জন্মদিন-কীর্তিময়ী এক নারীর কথা by জাহীদ রেজা নূর

বাড়ির বসার ঘরেই তিনি ছিলেন। মিষ্টি হাসি উপহার পেলাম। শিক্ষা সম্প্রসারণের জন্য কত কাজই না তিনি করেছেন! এখন, এই বয়সে এসেও শিক্ষাই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। পাঠক, আজ ড. সুলতানা সারওয়াত আরা জামানের ৮০ বছর পূর্ণ হলো। সুলতানা জামান নামে তিনি পরিচিত। তাঁকে আমাদের শ্রদ্ধা।


শুরু থেকেই কথা শুরু হয়। সেই সুদূর শৈশব যেন ফিরে এল তাঁর কথায়। ‘পড়াশোনা নিয়েই কেটেছে আমার সারাটা জীবন। যখন পেছনের দিকে ফিরে তাকাই, অনেক কিছুই আর মনে করতে পারি না। তবে কিছু কিছু বিষয় স্মৃতির আয়নায় এখনো স্পষ্ট হয়ে রয়ে গেছে।’
সেই মনে থাকা স্মৃতি থেকে কিছু বলবেন?
‘আমি যে সময়ের কথা বলছি, সে সময় আমি কলকাতার সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ি। একদিন শুনলাম, ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ বলে একটা কথা। শুনলাম, কলকাতার গড়ের মাঠে জিন্নাহ সাহেব বক্তৃতা করবেন। এরপর কী হলো জানি না, দেখলাম মারামারি-কাটাকাটি শুরু হয়ে গেল। আমাদের পাড়ার কাছে ৪ নম্বর পুলের মোড়ে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বেধে গেল। আমাদের পাড়ায় হিন্দুদের যেসব মিষ্টির দোকান ছিল, তা ভেঙেচুরে শেষ করে দেওয়া হলো। আমাদের পাশের বাড়িতে ছিল একটি হিন্দু পরিবার। ওরা আমাদের বাড়িতে এল আশ্রয়ের জন্য। এই পরিবারের মেয়েদের সঙ্গে আমরা খেলতাম। ওদের সঙ্গে কত নাটক করেছি, গান করেছি। বৃন্দাবন মাধুরী করেছি। আমার বড় বোন ওই বাড়িতে শকুন্তলা করেছে। আমরা আসলে হিন্দু-মুসলমান হিসেবে কখনো মানুষকে দেখিনি। আমাদের বাড়িটা ছিল খোলামেলা। এই বাড়িতে কী হচ্ছে না-হচ্ছে, তা বাইরে থেকে দেখা যায়।
‘আমার নানা শামসুল ওলামা কামালউদ্দীন আহমেদ ছিলেন ভারত ভাগের বিপক্ষে। তিনি পার্লামেন্টের মেম্বারও ছিলেন। আমার অনুজ কে জেড ইসলাম নানাকে বিরক্ত করার জন্য মিষ্টির দোকানের একটা হাঁড়ি এনে বাড়িতে রেখে দিয়েছিল। এতে তিনি খুবই রাগান্বিত হয়েছিলেন। আমরা একটা তিনতলা বাড়িতে থাকতাম। একতলায় থাকতেন নানা। দোতলা আর তিনতলায় থাকতাম আমরা। যখন দেশভাগের সিদ্ধান্ত হয়ে গেল, তখন বাবা খান বাহাদুর সিরাজুল ইসলাম সিদ্ধান্ত নিলেন চট্টগ্রামে চলে আসবেন।
‘আব্বা ছিলেন চট্টগ্রামের। সেখানে ভর্তি হলাম একটা স্কুলে। বিশ-ত্রিশের দশকে নাচ করতে দিয়েছেন। আমরা স্কুলে হেন কোনো নাটক ছিল না, যেটা করিনি। আমরা নাচ করতাম, ড্রিল করতাম। নাটক করতাম। পাকিস্তান যখন হয়ে গেল, আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে গেলাম। পরে চলে এলাম। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিলাম। চট্টগ্রামে এসে খুব ভালো লাগল। খুব শান্ত। এখানে যাচ্ছি ওখানে যাচ্ছি। একটা উপশহর তখন সেটা। ঘুরতাম। মজা করতাম। পাহাড়ের ওপর বাবা একটা বেড়ার ঘর করলেন। পাহাড়ে বাড়ি উঠতে সময় লাগবে। ব্যাম্বো প্যালেস নাম দিলেন।’
আপনার মায়ের কথা জানতে চাই।
‘বেড়ার ঘরে মা রাহাত আরা বেগম কোরআন শরিফ পড়তেন। চিল্লা করতেন। উর্দু লেখিকা তিনি। প্রশংসা পেয়েছিলেন। তেজবাহাদুর শপ্রু বলেছিলেন, মায়ের উর্দু খুব ভালো। সাতটা বই লিখেছেন। বাংলাদেশের বর্ণনা। মায়ের লেখা পড়লে মনে হবে যেন বাংলা বই পড়ছি। নামগুলো পর্যন্ত বাঙালি। তিনি উর্দুতে রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর অনুবাদ করেছিলেন।’
১৯৩৮ সালে ড. সুলতানা সারওয়াত আরা জামানকে তাঁর বাবা কলকাতার ইংলিশ মিডিয়াম ‘ডাইওসেসন’ স্কুলে ভর্তি করে দেন। ১৯৪৩ সালে তিনি সাখাওয়াত মেমোরিয়াল মুসলিম গার্লস হাইস্কুলে ভর্তি হন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হওয়ায় তাঁর বাবা চট্টগ্রামে চলে আসেন, তিনি থেকে যান সেখানে এবং অপর্ণাচরণ গার্লস স্কুল থেকে ১৯৪৮ সালে এসএসসি পাস করেন। ১৯৪৯ সালে চট্টগ্রামে সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং হলিক্রস কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগ থেকে ১৯৬৭ সালে এমএ এবং ১৯৭৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এমোরি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।
১৯৯০ সালে ছয় মাসের জন্য ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কাজ করেন। তিনি ৩৫টির বেশি আন্তর্জাতিক সেমিনারে উপস্থিত হয়ে গবেষণা বিষয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
১৯৭২ সালে ছিন্নমূল শিশু ও মহিলাদের সেবা প্রদানের লক্ষ্যে মালিবাগের গুলবাগে দীপশিক্ষা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। দেশে প্রতিবন্ধী শিশুদের করুণ অবস্থা এবং মায়েদের অসহায়ত্ব দেখে এদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, শিক্ষাদান এবং প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে বাংলাদেশে তিনি ‘সোসাইটি ফর দ্য কেয়ার অ্যান্ড এডুকেশন ফর মেন্টালি রিটার্ডেড চিলড্রেন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। বর্তমানে এটি ‘সুইড বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত। পরবর্তীকালে সব ধরনের প্রতিবন্ধী শিশুর সেবা প্রদানের লক্ষ্যে ১৯৮৪ সালে ‘বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন’ গড়ে তোলেন। তাঁর দক্ষ পরিচালনার জন্য এই প্রতিষ্ঠান দেশে-বিদেশে খ্যাতি অর্জন করছে।
১৯৯৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে বিশেষ শিক্ষায় শিক্ষক প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে স্পেশাল এডুকেশন বিভাগ চালু করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগ ২০০৮ সালে তাঁকে সুপারনিউম্যারি প্রফেসর পদে ভূষিত করে এবং একই সময়ে তিনি শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সম্মানিত প্রফেসর ইমেরিটাস পদ অর্জন করেন। একই বছর তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক বেগম রোকেয়া পদক-২০০৮ সম্মানে ভূষিত হন।
অনেক সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। শিক্ষার প্রসারে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়।
সুলতানা জামানের পুরো পরিবারই মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেন। তাঁর স্বামী মহান মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মরহুম কাজী নুরুজ্জামান বীর উত্তম। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর দুই মেয়ে ডা. নায়লা জামান খান এবং লুবনা মারিয়ামের ভূমিকা ছিল। মহিয়সী এই নারী আরও দীর্ঘদিন বেঁচে থাকুন, এই আমাদের কামনা।
জাহীদ রেজা নূর

No comments

Powered by Blogger.