পুলিশ। ২৬ মে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ঢাকা মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্রীদের বিক্ষোভের ছবি তুলতে গিয়ে প্রহৃত হলেন ৩ সাংবাদিক। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, প্রথমে এক ফটোসাংবাদিক বিক্ষোভের ছবি তুলতে গেলে তাকে বাধা দেয় পুলিশ। কিল-ঘুষি মেরে তাকে ধরাশায়ী করা হয়। ওই ফটোসাংবাদিককে উদ্ধারে দুই সহযোগী এগিয়ে এলে তারাও পুলিশের রোষে পড়েন। তাদের ওপর চড়াও হয়ে কিল-ঘুষি-লাথি মেরে মারাত্মক আহত করে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা।
এরপর ভয়াবহ আরেক ঘটনা ঘটল রাজধানীর নিম্ন আদালত চত্বরে। বাবা-মার সঙ্গে বিচারপ্রার্থী এক নারী এসেছিলেন আদালতে। আদালত চত্বরে কর্তব্যরত পুলিশের দায়িত্ব বিচারপ্রার্থীদের রক্ষা করা। কিন্তু তা না করে উল্টো বিচারপ্রার্থী তরুণীর ওপর হামলে পড়ে তারা। তরুণীর শ্লীলতাহানি করে পুলিশ। মাকে আটকে রাখে। বাবাকেও মারধর করা হয়। ২৯ মে ঘটা ওই ঘটনাতেও লাঞ্ছিত হন আইনজীবী ও সাংবাদিকরা। প্রকাশ্য দিবালোকে তরুণীর শ্লীলতাহানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে লাঞ্ছিত হন সেখানে অবস্থানরত সাংবাদিক-আইনজীবীরা।
৩০ মে গাজীপুর উপজেলার কালীগঞ্জে বালু ব্যবসায়ী মোঃ মামুন ভূঁইয়াকে গ্রেফতারের পর হাতকড়া পরিয়ে সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে দেয় পুলিশ। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সামনে তাকে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। হত্যার পর মামুনের হাত থেকে হাতকড়া খুলে নেয় পুলিশ।
এ তিনটি ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রতীয়মান হয় যে, পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। তবে এগুলো বড় ঘটনা বলে গণমাধ্যমের মনোযোগ আকৃষ্ট করতে পেরেছে। কিন্তু প্রতিনিয়ত তাদের কত অপরাধ লোকচক্ষুর অন্তরালে সংঘটিত হচ্ছে, তার হদিস আমাদের জানা নেই।
পুলিশের এই বেপরোয়া মনোভাবের পেছনে প্রাথমিকভাবে যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হলো, তাদের প্রতি ক্ষমতাসীনদের এক ধরনের প্রশ্রয় ও আশীর্বাদ রয়েছে। রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে পুলিশের দায়িত্ব নিরপেক্ষভাবে অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা ও নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়া। কিন্তু পুলিশ অর্পিত দায়িত্ব পালনে নয়, বরং ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ রক্ষায় যেন নিয়োজিত হয়েছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর চড়াও হচ্ছে। আর রাজনীতি-সংশ্লিষ্টতা তাদের মধ্যে বেপরোয়া মনোভাবের জন্ম দিয়েছে। শুধু যে পুলিশ বাহিনী রাজনৈতিক কারণে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা-ই নয়; অভিযোগ আছে, রাজনৈতিক আনুগত্যের কারণেই তাদের নিয়োগ-বদলি ও পোস্টিং দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্তরা স্বাভাবিকভাবেই ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। নীতি ও দায়িত্ববোধ বিসর্জন দিয়ে অনেকেই বেপরোয়া অপরাধী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তারাই এসব মারাত্মক অপরাধের কারণে সংবাদের শিরোনাম হচ্ছেন। এসব কারণে পুলিশ বাহিনীর সুনাম হচ্ছে ভূলুণ্ঠিত।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ কর্মকাণ্ডে জনগণ যখন উদ্বিগ্ন, তখন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু পুলিশ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। এর মানে কি এই যে, পুলিশের যা খুশি তা-ই করার, এমনকি আইন লঙ্ঘনের এখতিয়ার আছে! সাংবাদিকরা দায়িত্ব পালন করতে গেলে তাদের ওপর পুলিশ চাইলেই চড়াও হতে পারবে, বিচারপ্রার্থী তরুণীর শ্লীলতাহানি করতে পারবে, সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে দেবে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে? আর নাগরিকরা নিরাপদ দূরত্বে থেকে নিজেদের রক্ষা করবে?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন বলেছেন, বিগত ১০ বছরের চেয়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন ভালো। কিন্তু বিগত সময়ে কোনো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী কি পুলিশের থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন? পরিস্থিতি কোথায় গেলে এমন পরামর্শ দেওয়া হয়? প্রতিমন্ত্রী, না মন্ত্রী_ কার কথা বিশ্বাস করব আমরা? নাকি আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুবউল আলম হানিফের কথা মেনে নেব? তিনি বলেছেন সাংবাদিক নির্যাতনের পেছনে ষড়যন্ত্রের কথা। কার ষড়যন্ত্র_ সেটিই জানার বিষয়।
আসলে বোলচাল দিয়ে পরিস্থিতি আড়াল করার সুযোগ নেই। বরং যা ঘটবে, যারা ঘটাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কেবল আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণই শেষ কথা নয়। পুলিশি ব্যবস্থার ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় সংস্কারেও পদক্ষেপ নিতে হবে।
পুলিশের গঠন প্রক্রিয়ায়ই ত্রুটি রয়েছে। ব্রিটিশ শাসনামলে গঠিত পুলিশের প্রধান কাজ ছিল প্রতিবাদীদের দমন করা। সে থেকে রাজনৈতিক স্বার্থে পুলিশ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পাকিস্তান আমলেও পুলিশ রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তর সব সরকারের আমলেই পুলিশ ক্ষমতাসীনদের লাঠিয়ালে পরিণত হয়েছে। এখন তা অতীতকে ছাড়িয়ে গেছে। অতীতে পুলিশের দল ছিল না। এখন পুলিশের মধ্যে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থকগোষ্ঠী রয়েছে। অনেকের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। যে দল ক্ষমতায় আসছে, সে দলের সমর্থক পুলিশদের রাজধানীসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পোস্টিং দেওয়া হয়। এ যোগসূত্রই পুলিশকে বেপরোয়া করে দেয়। সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যরা ভাবেন, তাদের রক্ষাকর্তা তো আছেনই। যখন কর্মকর্তারা বেপরোয়া হন, সিপাহিদের মধ্যেও তা সংক্রমিত হয়।
পুলিশ সদস্যরা এখন সরকারের কাছে অনুগত; আইনের কাছে নয়। সরকার তাদের রক্ষা করে। পুলিশ সদস্যরা জানে যে, ক্লোজ করা বা সাময়িক বরখাস্ত কোনো সাজা নয়। সেটি তাদের জন্য 'বিশ্রাম'। বিশ্রাম শেষে প্রমোশন দেওয়া হয়_ এমন নজির অনেক। সরকার প্রয়োজনে দায়মুক্তিও দিতে পারে, যেমনি আইন করে অপারেশন ক্লিনহার্টের মাধ্যমে হত্যার অভিযোগ থেকে সংশ্লিষ্টদের দায়মুক্তি দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। আর বেআইনিভাবে বা আইনকে পাশে ঠেলে পুলিশের অপরাধ থেকে দায়মুক্তির ঘটনা যে কত ঘটছে, তার ইয়ত্তা নেই। দেশে পুলিশের হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় শাস্তি হয়েছে_ এমন দৃষ্টান্ত কি আদৌ আছে? বরং সৎ পুলিশরা আলোচিত হন না, নজরে পড়েন না। তাদের পদোন্নতিও হয় না।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী পুলিশকে ব্যবহার করলেও সেই সময়ে পুলিশের যতখানি পেশাদারি মনোভাব ছিল, এখন তা নেই। ক্রমেই তা অপসৃত হচ্ছে। পরিণতিতে পুলিশ দায়িত্ব সম্পর্কে উদাসীন। অনেক ক্ষেত্রেই স্বেচ্ছাচারী। উপরন্তু অপকর্মের জন্য পুলিশকে বাহবা দেওয়া হচ্ছে, অবৈধ সুযোগ দেওয়া হচ্ছে; কিন্তু তাদের ন্যায্য বেতন-ভাতার দাবি বিবেচনায় আনা হচ্ছে না। অস্বীকার করা যাবে না যে, পুলিশ বিভাগ সর্বদাই উপেক্ষিত। বেশিরভাগ স্থানে পুলিশের কোয়ার্টার নেই। পরিবার-পরিজনকে দূরে বসবাস করতে হয়। চরম মানসিক অশান্তিতে তাদের থাকতে হয়। এর প্রতিফলনও পড়ে তাদের আচরণ ও কর্মকাণ্ডে। সঙ্গত কারণেই ভালো সেবা পেতে হলে পুলিশ ব্যবস্থার সংস্কারের পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বেতন-ভাতার কথা ভাবতে হবে।
জমিদার আমলে পেয়াদার কথা আমরা প্রবীণদের কাছ থেকে শুনেছি, গল্প-উপন্যাসে পড়েছি। পেয়াদার কাজ ছিল ফাও খাওয়া। সবকিছুতেই তারা ভাগ বসাত। পুলিশকে সেই পথে ঠেলে দেওয়ায় যেমন লঙ্ঘিত হচ্ছে আইনের শাসন, তেমনি ভাবমূর্তি হচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ।
তবে সুযোগ-সুবিধার অভাব পুলিশের অপরাধপ্রবণতা রক্ষার ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে না। পুলিশি ব্যবস্থার দ্রুত সংস্কার ও উন্নয়ন চাই। তবে তাদের করা গুরুতর অপরাধের জন্য কোনোক্রমেই নমনীয় নীতি গ্রহণ করা সঙ্গত নয়। যে পুলিশের হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
পুলিশ যা-ই করুক, তার দায় সরকারের ওপর বর্তাবেই। তাই এ বিষয়ে সরকারের একটি নীতিগত অবস্থান জরুরি। সেটি হচ্ছে, তারা হীন রাজনৈতিক স্বার্থে পুলিশকে ব্যবহার করবে না; নিয়োগ-পদোন্নতি-পোস্টিংয়ের ক্ষেত্রে আত্মীয়তা, আঞ্চলিকতা, দলীয় আনুগত্য বিবেচনায় আনা যাবে না। পুলিশ হবে সরকারের দলীয় প্রভাবমুক্ত নিরপেক্ষ সেবক বাহিনী।
পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মনে রাখতে হবে যে, তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী; কোনো দলের আজ্ঞাবহ নয়। সেবার সংস্কৃতিই পুলিশের ভূলুণ্ঠিত ভাবমূর্তি ফিরিয়ে দিতে পারে; অন্য কোনোভাবে তা সম্ভব নয়।

আবু সাঈদ খান :সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
 

No comments

Powered by Blogger.