কূটনীতি-যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ by হেনরি কিসিঞ্জার

একনায়কত্ববাদী সরকারগুলো স্বভাবগতভাবেই ভঙ্গুর, অভ্যন্তরীণ সমর্থনের জন্য এরা জাতীয়তাবাদী, সম্প্রসারণবাদী জজবা ও কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য। মার্কিন বাম ও দক্ষিণপন্থি উভয় অংশের তত্ত্বেই মনে করা হয়, চীনের অভ্যন্তরীণ কাঠামোর কারণেই


যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনা ও সংঘাত বৃদ্ধি পাচ্ছে২০১১ সালের জানুয়ারিতে হু জিনতাওয়ের ওয়াশিংটন সফরের শেষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং চীনা প্রেসিডেন্ট এক যৌথ বিবৃতি প্রদান করেন। এতে 'চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে ইতিবাচক, সহযোগিতামূলক ও সমন্বিত' বলে ঘোষণা করা হয়। তাদের উভয়েই একে অপরের প্রধান উদ্বেগের বিষয়কে বিবেচনা করার ব্যাপারে পুনরায় প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। যুক্তরাষ্ট্র পুনরায় প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে যে, শক্তিশালী, সমৃদ্ধিশালী ও সফল চীনের বিশ্ব বিষয়াবলিতে অবদান রাখাকে তারা স্বাগত জানান। চীনও যুক্তরাষ্ট্রকে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় শক্তি হিসেবে মেনে নেয় এবং ঘোষণা করে যে, বেইজিং চায় ওয়াশিংটন ওই এলাকার শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধিতে অবদান রাখুক। তখন থেকেই দুটি দেশের সরকারকে তাদের ঘোষিত নীতি বাস্তবায়নে কাজ করতে দেখা যায়। শীর্ষ স্থানীয় মার্কিন ও চীনা কর্মকর্তাদের সফর বিনিময় হয় এবং গুরুত্বপূর্ণ, কৌশলগত ও অর্থনৈতিক ইস্যুর বেলায় উভয়পক্ষই তাদের আলাপ-আলোচনাকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করার প্রয়াস পায়। দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে যোগাযোগ পুনরায় শুরু হয়, এর মাধ্যমে একটা গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ চ্যানেল উন্মুক্ত হয় এবং বেসরকারি পর্যায়ে তথাকথিত 'ট্রাক-টু' গ্রুপের মাধ্যমে মার্কিন-চীন সম্পর্ক উন্নত করার প্রচেষ্টা জোরদার করার উদ্যোগ অব্যাহত থাকে।
তবে সহযোগিতা বৃদ্ধি পেলেও মতান্তর অব্যাহত থাকে। উভয় দেশের গুরুত্বপূর্ণ গ্রুপগুলোর অনেকেই চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা অবশ্যম্ভাবী এবং এটা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে বলে দাবি করতে থাকে। এই পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সহযোগিতার পক্ষে আবেদন জানানোটা অচল, এমনকি অর্বাচীনতা মনে হতে পারে।
প্রত্যেক দেশের একই ঘটনা নিয়ে বিশ্লেষণে পারস্পরিক দোষারোপের চিত্র ফুটে ওঠে। কতিপয় কৌশলগত চিন্তাবিদ মনে করেন, চীনা নীতির দুটি দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য রয়েছে : এর একটি হলো পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রগণ্য অবস্থান খর্ব করা এবং চীনের অর্থনৈতিক ও পররাষ্ট্রনীতির স্বার্থের অনুকূলে এশিয়াকে একটি ব্লক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। এ ধারণা পোষণকারীরা মনে করেন, যদিও চীনের সামরিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ নয়, তথাপি এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, ওয়াশিংটনের সঙ্গে সংঘাতের ঝুঁকি নেওয়ার মতো সামর্থ্য বেইজিংয়ের রয়েছে এবং তারা এই অঞ্চলে ওয়াশিংটনের কর্তৃত্ব খর্ব করার জন্য ক্রমবর্ধমানভাবে অত্যাধুনিক সহায়-সম্পদ সমাবেশ করছে। বেইজিংয়ের ভাণ্ডারে থাকা পরমাণু অস্ত্রের অব্যর্থ 'সেকেন্ড-স্ট্রাইক' হানার ক্ষমতার সঙ্গে ক্রমাগত আওতা বেড়ে চলা মাঝারি পাল্লার নৌ-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং সাইবার স্পেস ও মহাকাশ ক্ষেত্রে নতুন অবস্থান তাকে শক্তি জোগাচ্ছে। চীন তার আশপাশের দ্বীপপুঞ্জকে দিয়ে ওই অঞ্চলে একটি প্রধান নৌশক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেন, চীন এভাবে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে ফেলতে পারলে বেইজিংয়ের সঙ্গে বাণিজ্য ক্ষেত্রে ওতপ্রোতভাবে জড়িত দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের উপযুক্ত প্রত্যুত্তর প্রদানের কোনো আলামত না দেখলে তারা তাদের নীতি অদলবদল করে চীনকেই অগ্রাধিকার প্রদান করবে। পরিণামে এটাই পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় প্রাধান্য বিস্তারকারী চীনকেন্দ্রিক এশিয়া ব্লকের জন্ম দেবে। এ ধরনের উপলব্ধির একটা প্রতিফলন ইঙ্গিতে হলেও অতিসাম্প্রতিক মার্কিন নিরাপত্তা নীতিতে পাওয়া যাবে।
তবে চীনের কোনো সরকারি কর্মকর্তা এ ধরনের কৌশল বেইজিংয়ের প্রকৃত নীতি বলে স্বীকার করেননি। অধিকন্তু তারা এর বিপরীত ভাষ্যই দিয়েছেন। তবে দৃশ্যত চীনা সরকারি প্রেস ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর বক্তব্য থেকে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক সহযোগিতার পরিবর্তে ক্রমবর্ধমানভাবে সংঘাতের দিকে ধাবিত হচ্ছে মর্মে যথেষ্ট যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত উদ্যোগগুলো সমগ্র অগণতান্ত্রিক বিশ্বের লড়াইয়ের আদর্শগত উপলব্ধিসঞ্জাত। কেউ কেউ মনে করেন, একনায়কত্ববাদী সরকারগুলো স্বভাবগতভাবেই ভঙ্গুর, অভ্যন্তরীণ সমর্থনের জন্য এরা জাতীয়তাবাদী, সম্প্রসারণবাদী জজবা ও কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য। মার্কিন বাম ও দক্ষিণপন্থি উভয় অংশের তত্ত্বেই মনে করা হয়, চীনের অভ্যন্তরীণ কাঠামোর কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনা ও সংঘাত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা মনে করেন, সহযোগিতার জন্য লালায়িত না হয়ে বৈশ্বিক গণতন্ত্রে উত্তরণের মাধ্যমেই শাশ্বত শান্তি আসতে পারে। এখানে উদাহরণ হিসেবে রাজনৈতিক বিজ্ঞানী অ্যারন ফ্রিডবার্গের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যায়। তিনি তার লেখায় বলেছেন, উদার গণতান্ত্রিক চীনের গণতান্ত্রিক প্রতিপক্ষের কাছ থেকে ভয়ের তেমন কিছু নেই...। অতএব যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে, সেখানে এমন একটি বিপ্লবকে (অবশ্যই শান্তিপূর্ণ) প্রণোদনা দেওয়া, যেটা চীনের একনায়কত্ববাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে এবং তার স্থলে উদার গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করবে।
চীনের দিক থেকে এই সংঘর্ষমূলক ভাষ্যে উল্টো যুক্তিকে নির্দেশ করে। তারা মনে করে, আঘাতপ্রাপ্ত পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র চ্যালেঞ্জারের উত্থানকে মেনে নিতে নারাজ এবং তারা একে প্রতিহত করতে বদ্ধপরিকর। এ ক্ষেত্রে চীনই হলো যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তিগ্রাহ্য প্রধান চ্যালেঞ্জার বলে তারা মনে করেন। চীন যত জোরালোভাবেই সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা করতে চাক না কেন কিছু চীনা মনে করে, যুক্তরাষ্ট্র সামরিক বাহিনী মোতায়েন, চুক্তির মাধ্যমে চীনের বেড়ে ওঠাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চায়। এভাবেই যুক্তরাষ্ট্র চীনকে তার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখতে চাইছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে কোনো সহযোগিতা হলো আত্মবিনাশী। এটা আসলে চীনকে নিষ্ক্রিয় করার মার্কিন কৌশলকে রূপায়িত করতে সাহায্য করবে বলে এসব চীনা মনে করে।
মার্কিন সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত প্রভাবকেও মাঝে মধ্যে শত্রুভাবাপন্ন কার্যকলাপ হিসেবে দেখা হয় এবং এসব চীনের অভ্যন্তরীণ ঐকমত্য গড়ে ওঠা ও ঐতিহ্যগত মূল্যবোধের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী বলে মনে করা হয়। অত্যন্ত জোরালোভাবে বলা হয়, চীন বৈরী প্রবণতার মুখেও অসঙ্গতভাবে অক্রিয় এবং চীনকে তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে (যেমন_ দক্ষিণ চীন সাগরের ভূখণ্ডগত ইস্যু) যেসব বিরোধ রয়েছে সেগুলোকে নিয়ে স্ট্র্যাটেজিক বিশ্লেষক লং তাওয়ের ভাষায় অগ্রাধিকার দিয়ে ভাবতে হবে এবং ধীরে ধীরে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই আঘাত হানতে হবে, কিছু ছোটখাটো লড়াই প্ররোচনাদানকারীদের আগ বাড়িয়ে কিছু করা থেকে বিরত রাখবে।

হেনরি কিসিঞ্জার :নোবেল বিজয়ী মার্কিন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা
ভাষান্তর করেছেন সুভাষ সাহা
 

No comments

Powered by Blogger.