সিয়াম সাধনার মাস ধর্ম-মাহে রমজানে তাহাজ্জুদ নামাজ by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

মাহে রমজানে রাত্রিকালীন ইবাদত-বন্দেগির মধ্যে মসজিদে ইতিকাফের সময় তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। বছরের অন্যান্য সময়ের মতো রমজান মাসে তাহাজ্জুদ নামাজের ব্যাপারে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। আরবি ‘তাহাজ্জুদ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ রাত্রি জাগরণ বা নিদ্রা ত্যাগ করে রাতে নামাজ পড়া।


ইসলামের পরিভাষায় রাত্রি দ্বিপ্রহরের পর ঘুম থেকে জেগে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য যে নামাজ আদায় করা হয় তা-ই ‘সালাতুত তাহাজ্জুদ’ বা তাহাজ্জুদ নামাজ। যিনি রাতে নিদ্রা থেকে জাগ্রত হয়ে নামাজ আদায় করেন, তাঁকে ‘মুতাহাজ্জিদ’ বলা হয়।
তাহাজ্জুদ নামাজ শুধু রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর ফরজ ছিল। এমনকি যখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হয়নি তখনো এ নামাজ নবী করিম (সা.)-এর ওপর বাধ্যতামূলক ছিল। তাই মহানবী (সা.) জীবনে কখনো তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া থেকে বিরত হননি। তবে উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য এটা সুন্নাতে গায়রে মুয়াক্কাদাহ অর্থাৎ এ নামাজ আদায় করলে অশেষ পুণ্য লাভ করা যায়, কিন্তু আদায় করতে না পারলে কোনো গুনাহ হবে না। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিয়তের সঙ্গে সওয়াবের আশায় মাহে রমজানের রোজা পালন করে, তার বিগত জীবনের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। আর যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের আশায় মাহে রমজানের রাতে কিয়াম করে তার বিগত দিনের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের আশায় লাইলাতুল কদরে কিয়াম বা রাত জেগে ইবাদত করে, তার বিগত জীবনের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।’ (বুখারি ও মুসলিম)
রমজান মাস ও অন্যান্য সময় তাহাজ্জুদ নামাজ রাত্রি দ্বিপ্রহরের পরে পড়তে হয়। মধ্যরাতে যখন লোকেরা গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন, তখন রোজাদার মুমিন বান্দা ঘুম থেকে জেগে ইবাদত-বন্দেগি করেন এবং সুবহে সাদিকের আগ পর্যন্ত তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করেন। সুবহে সাদিক হয়ে গেলে এ নামাজ আর পড়া যায় না। আর যদি রাত্রি দ্বিপ্রহরের পর নিদ্রা থেকে জাগ্রত হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে, তাহলে এশার নামাজের পর এবং বিতরের আগে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতে হয়। অবশ্য তাহাজ্জুদ নামাজ রাত দ্বিপ্রহরের আগে পড়লে সওয়াব কম পাওয়া যায়। আর রাতের শেষাংশে পড়লে সওয়াব বেশি পাওয়া যায়।
মাহে রমজানসহ বিভিন্ন সময় তাহাজ্জুদ নামাজ চার রাকাত পর্যন্ত পড়া যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাহাজ্জুদ নামাজ কখনো চার রাকাত, কখনো আট রাকাত এবং কখনো বারো রাকাত পড়েছিলেন। তাই রোজাদার ব্যক্তির তাহাজ্জুদ নামাজ কমপক্ষে চার রাকাত আদায় করা উচিত। কিন্তু যদি কেউ এ নামাজ দুই রাকাত আদায় করে তাহলেও তার তাহাজ্জুদ আদায় হবে। যে সময় নিদ্রা ও বিশ্রামের, তখন কষ্টকর হওয়া সত্ত্বেও ইবাদতে রাত্রি জাগরণ বা নামাজে দাঁড়ানোর মতো উত্তম কিছুই নেই।
রমজান মাসে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়কালে পবিত্র কোরআনের আয়াত খুব বেশি তিলাওয়াত করা উত্তম। এ জন্য আল্লাহর কোনো কোনো ওয়ালি দুই রাকাত তাহাজ্জুদ নামাজে ৩০ পারা কোরআন শরিফ তিলাওয়াত করতেন। প্রথম রাকাতে কোরআন মজিদের প্রথম ১৫ পারা এবং দ্বিতীয় রাকাতে শেষ ১৫ পারা তিলাওয়াত করতেন। যদি সম্পূর্ণ কোরআন মজিদ মুখস্থ না থাকে এবং দীর্ঘ দীর্ঘ সূরা মুখস্থ থাকে, তাহলে তাহাজ্জুদ নামাজে দীর্ঘ সূরা তিলাওয়াত করা উত্তম। আর যদি দীর্ঘ সূরাও মুখস্থ না থাকে তাহলে ১২ রাকাত তাহাজ্জুদ নামাজের প্রথম রাকাতে সূরা আল-ইখলাস ১২ বার, দ্বিতীয় রাকাতে ১১ বার, তৃতীয় রাকাতে ১০ বার, চতুর্থ রাকাতে ৯ বার অনুসারে দ্বাদশ রাকাতে একবার পড়তে হয়। আবার প্রতি রাকাতে সূরা আল-ইখলাস তিনবার অথবা একবার হিসেবেও পড়া যায়। আবার সূরা আল-মুয্যাম্মিল, আয়াতুল কুরসি এবং সূরা আল-ইনশিরাহও পড়া যায়।
রোজাদার ব্যক্তি যদি তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করে আল্লাহ তাআলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, মহান আল্লাহ তার পাপরাশি মার্জনা করে দেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমার প্রভু প্রতি রাতের শেষাংশে নিকটতম আসমানে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন, যে কেউ আমার কাছে প্রার্থনা করবে, আমি তা কবুল করব, যে কেউ কিছু প্রার্থনা করবে, আমি তা প্রদান করব, যে কেউ আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে, আমি তাকে ক্ষমা করব।’ (বুখারি ও মুসলিম)
রমজান মাসে রাত্রি জাগরণ করে যারা তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করে এবং অপরকে এ ব্যাপারে উৎসাহিত করে, তারা পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলার অপার রহমতের মধ্যে বিচরণ করে। নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ পাক ওই ব্যক্তির ওপর রহমত নাজিল করেন, যিনি রাতে নিদ্রা থেকে জেগে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করেন এবং তাঁর স্ত্রীকে নিদ্রা থেকে জাগিয়ে দেন। অতঃপর তিনি (তাঁর স্ত্রী) তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করেন। এমনকি যদি তিনি (স্ত্রী) ঘুম থেকে জাগ্রত হতে না চান, তাহলে তাঁর মুখে পানি ছিটিয়ে দেন।’ (আবু দাউদ ও নাসাঈ)
রোজাদার তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়কারী ব্যক্তি অধিক সম্মানের অধিকারী হন। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন যে ‘মুসলমানদের মধ্যে আল-কোরআনে অভিজ্ঞ ও তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়কারী ব্যক্তি সম্মানের অধিকারী হবেন।’ (বায়হাকি) হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে যে ‘তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়কারীর কবর ৭০ গজ প্রশস্ত হবে এবং তার কবর নূরে আলোকিত হয়ে যাবে।’
রমজান মাসে যেহেতু শেষ রাতে সেহির খাওয়ার জন্য জাগতেই হয়, আর সেহির খাওয়ার আগ পর্যন্ত শেষ রাত একান্ত পবিত্র দোয়া কবুলের সময়; তাই একটু আগেভাগে উঠে সেহিরতে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় অভ্যাসে পরিণত করে নেওয়া উচিত। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে মাহে রমজানের শেষ দশকে রাত্রি জাগরণ করে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির জন্য দোয়া এবং ইস্তেগফার করার তাওফিক দান করুন।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)।

No comments

Powered by Blogger.