হুমায়ূন আহমেদের দেয়াল-সাহিত্যের সীমানা ও আদালতের দায় by সাজ্জাদ শরিফ

ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করতে করতেও হুমায়ূন আহমেদ জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি একটি বড় উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা করেছেন। উপন্যাসের পটভূমি ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ড এবং এর সঙ্গে জড়িত ঘটনাপ্রবাহ।


হুমায়ূন টের পাননি, কোন দুর্বিষহ নিয়তি তাঁর সামনে অপেক্ষা করছে। দেয়াল নামের সেই উপন্যাস এখনো বেরোয়নি। তার মাত্র দুটি পর্ব ১১ মে ২০১২ তারিখে প্রথম আলোয় বেরিয়েছিল। এরপর যা ঘটেছে, তা আর কেবল সাহিত্যের মধুর সীমানায় আটকে থাকেনি। সাহিত্যের সীমা উপচে সমাজ-রাষ্ট্রের খোলা ময়দানে প্রবেশ করেছে এবং বাংলাদেশে রাষ্ট্র ও নাগরিকের এবং ক্ষমতা ও বাক্স্বাধীনতার সম্পর্কটি স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছে।
দেরিতে হলেও ঘটনাটি নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন। কারণ, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাষ্ট্রের পরিসীমার মধ্যে তার নাগরিকদের আত্মপ্রকাশের অধিকার ও চর্চার প্রশ্নটি। নাগরিক অধিকারের চর্চার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে সাবালক হয়ে উঠতে হলে এ প্রশ্নের মীমাংসা না করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসটির অংশবিশেষ বেরোনোর পর সেটির প্রতি আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি জানিয়েছিলেন, ‘আমরা চাই (উপন্যাসটিতে) তথ্যগত ভুল যাতে না থাকে। কারণ, তাঁর পাঠক লাখ লাখ, এর মধ্যে নবীন ও যুবকই বেশি। প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরা না হলে তারা সঠিক ইতিহাস জানবে না। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস জানবে না, এটা হতে পারে না। তথ্যগতভাবে যাতে সঠিক হয়, এ জন্য আমরা বিষয়টি আদালতের নজরে দিয়েছি।’ (প্রথম আলো, ১৬ মে ২০১২)। এরপর ১৫ মে ২০১২ তারিখে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি আদেশ দেন বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চ। হুমায়ূন আহমেদের কাছে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষ্যের বিবরণ ও রায়সহ ইতিহাসের সঠিক তথ্য সরবরাহ করার জন্য তথ্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবদের প্রতি আদালত রুল জারি করেন। আদালত আশা প্রকাশ করে বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তথ্য সংশোধন করে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর উপন্যাসটি বের করবেন।
বাংলাদেশের আদালত সম্প্রতি বেশ তৎপর হয়ে উঠেছেন। অনেক ক্ষেত্রে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বেশ কিছু ইতিবাচক ভূমিকাও তাঁরা রাখছেন। কিন্তু কখনো কখনো তাঁরা এমন বিষয়ে জড়িয়ে পড়ছেন, যে ক্ষেত্রে তাঁদের জন্য নীরবতাই শ্রেয়তর ছিল। যেমন, বাংলা ভাষার পরিস্থিতি নিয়ে তাঁদের তৎপরতা। কোনো ভাষার প্রবাহ ও পরিবর্তনকেই কখনো আইনের শাসনে বাঁধা যায়নি। তেমন আইন জারি হলে অবহেলিত ও অচ্ছুত তস্য গরিবদের প্রাকৃত ভাষা থেকে খোদ বাংলা ভাষারই জন্ম হতো না। ল্যাটিন ছাপিয়ে জন্ম নিত না ইউরোপের আজকের প্রধান ভাষাগুলো। হুমায়ূনের উপন্যাস নিয়েও আদালত তেমন একটি বিষয়ে জড়িয়ে পড়লেন।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উদ্ভবের আগে আদালতের কাঁধে ছিল মূলত বিচার-আচার ও বিরোধ-মীমাংসার দায়িত্ব। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আদালতের দায়িত্বের ব্যাপ্তি অনেক গুণ বেড়ে যায়। রাষ্ট্রের মধ্যে নাগরিকেরা তাদের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য যে বিপুল ক্ষমতা সরকারের হাতে তুলে দেয়, সেটি যেন প্রবল ও স্বেচ্ছাচারী হয়ে নাগরিকের মাথার ওপর মুগুরের মতো ফিরে না আসে, আদালত অতন্দ্র চোখে তার পাহারা দিয়ে চলেন। আদালত রাষ্ট্রেরই অংশ বটে; কিন্তু তাঁর কাজ সমস্ত বলদর্পী ক্ষমতার আঘাত থেকে নাগরিকের অধিকার ও আকাঙ্ক্ষাকে রক্ষা করা। ক্ষমতার নিপীড়নের মুখে আদালত নাগরিকেরই বর্ম।
প্রথমেই মেনে নেওয়া ভালো, হুমায়ূন আহমেদের লেখায় অনেক তথ্যের ভুল আছে। তবে ব্যাপারটি কেবল তথ্যেরই নয়। উপন্যাসের প্রকাশিত অংশটুকুতে হুমায়ূন অ্যান্টনি ম্যাসকারেনহাসের লিগেসি অব ব্লাড-এর ওপর একটু বেশি মাত্রায় নির্ভর করেছেন। বইটি বিতর্কিত ও গোলমেলে। জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনামলে বইটি বেরোয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্রহননের একটি সূক্ষ্ম প্রকল্প বইটির মধ্যে অনেকে লক্ষ করেছিলেন। এমন একটি জল্পনা চালু ছিল যে, এ বইয়ের প্রকাশ এরশাদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ। এসব অভিযোগ ও বিতর্কের মুখোমুখি না হয়ে হুমায়ূন আহমেদের উপায় নেই। কিন্তু ঘটনা এখানে নিছক বিতর্কে আটকে থাকেনি। অ্যাটর্নি জেনারেল ঘটনাটিতে যুক্ত হয়ে পড়ায় সরকার এখানে একজন লেখকের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে, নাগরিকের বাক্চর্চার দিক থেকে যা অত্যন্ত বিপজ্জনক। উপরন্তু আদালত লেখকের সৃষ্টিশীল স্বাধীনতার বিপরীতে রাষ্ট্রের পক্ষ নেওয়ার বিষয়টি অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্র স্বয়ং আদালতের হাত ধরে একজন লেখকের সৃষ্টিশীলতা চর্চার, কিংবা বলা ভালো, একজন নাগরিকের বাক্চর্চার স্বাধীনতার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে।
রাষ্ট্র বনাম লেখকের ঘটনার কিছুটা নজির আমরা চারপাশের দুনিয়ায় একটু খুঁজে দেখার চেষ্টা করি। সাম্প্রতিক সময়ে ৯/১১-এর টুইন টাওয়ার হামলা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিরাট এক ঘটনা। এ ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের মনস্তত্ত্ব, রাজনীতি ও বিশ্বপরিকল্পনার ধরন আমূল পাল্টে দেয়। ঘটনার পরপর যুক্তরাষ্ট্র যখন শোকে মুহ্যমান, সে সময় নিউ জার্সি স্টেটের পোয়েট লরিয়েট ইমামু আমিরি বারাকা ‘সামবডি ব্লিউ আপ আমেরিকা’ শিরোনামের একটি কবিতায় লেখেন, ‘কে জানত বোমা ফাটবে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে/ টুইন টাওয়ারের ৪০০০ ইসরায়েলি কর্মীকে কে বলল সে দিন/ ঘরে থেকে যেতে/ শ্যারন রইল কেন দূরে?’ জল্পনা হিসেবে এ রকম কিছু কথা তখন উঠেছিল সত্যি। ডাহা মিথ্যা বলে একে উড়িয়ে দিয়েছিলেন সবাই। সে কথা এখন বলছেন একজন রাজকবি? নিউ জার্সির অ্যান্টি-ডিফেমেশন লিগের আঞ্চলিক পরিচালক, জাতিতে ইহুদি, সাই গোল্ডস্টাইন বলেছিলেন, ‘এটাই আমাদের দুঃখ যে “ডাহা মিথ্যা”টা আবার উচ্চারণ করেছেন কিনা এই স্টেটেরই একজন প্রতিনিধি।’ বারাকা প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। কিন্তু তাঁর বাক্স্বাধীনতা রক্ষার কথা তাঁরা বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন। বারাকাকে তাঁর রাষ্ট্রীয় পদ থেকে বাদ দেওয়ার কথা কেউ ভাবেননি। যদিও পরে তিনি নিজেই পদটি ছেড়ে দেন।
১৯৬০-এর দশকে বিট কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘হাউল’ কবিতাটি নিষিদ্ধ করার দাবি আদালতে উঠলে বিচারক ক্লেটন হর্ন বলেছিলেন, ‘কোনো দুজন মানুষ এক রকম নয়...সবাই যদি শুধু নির্বিষ মিষ্টি বুলির মধ্যেই তাদের কথাবার্তা সীমিত রাখে, তাহলে কি তথ্যমাধ্যম বা বাক্স্বাধীনতা বলে আদৌ কিছু থাকবে?’
হুমায়ূন আহমেদের ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠেছে তাঁর উপন্যাসে তথ্যনিষ্ঠ ইতিহাসের ব্যবহার নিয়ে। কিন্তু লেখক চাইলে একটু এগিয়ে গিয়ে তাঁর গল্পে ইতিহাসকে নতুনভাবে পুনর্লিখনও করার অধিকার রাখেন। তিনি দেখতে চাইতে পারেন, একটি ঘটনা এভাবে না ঘটে ওভাবে ঘটলে কেমন হতে পারত। শিল্প-সাহিত্যের ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, সে স্বাধীনতাও লেখকের আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল হিটলার আত্মহত্যা করেন। কিন্তু তিন বছর আগে মুক্তি পাওয়া ইনগ্লোরিয়াস ব্যাস্টার্ডস ছবিতে হিটলারের মৃত্যুদৃশ্য নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছিলেন পরিচালক কোয়েন্টিন ট্যারান্টিনো। তাঁর ছবিতে একদল দুর্ধর্ষ যোদ্ধা একটি প্রেক্ষাগৃহে ঢুকে হিটলারকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ডিভাইন কমেডিতে তাই দান্তের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় মোজেসের ও ইসলামের মহানবীর। লেভ তলস্তয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস উপন্যাসে নেপোলিয়ন ঐতিহাসিক শক্তির নিয়ন্তা নন, ইতিহাসের পুতুল। ওয়ার অ্যান্ড পিস নিয়ে লেখা এক রচনায় তিনি বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন, লেখকের কর্তব্য ইতিহাসের বীরের স্তুতি বা খলনায়কের পিণ্ডি চটকানো নয়, ইতিহাসের ঘটনাক্রমের মধ্যে তাদের ভেতরের মানুষটিকে টেনে বের করে আনা।
ইতিহাস ও উপন্যাসের ফারাক নিয়েও আজকাল তর্কের শেষ নেই। গল্পের গরুর মতো ইতিহাসের গরুও গাছে চড়ে। তথ্য মাত্রই ইতিহাস নয়, তথ্যের সুনির্দিষ্ট বিন্যাস থেকে ইতিহাস তার তাৎপর্য খুঁজে পায়। ক্যামেরার কোণ পাল্টালে যেমন দৃশ্যপট বদলে যায়, একই অতীতের দিকে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে তাকালে ইতিহাসও তেমন পরিবর্তিত হয়ে যায়। ঐতিহাসিক তো তবু অতীতের কঙ্কাল নিয়ে কাজ করেন, লেখককে কাজ করতে হয় রক্ত-মাংস নিয়ে। আদালতের এখানে কিছুই করার নেই।
লেখকের কি তাই বলে কোনো জবাবদিহি নেই? হ্যাঁ, তাঁরও জবাবদিহি আছে। তবে সেটা জনতার আদালতে। লেখা শেষ করে উপন্যাসটি হাতে নিয়ে হুমায়ূন আহমেদকে এই জন-আদালতে নেমে আসতে হবে। তারা যদি তাঁর প্রশংসা করে, সেটা যেমন তিনি হাত পেতে নেবেন; তারা যদি নিন্দা, অভিযোগ বা প্রত্যাখ্যান ছুড়ে দেয়, সেসবও তাঁকে একইভাবে গ্রহণ করতে হবে।
এবার একটি ঘটনা দিয়ে শেষ করি। রোমের সেনাপতি জেনারেল মার্সেলাস সিসিলি জয় করেছেন। সিসিলির জ্ঞানতাপস আর্কিমেদেসের সঙ্গে তিনি কথা বলতে চান। তিনি তাঁর নাম শুনেছেন। এক সেনাকে পাঠানো হলো আর্কিমেদেসকে নিয়ে আসতে। আর্কিমেদেস তখন সৈকতের বালুতে জ্যামিতির জটিল আঁকিবুঁকি করছেন। সেনাটি বলল, ‘জেনারেল মার্সেলাস আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।’ তিনি বললেন, ‘জ্যামিতিটা শেষ করে নিই।’ কিছুক্ষণ পর সেনা আবার হাঁক দিয়ে একই কথা বলল। বৃদ্ধের তখনো কোনো হুঁশ নেই। তৃতীয়বারের মতো হাঁক দিল সেনাটি। কিন্তু বৃদ্ধ জ্যামিতি নিয়ে মশগুল। এবার আর তর সইল না তার। তরবারি দিয়ে আঘাত করল আর্কিমেদেসকে। তিনি লুটিয়ে পড়লেন। রক্তের ফিনকিতে ভেসে গেল তাঁর সর্বশেষ জ্যামিতির নকশা। এই ঘটনা উল্লেখ করে ফরাসি ভাবুক অ্যালাঁ বাদিউ তাঁর পলেমিক্স বইয়ে বলেছেন, ক্ষমতা আর সৃষ্টিশীলতার মধ্যে প্রকৃত কোনো সংলাপ চলে না। ক্ষমতা শেষ বিচারে সহিংস। পক্ষান্তরে নিজের অন্তর্নিহিত নিয়ম ছাড়া সৃষ্টিশীলতার সামনে অন্য কোনো শর্তের বাঁধা নেই। ক্ষমতা যখন সৃষ্টিশীলতার মুখোমুখি হয়, তখন সৃষ্টিশীলতার অবসান ছাড়া আর কিছুই ঘটে না।
 সাজ্জাদ শরিফ: কবি ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.