বস্ত্রশিল্প-তিন লাখ টাকার শাড়ি বনাম আমাদের তাঁতি by ফরিদা আখতার

শাড়ির দাম তিন লাখ টাকা। আর একটু কম দামেও আছে। আড়াই লাখ, দেড় লাখ। পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকার শাড়ি তো আছেই। শাড়ি ছাড়াও ঈদের বাজারে লেহেঙ্গাও তাল মিলিয়ে দামি পোশাক হয়ে আছে, দাম দুই লাখ বা তিন লাখ টাকা।


ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে ঈদের বাজার নিয়ে সংবাদ প্রতিবেদনে দোকানিরা বলছেন, এমন পোশাক তাঁরা সপ্তাহে দু-তিনটা বিক্রি করছেন। আশ্চর্য! দৈনিক যায়যায়দিন-এর একটি প্রতিবেদনে (২৬ আগস্ট ২০১০) বলা হয়েছে, এই ধরনের পোশাক যাঁরা কেনেন তাঁরা নাকি ‘এক্সক্লুসিভ ও রেয়ার’ শাড়ি খোঁজেন। দোকানিরা এতই বেচাবিক্রি করতে পারেন যে তাঁরা টাকা নাকি হাজারে গোনেন না, গোনেন লাখে। বাহ্। খুব ভালো।
উল্লেখ্য, এই পোশাকগুলো বাংলাদেশে তৈরি নয়, এসেছে ভারত থেকে। অর্থাৎ এমন নয় যে এই ‘রেয়ার’ কেনাকাটায় এই দেশের কোনো শিল্প উপকৃত হচ্ছে। তিন লাখ টাকা দাম হলো কেন? এই প্রসঙ্গে একজন দোকানি একটি টিভি চ্যানেলে বর্ণনা করেছেন এভাবে যে এই শাড়িতে যে পাথরের কাজ আছে তা আসল, সোনার পানিতে ধোয়া সুতোয় কাজ করা হয়েছে ইত্যাদি। শুনে মনে হচ্ছিল, ঈদে বুঝি মোগল-এ আজম সিনেমার শুটিং হবে। ঈদের মূলকথা আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করা, গরিবদের মধ্যে কাপড় বিতরণ করা ও তাদের সুখ-দুঃখের সাথি হওয়া। অথচ মনে হচ্ছে, একশ্রেণীর মানুষের মধ্যে ঈদের মধ্যে কত দাম দিয়ে কাপড় কেনা হলো, সেই দাপট দেখানোটাই প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমার প্রশ্ন, এই ক্রেতারা আসলে কারা? বাংলাদেশে ধনী-গরিব ফারাক দিনে দিনে বাড়ছে জানি, কিন্তু ঈদের বাজারের খবর পড়তে গিয়ে এবং টেলিভিশনে ঝকমারি কেনাকাটা দেখে সন্দেহ হয়, বাংলাদেশ আসলে গরিব দেশ কি না। এখানে একটি বড় ব্যবসায়ীশ্রেণী আছে, কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, তাঁরা বিদ্যুৎ ও গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না বলে হা-হুতাশ করছেন। তৈরি পোশাকশ্রমিকেরা যখন বেতন বৃদ্ধির যৌক্তিক দাবি তোলেন, তখন তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের হিসাবকিতাব শুরু হয়ে যায় তাদের কত ক্ষতি হবে এবং শ্রমিকদের বেশি বেতন দিলে এই শিল্প নাকি টিকবে না। তাঁরা এটা পরিষ্কার করে বলেন না, তাঁদের মুনাফা একটু কমে যাবে। ক্ষতি হওয়া এবং মুনাফা কমে যাওয়া এক কথা নয়। গুজব আকারে হলেও আমি শুনেছি, তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের মধ্যে যাঁরা কিছুটা হলেও শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির পক্ষে ছিলেন, তাঁরা অন্য মালিকদের কারণে তা পারেননি, কারণ তাঁদের নতুন মডেলের গাড়ি কেনার পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। আমার কৌতূহল হচ্ছে, এই তিন লাখ টাকার শাড়ি ও লেহেঙ্গা যাঁরা কিনছেন তাঁদের মধ্যে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকের পরিবার আছে কি না। বাংলাদেশের ধনী কারা? তাদের আয়ের উৎস নিয়ে দুই দকই বা কেন উদগ্রীব নয়?
ঈদের আগে পোশাকশ্রমিকদের শতভাগ বেতন-বোনাস ও অতিরিক্ত কাজের মজুরিসহ সব পাওনা দেওয়ার জন্য মালিকদের নির্দেশ দিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। আমি খুশি হয়েছি যে মন্ত্রী বলেছেন, ঈদ সবাই আনন্দঘন পরিবেশে করুক, তাই ঈদের আগে শ্রমিকের পাওনা শোধ করতে হবে। কিন্তু একই সঙ্গে বলা হয়েছে মালিকের সামর্থ্যের কথা। এটা একটু গোলমেলে মনে হচ্ছে, শ্রমিক তার ন্যায্য মজুরি নেবে, সেটা ঈদের আগে মালিককে দিতে হলে তাঁদের সামর্থ্যের কথা আসবে কেন? মালিকের সামর্থ্য আছে কি নেই, তা নির্ণয় করবে কে? শ্রমিক বাড়তি কিছু চাইছে না, তার পাওনা চাইছে মাত্র। নির্দেশের মধ্যে এই ফাঁকটুকু রেখে দিয়ে শ্রমিকদের ঈদের আগে মজুরি পাওয়া এবং আনন্দঘন পরিবেশে ঈদ করার নিশ্চয়তা পূর্ণ হলো না। তবে হ্যাঁ, এই ঘোষণার কারণে যদি শ্রমিক অসন্তোষ কমে যায়, তাহলে মালিকের ঈদ আবশ্যই আনন্দঘন হবে।
ঈদ ধনী-গরিব সবার জন্য। গরিবেরাও ঈদের বাজার করছে বা করবে। পত্রিকাগুলো সে ব্যাপারেও রিপোর্ট করছে। তবে একটি কথা বেশি শোনা যায়, সেটা হচ্ছে, ‘এহনো কিছু কিনি নাই...চান রাইতের দিন কেনাকাটা করমু (আমার দেশ, ২৯ আগস্ট ২০১০)। গরিবদের কেনাকাটার জন্য ৩০ থেকে শুরু করে ৬০০ টাকার মধ্যে শার্ট, প্যান্ট, বাচ্চাদের কাপড়, শাড়ি, থ্রিপিস পাওয়া যায় ফুটপাতে। জুতা ১০০ থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। তা ছাড়া মেয়েদের জন্য চুড়ি, চুলের ক্লিপ, কানের দুল, গলার মালা সব কেনাকাটা হয়। রিকশাওয়ালা হোক বা দিনমজুর ছেলেমেয়েকে ঈদের দিনে অল্প দামের হলেও নতুন পোশাকে দেখতে চায়। তারা শপিং মলে বাজার করে না, গুলিস্তান, মতিঝিল, মোহাম্মদপুর বা মিরপুরের বাজার থেকেই কেনে। এতেই তারা খুশি এবং এদের কারণেই অনেক স্থানীয় শিল্প বেঁচে আছে। গরিবেরাই দেশীয় শিল্প-কলকারখানা টিকিয়ে রেখেছে!
তাঁতিদের কথা একটু বলি। আমাদের দেশের তাঁতিরা অনেক সূক্ষ্ম কাজের নকশি কাজ করে কাপড় বুনছেন এবং বাজারে তা সমাদৃত হচ্ছে। টাঙ্গাইলের নকশি বুটি, সিল্ক শাড়ি খুব সুন্দর, এই শাড়ির ক্রেতাও কম নয়। জামদানি শাড়িও ভালো চলে। দেশীয় কাপড়ের প্রতি আগ্রহ আছে, এমন ক্রেতাও অনেক আছেন। কিন্তু তাঁতিদের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে অন্য জায়গায়। উবিনীগের একটি অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এবার টাঙ্গাইলের নকশি বুটি তাঁতিরা ১০০ কাউন্টের সুতা পাওয়া যায়নি বলে শাড়ি বুনতে পারেননি। অল্প পরিমাণে যা পাওয়া গেছে তার দাম ছিল মোড়াপ্রতি ১৭ থেকে ২০ টাকা বেশি। আগে ছিল ৪৮ টাকা প্রতি মোড়া, এখন হয়েছে ৬৫ টাকা। একটি শাড়ি তৈরি করতে সাড়ে চার মোড়া সুতা লাগে (প্রতি মোড়া ২৫০ গ্রাম)। সমস্যা হয়েছে সেই সুতাই ঠিকমতো পাওয়া যায়নি। তাই অনেক তাঁতি বাধ্য এই কাজই ছেড়ে দিয়েছেন। একটি সাধারণ তাঁতের শাড়িতে সুতার খরচ গত বছরের তুলনায় বেড়েছে ৬৮ টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি বেড়েছে। সুতার দাম বাড়ার কারণে মহাজনেরা তাঁতিদের মজুরি ঠিকমতো দিতে পারেননি। টাঙ্গাইলে সিল্ক সুতার দামও বেড়েছে ৩৬০০ থেকে ৪৫০০ টাকা প্রতি কেজিতে। এক সপ্তাহে নকশি বুটি শাড়ি বুনে মাত্র ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা উপার্জন করতে পেরেছেন অনেক তাঁতি। এর চেয়ে ভ্যানগাড়ি চালালে দিনে ২০০ টাকা বা সপ্তাহে ১৪০০ টাকা পাওয়ার সুযোগ আছে। তাই তাঁতিরা তাঁতের কাজ বাদ দিয়ে ভ্যানগাড়ি চালাবেন ঠিক করেছেন। বসাক তাঁতি বা মহাজনেরাও হতাশ হয়ে পড়েছেন। বিদেশি শাড়ির আগ্রাসন দেখলে তাঁরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।
দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সরকার দেশের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকে রক্ষা করার জন্য কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করছে না। তাঁতিদের প্রতিনিধি এফবিসিসিআইয়ে নেই, কথায় কথায় তাঁরা সরকারকে ধমকও লাগাতে পারেন না। তাই তাঁরা বাধ্য হচ্ছেন পেশা বদল করতে। শুনেছি ঢাকা শহরে রিকশাচালকদের মধ্যে ৭০ শতাংশ আগে কৃষক ছিল, এখন তাঁতিরা এসে ভ্যানচালক হবেন। আর আমাদের ধনী পরিবারের নারীরা অন্য দেশে উৎপাদিত তিন লাখ টাকা দামের শাড়ি ও লেহেঙ্গা পরবেন। অর্থনীতির এই অবস্থা আমাদের কাম্য কি?
ফরিদা আখতার: নারী আন্দোলনের নেত্রী।

No comments

Powered by Blogger.