সংবাদ ব্রিফিংয়ে সিপিডির মূল্যায়ন-বাজেট ব্যাকরণসিদ্ধ, বাস্তবসম্মত নয়

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১২-১৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করেছেন সহজ রাস্তায়। কোনো সৃজনশীলতা এখানে নেই। নেই কোনো চমক, উদ্ভাবনীর আকর্ষণ। আবার নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক বিবেচনার সঙ্গে ব্যয়নীতি গ্রহণেরও সামঞ্জস্য পাওয়া যাচ্ছে না।


নির্বাচনের আগের বছর এসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে চুক্তি করে মাত্র ১০০ কোটি ডলার ঋণ করতে গিয়েই এ অবস্থা হয়েছে বলে মনে করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
সিপিডির বিশেষ ফেলো ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এককথায় বাজেট সম্পর্কে বলেন, ‘এত সুন্দর দেখা যাচ্ছে যে সত্য বলে মনে হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রীর রাজস্ব আয়ের চেষ্টা একটা ‘ইন্দ্রজাল’ অবস্থা তৈরি করেছে। সামগ্রিক বাজেট ব্যাকরণ ও প্রথাসিদ্ধ হয়েছে, কিন্তু বাস্তবসম্মত নয়।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান আরও যোগ করেন, এ বাজেটে জনগণের উপকার হবে কি না, তা নির্ভর করবে বাস্তবায়নের ওপর। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের ওপরই জনগণের উপকার নির্ভর করবে। আর দেবপ্রিয় বলেন, এ বাজেট বাস্তবায়নে প্রশাসনিক বিপ্লব প্রয়োজন হবে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বলেন, বাজেটের বিভিন্ন প্রস্তাবনায় সাম্যের পরিবর্তে অসাম্য তৈরি হয়েছে। যেমন—মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হলো না। উল্টো একই সীমারেখায় দুই হাজার টাকা থেকে সর্বনিম্ন কর তিন হাজার টাকা করা হলো, যা সামাজিক সাম্যের পরিপন্থী কাজ হয়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য যা গ্রহণযোগ্য হবে না বলে মত দেন দেবপ্রিয়। এমন আরও বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে অসাম্যের তথ্য তুলে ধরেন তিনি।
অন্যান্যবারের মতো জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রীর ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনার পরের দিনই গতকাল শুক্রবার রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে সংবাদ ব্রিফিংয়ে সিপিডি প্রস্তাবিত বাজেটের বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন তুলে ধরে।
সিপিডি মনে করে প্রস্তাবিত বাজেটে আগামী বছর প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২ শতাংশ অর্জন করা এবং মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৭ শতাংশে ধরে রাখা বড় চ্যালেঞ্জ হবে। দেবপ্রিয় বলেন, ‘বাজেটে যেসব ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে তাতে এ কথা স্পষ্ট যে আগামীতে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম আরও বাড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে খাদ্যপণ্যের দাম আরও বাড়বে। তখন মূল্যস্ফীতিও ঊর্ধ্বমুখী হবে। সে অবস্থায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই দুরূহ হবে বলে আমরা মনে করি।’ সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রত্যাশাজনিত মূল্যস্ফীতিপ্রবণতাও কাজ করবে বলে তিনি মনে করেন।
দেবপ্রিয়র মতে, এ বাজেটের লক্ষ্য পূরণের জন্য যে নীতি-কাঠামো প্রয়োজন, তা বাজেট প্রস্তাবনায়
অনুপস্থিত। কালোটাকা সাদা করার সুযোগ সম্পর্কে সিপিডি বলেছে, এতে সৎ করদাতারা ক্ষতিগ্রস্ত ও নিরুৎসাহিত হন। উপরন্তু, অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় এটা নেই। আছে অর্থবিলে, যা একধরনের আড়াল করার চেষ্টা বলেই মনে হয়।
দেবপ্রিয় বলেন, পুরো বাজেটে মোট ভর্তুকির পরিমাণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। ভারতকে বৃহত্তর আঙ্গিকে ট্রানজিট দিলে কত আয় হবে বা অতীতে যে সীমিত পরিসরে ট্রানজিট দেওয়া হয়েছে তাতে কী আয় হলো, তার হিসাব অর্থমন্ত্রী দেননি। বাজেট বক্তব্যে বিরাষ্ট্রীকরণ শব্দটি পর্যন্ত নেই। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে পুনর্গঠন সম্পর্কে, আইএমএফের সঙ্গে চুক্তির বিষয়টি একেবারে বক্তব্যে আনেননি অর্থমন্ত্রী।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি: আগামী অর্থবছরের কাঙ্ক্ষিত ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনকে ‘উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা’ বলে মনে করে সিপিডি। চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির চেয়ে যা দশমিক ৯ শতাংশ বেশি। এই অবস্থায় আগামী অর্থবছরের কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন হলে তা হবে বীরত্বমূলক কাজ। এ জন্য প্রায় ৭৫ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকার বাড়তি বিনিয়োগ করতে হবে। ব্যক্তি খাতের এই যে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, কিন্তু এটা বাস্তবতার সঙ্গে কতটা সংগতিপূর্ণ, সেই প্রশ্ন তোলেন সিপিডির বিশেষ ফেলো। দেবপ্রিয় বলেন, অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করায় আর্থিক খাতের বিনিয়োগ লক্ষ্যে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে না।
অর্থায়ন কাঠামো: বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে সিপিডি। সংস্থাটি বলছে, বাজেটের ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংকিং খাতের ওপর নির্ভর করলে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। এর চেয়ে ঘাটতি অর্থায়নে পাইপলাইনে পড়ে থাকা এক হাজার ৬০০ কোটি ডলারের বিদেশি সহায়তা ছাড় করার পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি।
তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে সিপিডি। বাজেটে ঋণের সুদ ব্যয় এক বৃহৎ অংশ উল্লেখ করে সিপিডি বলেছে, ব্যাংক থেকে ঋণ করে বাজেট অর্থায়ন করার ফলে এটা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরে সুদবাবদ তিন হাজার ৫০৬ কোটি টাকা বেশি অর্থ খরচ করতে হবে।
ভর্তুকি: সিপিডির মতে, কৃষি খাতের চেয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে বেশি সমর্থন দিচ্ছে ভর্তুকির অর্থ। এতে নগর ও গ্রাম, ধনী ও গরিবের মধ্যে আরও অসাম্য সৃষ্টি করবে। আর ভর্তুকিতে বরাদ্দ নিয়ে আরও স্বচ্ছতা আনা উচিত বলে মনে করে সিপিডি।
২০০৮-০৯ অর্থবছরের ভর্তুকির অর্থের ৭৪ দশমিক ৯ শতাংশই ছিল কৃষি, রপ্তানি ও খাদ্য নিরাপত্তা খাতে। এর মধ্যে কৃষি খাতে ভর্তুকি ছিল ৫৩ দশমিক ৭ শতাংশ। আর ২০১১-১২ অর্থবছরে কৃষি খাতে ভর্তুকি কমে আসে ২১ দশকি ৬ শতাংশে।
পদ্মা সেতু: পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প সম্পর্কে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এই প্রকল্পটির এখন অভিভাবক বা উন্নয়ন-সহযোগী নেই। উন্নয়ন-সহযোগীদের সঙ্গে জটিলতা দ্রুত সুরাহা করা উচিত। কেননা, রেয়াতি হারে টাকা আনার জন্য উন্নয়ন-সহযোগীদের কোনো বিকল্প নেই। তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে আগামী বাজেটে ৮০৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই টাকা দিয়ে জমি অধিগ্রহণ, দু-চারটা গাড়ি কেনা এবং তার তেল খরচ হবে। সেতু হবে না।
রাজস্ব পদক্ষেপ: ব্যক্তিশ্রেণীর করমুক্তসীমা এক লাখ ৮০ হাজার টাকা অপরিবর্তিত রাখা সামাজিক সাম্যের পরিপন্থী বলে মনে করে সিপিডি। এটা নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
রপ্তানির ওপর উৎসে কর বৃদ্ধি সম্পর্কে সিপিডি বলেছে, এতে রপ্তানিকারকের মুনাফার ওপর ১৭ শতাংশ কর কার্যকর হবে। রপ্তানিকারকের উৎসে কর ১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে।
জমি বিক্রেতার ওপর উৎসে কর কর্তন সম্পর্কে সিপিডি মনে করে, ‘ল্যান্ড ডেভেলপাররা’ আসলে এই উৎসে কর গ্রাহকের কাছ থেকেই আদায় করবেন।
আর মোবাইল ফোন বিলের ওপর উৎসে করারোপ সম্পর্কে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘এটি ঠিক হয়নি। যাদের কাছে অর্থ বা সম্পদ আছে তাদের কাছে না গিয়ে সাধারণ ভোক্তাদের ওপর করারোপ হয়েছে। এটা সামাজিক সাম্যের পরিপন্থী।’
শেয়ারবাজার: সিপিডি মনে করে, স্টক এক্সচেঞ্জের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনাকে পৃথক করা অর্থাৎ ডি-মিউচুয়ালাইজেশন পদ্ধতি বাস্তবায়নে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময় নির্ধারণ অনেক দেরি হয়ে যাবে। তার আগেই এ কাজ শেষ করা উচিত। সংস্থাটি বরাবরের মতোই বলেছে, শেয়ারের বিও হিসাব খুলতে টিআইএন বাধ্যতামূলক করা উচিত। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বেনিফিশিয়ারি ওনার্সের (বিও) কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) চাইবেন না, কিন্তু ব্যাংকে টাকা রাখলে টিআইএন চাইবেন—এতে বৈপরীত্য রয়েছে।
সিপিডি মনে করে, পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক ও কার্যক্রমগত দুর্বলতা দূর না করে বর্তমানে দেওয়া সুবিধা ও প্রস্তাবিত বাজেটে প্রণোদনা বাজার দক্ষতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহজ হবে না। অন্যদিকে মার্চেন্ট ব্যাংককে ৫ শতাংশ কর ছাড় দেওয়ার বিষয়টিকে অদক্ষতাকেই উৎসাহিত করা হবে বলে মনে করে সংস্থাটি।
অন্যদিকে ২০ শতাংশ শেয়ার বাজারে ছাড়লে ১০ শতাংশ কর ছাড় এবং পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত লভ্যাংশ আয়করমুক্ত রাখার প্রস্তাবে প্রত্যাশিত বাজারে পরিবর্তন আসবে কি না—সে প্রশ্নও তুলেছে সিপিডি।
অন্যান্য খাতের বিশ্লেষণ: বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সম্পর্কে সিডিপির বক্তব্য হলো, ভাড়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্র ব্যবস্থা থেকে সরে আসার উপায় দ্রুত বের করতে হবে। আবার বের হয়ে এলে যেন বিদ্যুৎহীন না হয়ে পড়ি, সেটাও বিবেচনায় আনতে হবে। সিপিডির মতে, স্থানীয় সরকারের জন্য পৃথক বাজেট করা উচিত। এতে তৃণমূল পর্যন্ত অর্থ পৌঁছানো সম্ভব হবে।
পিপিপি বাস্তবায়ন সম্পর্কে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, পিপিপি বাস্তবায়ন নেই, অগ্রগতি নেই। এর ব্যর্থতা এখন মনোবেদনার কারণ। আর কয়লানীতি সম্পর্কে এখনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই নিতে পারল না সরকার।

No comments

Powered by Blogger.