শ নি বা রে র বিশেষ প্রতিবেদন-বর্নীর অহংকার শাহ আলম by কামনাশীষ শেখর

একসময় গ্রামের দুই শতাধিক পরিবার বংশপরম্পরায় বাঁশ ও বেত দিয়ে কুলা, ধামা ও পলো তৈরি করত। এসব বিক্রি করে পাওয়া টাকা দিয়েই কোনোরকমে চলত সংসার। একপর্যায়ে নানা কারণে এসব কুলা-ধামা বিক্রি করে পাওয়া টাকায় তাঁদের সংসার যেন আর চলছিল না। তাই জীবনের তাগিদে বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে যাচ্ছিলেন তাঁরা।


বিষয়টি ভালো লাগেনি গ্রামের এক তরুণের। তাই সবাইকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন তিনি। সফলও হন। এই অবস্থা দেখে অনেকে ফিরে আসেন বাপ-দাদার পুরোনো পেশায়। আবারও কর্মতৎপর হয় গ্রামটি।
গল্পটি টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার ডুবাইল ইউনিয়নের বর্নী গ্রামের। আর সেই তরুণের নাম শাহ আলম। এই কারুশিল্পীর নেতৃত্বে বর্নী গ্রামের বাসিন্দারা বেত ও বাঁশের কাজকে নিয়ে গেছেন শিল্পের পর্যায়ে। সংসারে এসেছে সচ্ছলতাও।
শুরুর কথা: উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বদিকে বর্নী গ্রামটির অবস্থান। স্কুলে পড়ার সময়ই বাঁশ-বেতের কিছু কাজ শিখেছিলেন এই গ্রামের তরুণ শাহ আলম। ১৯৮৯ সালে এইচএসসি পাসের পর বাঁশ-বেতের কাজকেই নেন পেশা হিসেবে।
গ্রামের অন্যদের মতো বাঁশ ও বেত দিয়ে কুলা, ডালা, পলো, মাথালসহ বিভিন্ন কিছু তৈরি করে স্থানীয় হাটবাজারে বিক্রি শুরু করেন। এ কাজ করতে করতে শাহ আলম বুঝতে পারেন, দিন দিন তাঁদের তৈরি জিনিসগুলোর চাহিদা কমছে। একসময় খেয়াল করলেন, টিকতে না পেরে গ্রামের মানুষজন বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। বিষয়টি ভালো লাগেনি শাহ আলমের।
কারণ খুঁজতে গিয়ে শাহ আলম দেখলেন, আধুনিক প্লাস্টিক সামগ্রী ক্রমেই বাজার দখল করে নিচ্ছে। বাঁশ-বেতের চেয়ে অধিক টেকসই হওয়ায় মানুষ এসবের দিকে ঝুঁকছে। মাথালের পরিবর্তে গ্রামের মানুষ ছাতা ব্যবহার করছে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানির প্লাস্টিক সামগ্রীর প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশি।
শাহ আলম বলেন, ‘ওই সময় চিন্তা করলাম, নতুন নতুন সামগ্রী তৈরি করতে হবে। তবেই এই পেশায় টিকে থাকতে পারব। গ্রামের অন্যরাও খেয়ে-পরে বাঁচতে পারবে।’
এই ভাবনা থেকেই ’৯৩ সালে একদিন ঢাকার একটি অভিজাত কারুপণ্যের দোকানে গিয়ে কথা বলেন শাহ আলম। ওই দোকান থেকে তাঁকে বাঁশের তৈরি ট্রে ও বেতের তৈরি টেবিলম্যাট নকশা দিয়ে সেগুলো তৈরি করে দিতে বলা হয়। নকশা নিয়ে বাড়ি ফিরে কাজে লেগে যান শাহ আলম। পাঁচ দিনের মধ্যে সেই নকশা অনুযায়ী ট্রে ও টেবিলম্যাট তৈরি করে ঢাকায় যান শাহ আলম। জিনিসগুলো পছন্দ হয় কারুপণ্যের সেই দোকানের মালিকের। তিনি শাহ আলমকে এসব পণ্য নিয়মিত সরবরাহ করতে বলেন। ভালো লাভ পেতে শুরু করলেন শাহ আলম।
পেশায় ফেরা: শুরুতে শাহ আলম একাই ঢাকায় এসব পণ্য সরবরাহ করতে থাকেন। অন্যরা তেমন আগ্রহ দেখাতেন না। শাহ আলম আশপাশের দু-চারজনকে বুঝিয়ে নিত্যনতুন পণ্য তৈরি করতে শেখান হাতে-কলমে। ঢাকায় পণ্যের চাহিদা বাড়তে থাকে। শাহ আলমও সরবরাহ বাড়াতে থাকেন।
একটা পর্যায়ে গ্রামের লোকজন শাহ আলমের কাছে কাজ শিখতে যাওয়া শুরু করেন। তৈরি করতে থাকেন নতুন নতুন পণ্য। গ্রামের শাহজাহান মিয়া বলেন, ‘প্রথম দিকে আমাগো নতুন নতুন জিনিস তৈরির আগ্রহ আছিল না। শাহ আলম যখন বুঝাইল এগুলা তৈরি করলে ভালো টাকা পাওয়া যাব, তহন আমরা তার কথামতো কাজ শুরু করলাম।’ ফজলুল হক জানান, তিনি অন্য পেশায় চলে গিয়েছিলেন। শাহ আলমের কাছে নতুন কাজ শিখে আবার ফিরে এসেছেন। এখন এ পেশায় ভালো রোজগার হয়। গ্রামে তাঁর মতো অনেকেই একসময় বাপ-দাদার এ পেশা ছাড়লেও এখন ফিরে এসেছেন।
সেই গ্রামে একদিন: সম্প্রতি বর্নী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই বাঁশ-বেতের কাজ চলছে। সব বয়সী মানুষ এসব কাজ করছেন। কোনো কোনো বাড়িতে গৃহবধূরা গৃহস্থালি কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসব পণ্য তৈরি করছেন। গ্রামের জয়নাল আবেদিনের (৬৫) বাড়িতে গিয়ে কথা হলো তাঁর সঙ্গে। ‘একসময় খুব দুরবস্থার মধ্যে চলতে হতো। এখন ভালো আছি। পণ্য তৈরির সঙ্গে সঙ্গে তা বিক্রি হয়ে যায়।’ বলেন তিনি।
গৃহবধূ শুকুরি বেগম বলেন, ‘এহন আমরা সবাই শাহ আলমের শেখানো কাজ করি। এতে ভালো পয়সা পাওয়া যায়। আমাগো আর অভাব নাই।’
গ্রামের যুবক নাজমুল হোসেন জানান, এ কাজ করে তিনি মাসে পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা আয় করছেন। তাঁর মতো গ্রামের অনেকের এমন আয় হচ্ছে।
যা তৈরি হয়: প্রথমে বাঁশের ট্রে ও বেতের টেবিলম্যাট তৈরি করতেন শাহ আলম। তিনি জানান, পরে এর সঙ্গে যোগ হয় পেপার ঝুড়ি, লন্ড্রি ঝুড়ি, টেবিল ল্যাম্প, ফ্লোর ল্যাম্প, জুয়েলারি বক্স, ফটোস্ট্যান্ডসহ নানা ধরনের শোপিস। বর্তমানে শাহ আলম বাঁশ-বেতের গহনা তৈরি করছেন। এগুলো বাজারজাতকরণের অপেক্ষায় আছেন।
বিপণন: বর্নী গ্রামের উৎপাদিত পণ্যগুলো শুরুতে শাহ আলম একাই বিপণন করতেন ঢাকায়। কিন্তু এখন চাহিদা বাড়ায় শুধু শাহ আলম নয়, লাল মিয়া, শাহজাহান, আজিম উদ্দিনসহ আরও অনেকেই ঢাকায় বড় বড় কারুপণ্যের দোকানে নিজেদের কাজের নমুনা নিয়ে যান। সেখান থেকে পছন্দ করে ঢাকার দোকানিরা যেসব পণ্যের অর্ডার দেন, সেগুলো গ্রামে তৈরি করে ঢাকায় সরবরাহ করেন। দিন দিন ঢাকার সঙ্গে সরাসরি বিপণনে যুক্ত হওয়া কারুশিল্পীর সংখ্যা বাড়ছে বর্নী গ্রামে।
স্বীকৃতি: শাহ আলম তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০২ সালে বাংলাদেশ কারুশিল্প পরিষদের ‘শীলু-আবেদ কারুশিল্প পুরস্কার’ লাভ করেছেন। এ স্বীকৃতিতে গর্বিত শাহ আলমের স্ত্রী নাজমা আক্তারও, ‘আমার স্বামী নিত্যনতুন পণ্য তৈরি করে এলাকার মানুষের উপকার করছেন। তাঁর কাজে সব সময় সহায়তা করি।’
তাঁদের কথা: ‘আমরা সততা ও শ্রমে বিশ্বাসী। তারই মূল্যায়ন পেয়েছি।’ বলেন শাহ আলম। তিনি জানান, প্রতিদিনই বাঁশ-বেতের পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। তাই শুধু নিজের গ্রাম নয়, আশপাশের গ্রামের লোকজনকেও এ কাজের সঙ্গে যুক্ত করছেন। স্বপ্নের কথাও জানান শাহ আলম, ‘একদিন তাঁদের উৎপাদিত পণ্য তাঁরা নিজেরাই সরাসরি বিদেশে রপ্তানি করবেন। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবেন।’
ডুবাইল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আতোয়ার রহমান বলেন, ‘বর্নী গ্রামের মানুষের কথা আমি জানি। বাঁশ ও বেত দিয়ে নতুন নতুন পণ্য তৈরি করে তাঁরা স্বাবলম্বী হয়েছে। বর্নীর বাঁশ ও বেতের শিল্প আমাদের অহংকার।’

No comments

Powered by Blogger.