সরল গরল-সেনাশাসন রোধ: পাকিস্তানের পথে বাংলাদেশ? by মিজানুর রহমান খান

পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতির এত মিল নিশ্চয় ভালো নয়। ভবিষ্যতে আরও যাতে মিল না বেরোয়, সে জন্য এখনই যা যা করা দরকার, তা-ই করা উচিত। রাজনীতির পাকিস্তানিকরণ এখনই সহনীয় ঠেকছে না। বিশেষ করে, সংবিধান সংশোধন করে সামরিক শাসন চিরতরে আটকানোর যে প্রচেষ্টা চলছে, সেটা সামনে রেখে এই লেখার অবতারণা।


আসমা জিলানির মামলার রায়ের আদলে আমরা দুটি রায় পেলাম। পঞ্চম সংশোধনীর পর সপ্তম সংশোধনী। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ভাগ্যবান! তাঁরা এমন এক সময়ে আসমা জিলানির ওপর দাঁড়ালেন, যখন পাকিস্তানও সবে আসমা জিলানির ওপর দাঁড়িয়েছে। জেনারেল পারভেজ মোশাররফ আর জেনারেল এরশাদ এখন একই মেজাজে। জেনারেল পারভেজ ১৯৯৯ সালে ক্ষমতা নিলেন। বেনজির ও পিপিপি তখন তাঁকে সমর্থন দিয়েছিল। এরশাদ ১৯৮২ সালে ক্ষমতা নিলেন। আওয়ামী লীগের তত্কালীন দলীয় মুখপত্র সাংসদ শেখ সেলিম সম্পাদিত বাংলার বাণীতে সম্পাদকীয় বেরোল—নতুন দিনের যাত্রা। এই অঞ্চলে সেনাশাসন জায়েজ করার পথিকৃৎ পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট। কী করে নাজায়েজ করতে হয়, তারও তরিকা প্রথম বাতলে দেন পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট। দুটি মামলায় দুটি মতবাদ। প্রথমে ‘দোসো’। পরে ‘আসমা জিলানি’। দোসোতে সেনাশাসন জায়েজ, আসমা জিলানিতে নাজায়েজ। পাকিস্তানে মেরি গো রাউন্ড চলছে।
১৯৫৮-তে সর্বাগ্রে এলেন আইয়ুব খান। তিনি প্রথম জায়েজ হলেন রাষ্ট্র বনাম দোসো মামলায়। ইয়াহিয়া নাজায়েজ হলেন আসমা জিলানিতে। ১৯৭৭ সালে জিয়াউল হক জায়েজ হলেন দোসোতে। দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু ঘটল। এরপর কেটে গেল ২২ বছর। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট পঁচাত্তর থেকে মুন সিনেমা পর্যন্ত দোসোতে ছিল। তখন পর্যন্ত তাঁরা সেনাশাসন ও সেনা আদালতকে বৈধ বলেছেন। এরই মধ্যে পাকিস্তানে পারভেজ এসে গেছেন। সিনেমা হল নিয়ে মামলা হলো ঢাকায়। এটাই এখন খ্যাতনামা পঞ্চম সংশোধনী মামলা। এর যখন শুনানি হচ্ছিল, তখন পাকিস্তানে অবশ্য ‘দোসো’ চলছে। জেনারেল জিয়াউলের পথে জেনারেল পারভেজ এলেন। যথারীতি তাঁর বৈধতা চ্যালেঞ্জ হলো। পারভেজকে বৈধ বললেন পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট। সেটা ছিল ২০০০ সাল। বাংলাদেশে ২০০৫ সাল এল। মোশতাক-সায়েম ও জিয়া অবৈধ হলেন। আসমা জিলানি জয়ী হলো, দোসো পরাস্ত হলো। এরপর আমরা দেখলাম, ক্ষমতাসীন জেনারেল মোশাররফের কার্যক্রম সুপ্রিম কোর্ট বৈধ করেন; আবার ক্ষমতা হারানোর পর অবৈধ করলেন। আজ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন কোনো জেনারেল-নৃপতির কাণ্ডকীর্তি অবৈধ বলে গণ্য হলো না।
পাকিস্তানে নওয়াজ-বেনজির জুটির গণতন্ত্র চলছিল। সম্পর্ক চুলোচুলি। সংবিধানে বেয়নেটের ক্ষত ছিল। জিয়াউলের রেখে যাওয়া অষ্টম সংশোধনী ছিল চরম অগণতান্ত্রিক। কিন্তু ক্ষত সারানোর সময় কোথায়? চুলোচুলি চলছিল অবিরাম। বাংলাদেশের অবস্থার সঙ্গে তুলনীয়। হয়তো তক্কে ছিলেন সর্বদা ‘স্বদেশজয়ে নিবেদিত বীরগণ’। তাঁদের নায়ক জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। তিনি সুযোগ নিলেন। ১৯৯৯ সালে ক্ষমতায় এলেন। সংবিধান স্থগিত করলেন। সংসদ বাতিল করলেন। ‘গণতন্ত্রের কন্যা’ বেনজির মুচকি হাসলেন। নীরবে সম্মতি দিলেন। ঢাকায় এরশাদকে নিয়ে একই ঘটনা ঘটেছিল। এরশাদ ক্ষমতা নিলেন। আগে যা ঘটেনি, তা-ই ঘটালেন। সংবিধান সম্পূর্ণ স্থগিত করলেন। শেখ হাসিনা মুচকি হাসলেন। আওয়ামী লীগের মুখপত্র ছিল বাংলার বাণী। এর সম্পাদক ছিলেন সাংসদ শেখ ফজলুল হক সেলিম। বাংলার বাণীতে সম্পাদকীয় ছাপা হলো। বলা হলো, নতুন দিগন্তে যাত্রা। তারপর রক্তাক্ত আন্দোলন হলো। নূর হোসেনরা শহীদ হলো। সেই ইতিহাস সবার জানা।
পারভেজ মোশাররফ ক্ষমতা নিয়ে যা যা করলেন, তা সব সামরিক শাসকই করেন। স্রষ্টা হয়তো অলক্ষে হাসছিলেন। একদা একত্রে থাকা দুটি দেশ ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা নিয়ে একই সময়ে খাবি খেল। এবার এগিয়ে বাংলাদেশ। মডেল যেন জেনারেল মইন। তাঁকে অনুসরণ করলেন জেনারেল মোশাররফ। মইন দিলেন রাজনৈতিক অরাজকতা ও দুর্নীতির দোহাই। মোশাররফ অভিনবত্ব আনলেন। তিনি দোষ চাপালেন সুপ্রিম কোর্টের ওপর। ফরমানেই বললেন, আদালত বাড়াবাড়ি করছেন। তাঁদের কারণে শাসনকার্যে বিঘ্ন ঘটছে। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে আর নভেম্বরে জরুরি অবস্থা এল পাকিস্তানে। তার পরও কত্ত মিল! পর্দার অন্তরালে আপস অনিবার্য হয়ে ওঠে। জেনারেল মইন গঠন করেন ট্রুথ কমিশন। লক্ষ্য, হাত বাছাই করা ধনকুবেরদের মার্জনা করা। জেনারেল মোশাররফ তখন পাস করলেন এনআরও। এনআরও মানে হলো, ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন অর্ডিন্যান্স। উদ্দেশ্য একই।
ঢাকার সেনাসমর্থিত প্রশাসন যখন শেখ হাসিনার দিকে ঝুঁকছে, ইসলামাবাদের সেনা প্রশাসন তখন বেনজিরের দিকে ঝুঁকছে। বলা বাহুল্য, এ ধরনের ‘পক্ষপাত’ কিংবা অসহায়ত্ব সেনাশাসনের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা। অদৃশ্য বিদেশি হাত উভয় রাজধানীতে সক্রিয় ছিল। পাকিস্তানে এনআরও জারির পেছনে ছিল ইঙ্গ-মার্কিন সক্রিয় দূতিয়ালি। ‘নিরপেক্ষতা’ বজায় রাখতে বেনজির ও নওয়াজ উভয়কে আপাতত ধরাশায়ী করেছিলেন মোশাররফ। তাঁর মাইনাস টু ফর্মুলা দীর্ঘ সময় কাজ করেছে। ১৯৯৯ পরবর্তী কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করলেন তিনি। ২০০৭ সালে তিনি সেনাশাসনের ধর্মমতে চোরাগুপ্তা আপস করেন। বাংলাদেশেরও একই রকম আপস-কাহিনি আছে। সেনাশাসন কিংবা সেনা হস্তক্ষেপের প্রতিটি পর্বে এটা দেখা গেছে। এনআরওর আওতায় পাকিস্তান আঁতাত দেখল। জারদারি-বেনজির স্বামী-স্ত্রী। তাঁদের চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী দুর্নীতির মামলাগুলো তুলে নেওয়া হলো। আরও অনেক বাছাই করা রুই-কাতলাও জাল থেকে বেরিয়ে গেল। প্রায় সাড়ে তিন হাজার মামলা। তাতে খুন, ধর্ষণ থেকে বিরাট অঙ্কের ঋণখেলাপির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিরাও ছিল। গত মাসে পাকিস্তানে এর তালিকা প্রকাশ পেয়েছে। আট হাজার সুবিধাভোগীর মধ্যে মাত্র ৩৪ জন রাজনীতিক। বাকিরা আমলা। আর তাঁদের মধ্যে সাত হাজারের বেশির নিবাস বেনজিরের নিজ এলাকা সিন্ধে। জেনারেল মইনরা টিকে গেলে এ ধরনের পুনরাবৃত্তি হয়তো আমরা দেখতাম। অবশ্য ব্যক্তি না টিকলে কী হবে। সিস্টেম তো বদলায়নি। পাকিস্তানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঘটনার পুনরাবৃত্তি থেমে নেই। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারের নেকনজরে থাকা ব্যক্তিদের এখন পোয়াবারো। তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের করা গুরুতর ফৌজদারি মামলা তোলার হিড়িক পড়েছে। সাজেদা চৌধুরীর ছেলে মার্জনা পান, ডা. ইকবাল বেকসুর হন।
আট বছরের নির্বাসিত জীবন কাটান বেনজির। মার্কিন মদদে ২০০৭ সালের অক্টোবরে বেনজির এলেন রাজনীতির মঞ্চে। ডিসেম্বরেই খুন হলেন। দৃশ্যপট বদলাল দ্রুত। মোশাররফের বিদায়ঘণ্টা বাজল। বৈরী পরিবেশে নির্বাচন হলো ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। নতুন সরকার হলো। ইমপিচমেন্ট এড়াতে মোশাররফ আগস্টে পদত্যাগে বাধ্য হলেন। ২০০৩ সালে তাঁর ক্ষমতা জবর দখলের অপকর্ম বৈধ করেছিল সংসদ। এবারের সংসদ বেঁকে বসল।
বেনজির ও নওয়াজ শরিফ নির্বাসিত জীবন যাপন করছিলেন। গণতন্ত্রে তাঁরা যা পারেননি, বন্দুকের ডগায় দোল খেয়ে বিদেশের মাটিতে তা-ই পেরেছিলেন। তাঁরা ঐক্য করেছিলেন। গণতন্ত্র সনদে সই করেছিলেন। কিন্তু তলে তলের সমঝোতা বলে কথা। নওয়াজ কখন দূরে সরে গেলেন। ঢাকায় ২০০৭ সালে আমরা কিন্তু মোটামুটি একই দৃশ্য দেখলাম। মইন উ আহমেদ বঙ্গভবনে গেলেন। ইয়াজউদ্দিন ক্ষমতা ছাড়লেন। সামনে ফখরুদ্দীন এলেন। পেছনে রইলেন মইন উ আহমেদ। শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে হাসলেন। বঙ্গভবন তার সাক্ষী।
পতিত জেনারেল পারভেজের বিরুদ্ধে নানা পর্যায়ে আদালতে মামলা হয়। পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট প্রথমে ২০০০ ও পরে ২০০৮ সালেও ‘ক্ষমতাসীন’ পারভেজকে বৈধতা দিয়েছিলেন। ২০০৩ সালে সংবিধান সংশোধন বিল পাস হয়। গণতন্ত্রের পথে যাত্রা করেছিল পাকিস্তান, বাংলাদেশ ১৯৭৯ ও ১৯৮৬ সালে যেমন গণতন্ত্রে যাত্রা করেছিল। তফাত হলো, পারভেজ আমাদের জিয়া ও এরশাদের মতো দল করেননি। পারভেজ পাকিস্তানের ইতিহাসে ব্যতিক্রমী সেনাশাসক। তিনি ভানুমতির খেলা দেখালেন। দুবার সামরিক শাসন জারি করলেন। ২০০৭ সালের ৩ নভেম্বর। তখন বিতর্ক তুঙ্গে। তিনি উর্দি ছাড়বেন কি ছাড়বেন না। ৩ নভেম্বর হঠাৎ জারি করেন জরুরি অবস্থা। তখন তিনি রাষ্ট্রপতিও। জরুরি অবস্থার ফরমানে সই দিলেন সেনাপ্রধান হিসেবে, রাষ্ট্রপতি হিসেবে নয়। পাকিস্তানি স্টাইল হলো, প্রথমেই সংবিধান স্থগিত করা। একই সঙ্গে জারি করা হবে পিসিও। পিসিও মানে, প্রভিশনাল কনস্টিটিউশনাল অর্ডার। মানে, পকেট থেকে একটি নতুন সংবিধান বের হবে। তখন সদ্য পয়দা নেওয়া তথাকথিত সংবিধানের অধীনে বিচারকেরা নতুন করে শপথ নেবেন। দেখা গেল, তত্কালীন প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরীসহ প্রায় ৬০ জন বিচারক নতুন সেনাশাসকের কোপানলে। এই বিচারপতিরা শপথ নিলেন না। নতুন প্রধান বিচারপতি হলেন আবদুল হামিদ দোগার। শপথ নিয়ে তিনি পারভেজের সব ফরমান বৈধ করলেন। তবে এবারে ভয়ংকর ঘটনা ঘটল। ৩ নভেম্বরে প্রধান বিচারপতি ইফতিখার চৌধুরী বরখাস্ত হলেন। এদিনই তাঁর নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের সুপ্রিম কোর্ট বেঞ্চ একটি ‘ঐতিহাসিক’ আদেশ দেন। এতে পিসিওর অধীনে বিচারকদের শপথ গ্রহণ নিষিদ্ধ হয়। এমনকি সশস্ত্র বাহিনীকে সরকারের অবৈধ আদেশ না মানতে বলা হয়। এর ফল দাঁড়াল, ১১১ ব্রিগেড অভিযান চালাল সুপ্রিম কোর্টে। বিচার বিভাগ প্রায় আক্ষরিক অর্থেই দুই ভাগ হয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত শুভশক্তি জয়ী হলো। জেনারেল পারভেজের পায়ের মাটি সরে গেল। ২০০৭ সালের নভেম্বরে তিনি উর্দি ত্যাগ করেন। সুপ্রিম কোর্ট শক্তি সঞ্চয় করলেন, ঊর্মিমুখর দেড় বছর পরে প্রধান বিচারপতি পদে ইফতিখার চৌধুরী ফিরে এলেন সগৌরবে। ৩১ জুলাই ২০০৯ সবশেষ ঐতিহাসিক রায় এল। এই রায়ে ক্ষমতাহারা পারভেজ মোশাররফ সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে তুলোধুনো হলেন। তদুপরি তিনি প্রায় নয় বছরের বৈধ শাসক হয়েই থাকলেন।
আমাদের হাইকোর্ট বিভাগের সর্বশেষ রায় জেনারেল এরশাদকে ১৯৮২-১৯৮৬ মেয়াদে অবৈধ বলেছে বলে পত্রিকান্তরে জেনেছি। কিন্তু তাঁর পরের চার বছর মেয়াদে কি তাঁকে আমরা বৈধ শাসক বলে মানব? আদালত রায় দিয়েছেন বলে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি অবৈধ। আর আদালত রায় দেননি বলে ১৯৮৬ সালের ১২ নভেম্বর থেকে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি বৈধ? আমরা স্মরণ করতে পারি, ১৯৯০ সালের ১০ আগস্ট সর্বসম্মতিতে সংসদের একাদশ সংশোধনী পাস হয়েছিল। এর মাধ্যমে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ বৈধতা পান। এই বিলের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছিল, ‘এরশাদের অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক সরকারকে অপসারণ করে আমরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছি।’ তাহলে কাঁচা প্রশ্ন দাঁড়াল, হাইকোর্ট বড়, না সংসদ বড়?
পাকিস্তানের প্রসঙ্গে ফিরি। প্রধান বিচারপতি ইফতিখার চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ১৪ সদস্যের বেঞ্চ বিচারকদের বিচারে বসলেন। তাঁরা ‘অবৈধ’ প্রধান বিচারপতি দোগারের পরামর্শে মোশাররফ কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত সব বিচারকের চাকরি খেলেন। তাঁদের বাড়িতে পাঠালেন। তবে সেই সঙ্গে রায় দিলেন বিচারকদের জন্য পালনীয় আচরণবিধিতে একটি নতুন বিধি যুক্ত করা হবে। এতে বলা হলো, কোনো বিচারক অসাংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতা গ্রহণকারীদের শপথ দেবেন না। কেউ দিলে তিনি পেশাগত অসদাচরণের জন্য অভিযুক্ত হবেন। এক দিন আমি আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদকে এ কথা বললাম। তিনি সায় দিলেন, এমন একটি বিধান আমাদেরও থাকতে পারে। ওবায়দুল কাদের চলতি সপ্তাহে এমন একটা নির্দেশনা উচ্চ আদালতের কাছে আশা করেছেন।
পাকিস্তানে প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? আমরাও কিন্তু এরই মধ্যে একই প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে।
আসিফ জারদারি ও পিপিপির এখন মনে পড়ছে, জেনারেল পারভেজের প্রতি তারা তো কৃতজ্ঞ। এমনকি নওয়াজের মুসলিম লীগ এখন বলছে, মোশাররফ রাজনীতিতে ফিরে এলে তারা তাঁকে স্বাগত জানাবে। দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহার করা না হলে জারদারির রাষ্ট্রপতি হওয়া কঠিন ছিল। কৃতজ্ঞ জারদারি তাই অবৈধ স্বৈরশাসক পারভেজকে চরম বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে কাঠগড়ায় তুলতে অপারগ। প্রধানমন্ত্রী জিলানি যা বলেন আমাদের এখানেও একই রা। সেনাশাসন রোধে আমাদের এখানে পাকিস্তানি কায়দাকানুন আমদানির কসরৎ চলছে। থাকলে কি হতো? সেটা আপনরা জিলানির বাণী থেকে শুনুন। তিনি যা বলেছেন তা শুনে মনে হবে তিনি ঢাকার শাসকগোষ্ঠীর বেহাল অবস্থার বিবরণ দিচ্ছেন। ‘তাঁর (পতিত স্বৈরশাসক মোশাররফ) বিচার প্রশ্নে সংসদকে সমঝোতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অবৈধ ক্ষমতা দখলের দায়ে ব্যক্তির তো বিচার হয় না। তা ছাড়া মোশাররফের সহযোগীরা আমাদের মন্ত্রিসভায় আছেন, মুসলিম লীগেও আছেন। সংসদ যদি সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে আমি স্বাগত জানাব।’ ইত্যাদি। পাঠক, লক্ষ করুন, এই একই বোল বাংলাদেশেও। বোল মানে আবোলতাবোল। আসলে বাংলাদেশেও এরশাদের প্রতি একই ধরনের কৃতজ্ঞতা ও অদৃশ্য সুতার কেরামতি চলছে। শেখ হাসিনা একা নন, তাঁর কাছে বেগম খালেদা জিয়ারও রয়েছে কত ঋণ!
আইন থাকতে আইন নেই বলা হচ্ছে। এরশাদও সবক দিচ্ছেন তাঁকে বিচার করতে দেশে আইনের আকাল পড়েছে। আকাল পড়েছে নৈতিকতার। তবে যে কথা বলার জন্য এই লেখা, সেটি হলো, নতুন আইন করা। সংবিধান সংশোধন করা ও নতুন আইন সৃষ্টি করা থেকে শাসকগোষ্ঠীকে ঠেকানো যাবে না। শিগগিরই গণমাধ্যম ‘ঐতিহাসিক নবযাত্রা’ শীর্ষক সম্পাদকীয় লিখবে। ঠেকানো যাবে না। তবে একটি পাকিস্তানি প্রহসন সম্পর্কে সতর্ক করতে চাই।
১৯৭৩ সালে পিপিপি সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদে অবৈধ ক্ষমতা দখলকে চরম বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। সংসদে পাস করা হয়েছিল দি হাইট্রিজন (পানিশমেন্ট) অ্যাক্ট ১৯৭৩। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ১২৪ ও ১২৪ক ধারায় এরশাদের মতো জবরদখলকারীদের শাস্তির বিধান আছে। সেনা আইনেও আছে। তবে আমজনতার নাগালে সেনা আইন নেই। ওটা শাসকের করায়ত্তে। আমজনতা চাইলে দণ্ডবিধির আওতায় থানায় গিয়ে অন্তত একটা মামলা দায়ের করতে পারে। ১৯৭৩ সালে পিপিপি নতুন আইন করে পাকিস্তানের জনগণের সঙ্গে একটি প্রতারণা করেছিল। বাংলাদেশে যেন তার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। তবে সেটা ঘটার আশঙ্কা করি। পিপিপিকে বেনিফিট অব ডাউট দিতে রাজি আছি। আওয়ামী লীগ তা নকল করলে তাকে তা দেওয়া যাবে না।
১৯৭৩ সালের ওই আইনে অবৈধ ক্ষমতা দখলের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়। কিন্তু জনগণ যাতে এ ধরনের অপরাধীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের না করতে পারে, সে ব্যবস্থাটা পাকা রাখা হয়। আমার কখনো মনে হয়, বাংলাদেশে সামরিক শাসন হলো শাসকগোষ্ঠীর পাতানো খেলা। সামরিক শাসন ও গণতন্ত্রে উত্তরণ একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। পাকিস্তানের জন্য এ কথা চরম সত্য ছিল। সে কারণে পাকিস্তান দণ্ডবিধির আওতায় জবরদখলকারীর বিরুদ্ধে জনগণের মামলা দায়েরের অধিকার খর্ব করা হয়। আইনে বলা হয়, ‘কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন ছাড়া কারও বিরুদ্ধে চরম বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে মামলা করা যাবে না। কেউ করলেও কোনো আদালত তা আমলে নিতে পারবে না।’ আমরা এমন কোনো বিধান চাই না, দণ্ডবিধির প্রয়োগ চাই আগে। নতুন আইন করার আরেকটি মাজেজা হলো এরশাদকে ছাড় দেওয়া। নতুন আইনে অতীত অপরাধের বিচার করা যাবে না।
আরও একটি পরিহাসের কথা বলে শেষ করি। পাকিস্তান গত মধ্য জুলাইয়ে সংবিধান সংশোধন করেছে। ক্ষমতা জবরদখলকারীদের শপথ পড়ালে বা তাঁদের শাসনের বৈধতা দিলে বিচারকদেরও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে। এই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ হয়েছে। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্ট বেঞ্চ একই অপরাধকে অপসারণযোগ্য বলেছেন। সেই একই সুপ্রিম কোর্ট বেঞ্চ কিন্তু এই সংশোধনীতে সন্তুষ্ট নন। প্রধান বিচারপতি এক শুনানিকালে বলেন, ‘পরিস্থিতি যেমনই কল্পনা করা হোক না কেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত রাখতে হবে (ডন, ৩ জুন ২০১০)।
চারদিকে প্রশ্ন উঠেছে, আইন করে সামরিক শাসন রোধ করা সম্ভব? আরেকটি প্রশ্ন তুলি, সর্বশেষ পাকিস্তানি মডেল অনুসরণ করলেও কি তা সম্ভব? জায়েজ-নাজায়েজের চক্র তো আমরা দেখলাম। তাহলে কী করতে হবে? এটা সন্দেহাতীত, পাকিস্তানের দেখানো পথে সমাধান নেই, মুক্তি নেই। তবে জারদারি যেভাবে স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ত্যাগ করে সংবিধান সংশোধন করেছেন, সেটি একটি ভালো দৃষ্টান্ত।
বাংরাদেশে সর্বাগ্রে সংবিধানের সত্তর অনুচ্ছেদ শুধরে চরম আজ্ঞাবহ সংসদকে স্বাধীন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমাতে হবে। তাহলে সংসদ হবে সবকিছুর প্রাণকেন্দ্র। বিচার বিভাগ, সংবাদক্ষেত্র বা অন্য কোনো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের শক্তি চূড়ান্ত অর্থে হাউস অব দ্য নেশন (সংসদ) ও তার সংস্কৃতিকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.