১৪ কোটির ঘাড়ে করের খড়্গ

করের আওতায় এলেন কৃষক, শ্রমিক। কারণ তাঁদের ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট আছে, তাঁরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। তাঁদের ফোনের বিল ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মুনাফা থেকে উৎসে কর কেটে নেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে প্রস্তাবিত নতুন বাজেটে।


করযোগ্য আয় এবং টিআইএন না থাকায় তাঁদের অ্যাকাউন্ট থেকে উল্টো ৫ শতাংশ বেশি উৎসে কর কাটা হবে। এ রকমই ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায়। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশের ১৪ কোটি ৫৫ লাখ গ্রাহকের ঘাড়ে করের খৰ ঝুলে গেল।
ঘাটতি মেটানোর জন্য অনিশ্চিত বৈদেশিক উৎসের ওপর ভরসা রাখা যাচ্ছে না। অভ্যন্তরীণ ঋণ নিতে গেলেও নানা বাধা-বিপত্তি। বাধ্য হয়েই সরকারকে নজর দিতে হচ্ছে স্থানীয় উৎস থেকে কর আয় বাড়ানোর দিকে। তা করতে গিয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। কোনো বাড়তি উদ্যোগ ছাড়া কেবল ঘরে বসেই কর আদায় বাড়ানোর সহজ পথ বেছে নিয়েছে তারা। খুচরা পর্যায়ে গড়পড়তা ৪ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর আরোপ করা হয়েছে। রপ্তানি খাতে উৎসে কর বাড়ানো হয়েছে। করের আওতা বাড়াতে গিয়ে ন্যায্যতার নীতিও উপেক্ষা করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী এখন দেশের সব মোবাইল ফোন গ্রাহক ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টধারীর সবাই করের আওতায়। কৃষক, শ্রমিক, ভূমিহীন-নির্বিশেষে সবাইকেই ১০০ টাকার মোবাইল ফোন বিলের ওপর দুই টাকা, আর ব্যাংকে জমানো টাকা থেকে বছরে ১০০ টাকা মুনাফা পেলে ১৫ টাকা উৎসে কর দিতে হবে।
অর্থমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, 'আমরা রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করতে চাই এবং দেশীয় সূত্রে রাজস্ব বিশেষভাবে বাড়াতে চাই।' তাঁর বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে যেকোনো গ্রাহকের হিসাবে সুদ প্রদানকালে সুদগ্রহীতার টিআইএন না থাকলে সুদের ওপর ১০ শতাংশের পরিবর্তে ১৫ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তন করা হবে। অর্থাৎ টিআইএন বা করযোগ্য আয় না থাকার কারণে একজন গ্রাহককে ৫ শতাংশ বেশি কর দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের সব ব্যাংক মিলিয়ে অ্যাকাউন্ট রয়েছে পাঁচ কোটি ৫৫ লাখ। অ্যাকাউন্টপ্রতি গড় আমানত ৮০ হাজার ৭০০ টাকার মতো। গড় সুদ ৬ শতাংশ হারে বছরে অ্যাকাউন্টপ্রতি আয় থেকে গড়ে উৎসে কর কাটা যাবে ৭২৫ টাকা। এসব হিসাবধারীর মধ্যে প্রায় এক কোটি কৃষকও রয়েছেন, যাঁদের ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খুলতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর। ওই অ্যাকাউন্টে তাঁদের ভর্তুকির টাকা জমা হওয়ার কথা। তাঁদের করযোগ্য আয়ও নেই, টিআইএনও নেই। তবু ব্যাংকে যদি কিছু টাকা তাঁদের জমে, এর সুদ থেকে শতকরা ১৫ টাকা উৎসে কর কাটা হবে।
বাংলাদেশ টেলিকম রেগুলেটরি কমশিনের হিসাব, দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৯ কোটির কিছু বেশি। এখন কৃষক, শ্রমিক প্রায় সবাই মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। ন্যূনতম ১০ টাকাও রিচার্জ করেন তাঁরা, সেই টাকার ওপরও ২ শতাংশ হারে কর কাটা হবে। বাজেটের বইয়ে বলা হয়েছে, পোস্ট-পেইড মোবাইল গ্রাহকের ক্ষেত্রে মোট বিলের ওপর এবং প্রিপেইড গ্রাহকের ক্ষেত্রে প্রিপেইড কার্ড বিক্রি বা রিচার্জের সময় ২ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তন করা হবে।
মোবাইল ফোন গ্রাহক ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টধারীদের ওপর ঢালাও উৎসে কর আরোপ মেনে নিতে পারছেন না কর বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, কর আদায় বাড়ানোর জন্য সহজ পথ বেছে নিয়েছে রাজস্ব বিভাগ। এ ক্ষেত্রে ন্যায্যতার নীতিও মানা হয়নি। এ দুটি খাত থেকে বাড়তি কত কর আদায় হবে তা বলা হয়নি বাজেট বক্তৃতায়। তবে এ থেকে খুব বেশি আয় আসবে বলে মনে করেন না তাঁরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এটি মোটেই ভালো হয়নি। অল্প টাকা যাঁদের, তাঁরাই নিরাপদ ভেবে ব্যাংকে রাখেন। যাঁরা বড়লোক, তাঁরা তো বাড়ি-জমি কেনেন বা লাভ হবে- এমন কোনো খাতে বিনিয়োগ করেন। এখন খুব সামান্য টাকার মুনাফা থেকেও ১৫ শতাংশ কর কেটে নেওয়া হবে। আগে ১০ শতাংশ ছিল, টিআইএন না থাকলে এখন ১৫ শতাংশ কাটা হবে। এর প্রভাব তো সবার ওপরই পড়বে।
মোবাইল ফোন গ্রাহকদের বিল থেকে কর আদায়েরও সমালোচনা করে ড. সালেহ উদ্দিন বলেন, 'সরকার কোনো কঠিন পথে যাচ্ছে না। যেখানে সুবিধা হবে সেখান থেকেই কর আদায়ে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ঢালাওভাবে ভ্যাট আরোপ করে কর আদায় বাড়ানো হচ্ছে। এতে এনবিআরের কোনো কৃতিত্ব নেই, বাড়তি কোনো উদ্যোগের প্রয়োজন নেই।' তিনি বলেন, এভাবে কর আদায় করে বিরাট ঘাটতি পূরণ করার এ বাজেটকে কোনো মতেই জনকল্যাণমুখী বলা যায় না।
কর বিশেষজ্ঞ ড. রশিদ উল আহসান চৌধুরীর মতে, মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টধারীর বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত। মধ্যবিত্তের ওপর চাপ কমানোর বদলে যদি বাজেটে আরো চাপ তৈরি করা হয়, তাহলে এ শ্রেণীর বিকাশ হবে না। ১০০ জন মোবাইল ফোন গ্রাহকের মধ্যে ৮০ জনই মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য, বাকি ২০ ভাগ দরিদ্র ও ধনী। তবু একটি স্ল্যাব করা যেত- যাদের বেশি বিল হয় অথবা যাদের ব্যাংকে ১০ লাখ টাকার বেশি আছে, সে রকম ক্ষেত্রে সরকার উৎসে করের কথা ভাবতে পারত।
কর আয় বাড়ানোর আরো উপায় ছিল বলে মনে করেন কর বিশেষজ্ঞরা। তবে সেগুলোতে বাড়তি উদ্যোগের দরকার বলে নীরব করায়নের পথ বেছে নিয়েছে এনবিআর। ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেনের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে তাঁরা বলেন, বাড়িভাড়ার টাকাও ব্যাংকের মাধ্যমে দেওয়ার বিধান করা উচিত ছিল। তাতে বাড়িওয়ালাদের কর ফাঁকি বন্ধ হতো।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমান বলেন, অনেক বাড়িওয়ালা আছেন, যাঁরা বছরে দুই-তিন লাখ টাকা ভাড়া আদায় করে দেখান ৭০ হাজার টাকা। ব্যাংকের মাধ্যমে ভাড়া আদায়ের ব্যবস্থা থাকলে এ ধরনের কর ফাঁকি কমত। ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে, জীবনযাত্রা দেখে কর আদায় করলেও কয়েক হাজার কোটি টাকা কর আয় করতে পারে এনবিআর। বর্তমান জনবল দিয়েই তা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
মোবাইল ফোনে যাঁরা বেশি কথা বলবেন, তাঁরা ২ শতাংশ হারে কর দিতে পারবেন বলেও মন্তব্য করে সাবেক এ কর প্রধান বলেন, তবে গরিব কৃষকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কর বসিয়ে মার্চেন্ট ব্যাংকের ওপর ৫ শতাংশ কর কমানো উচিত হয়নি। তিনি প্রশ্ন করেন, কেন মার্চেন্ট ব্যাংকের কর কমাতে হবে? কোটিপতিরা যাতে ব্যাংক বানিয়ে মোটা লাভ করতে পারেন সে জন্য?
ড. রশিদ উল আহসানও প্রশ্ন করেন, কৃষকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টও যদি করের আওতায় আসে, তা হলে শেয়ারবাজারের অ্যাকাউন্ট কেন বাদ পড়ল? ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে তো বাড়তি আয় হয় না, শেয়ারের অ্যাকাউন্ট থেকে আয় আসে। সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি লিমিটেডের হিসাবে, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য খোলা বেনিফিশিয়ারি ওনার্স বা বিও অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ২২ লাখের বেশি।
উন্নয়ন অন্বেষণের প্রধান ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, পুরো করব্যবস্থায় পরিবর্তন না আনলে এ রকম ন্যায্যতার নীতি ভঙ্গ হতে থাকবে। কর বিভাগে যাঁরা আছেন, তাঁদেরই খুঁজে বের করতে হবে কোন পণ্য বা সেবায় কর বসালে সব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের মতে, ঢালাওভাবে কর আদায় না করে একটি পর্যায় পর্যন্ত আমানত আয় ও মোবাইল ফোন বিলের ওপর কর নেওয়া যেতে পারে। সিপিডি থেকে ওরকম প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।

No comments

Powered by Blogger.