স্মরণ-বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিয়েছেন যিনি by সিমিন হোসেন রিমি

সংস্কারমুক্ত, শিক্ষিত, উদার ও সংস্কৃতিমনস্ক এক সচ্ছল পরিবারে জন্মেছিলেন নূরজাহান। বাড়ির পরিবেশ ও বাবার উৎসাহে জ্ঞানের আলোর সন্ধানে নূরজাহান একে একে পৌঁছে যান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৪৫ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।


পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়েও লেখাপড়া করেন তিনি। লেখাপড়ার পাশাপাশি চলতে থাকে তাঁর সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক চর্চা। একই সঙ্গে তাঁকে আলোড়িত করতে থাকে সমাজের নানা অসংগতি। নারী-পুরুষের হিমালয়সম বৈষম্য তাঁকে ভাবিয়ে তোলে গভীরভাবে।
১৯৪৫ সালে বরিশাল সদর গার্লস স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা পদে যোগ দেন তিনি। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্সের মুসলিম ছাত্রীদের মুন্নুজান হলের সুপারিনটেনডেন্ট পদে নিয়োগ পান তিনি। একই সময় অল ইন্ডিয়া রেডিওতে অনুষ্ঠান সহকারী হিসেবে কাজে যোগ দেন। অল ইন্ডিয়া রেডিও, কলকাতা থেকে প্রচারিত মহিলাদের জন্য অনুষ্ঠান মহিলা মহল পরিচালনা করেন তিনি। সুকণ্ঠের অধিকারী নূরজাহান ছোটদের অনুষ্ঠানও পরিচালনা করেন।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হলে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। এর পরের বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক খান সারওয়ার মুরশিদের সঙ্গে বিয়ে হয় নূরজাহানের।
মনের মধ্যে জেগে থাকা নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তৈরি সুস্থ গণতান্ত্রিক সমাজের আকাঙ্ক্ষা তাঁকে টেনে নিয়ে যায় রাজনীতির মঞ্চে। রাজনীতিক শ্বশুর-বাবার উৎসাহে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হন নূরজাহান। মুসলিম লীগের প্রভাবশালী সদস্য, শিক্ষাবিদ বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদকে পরাজিত করে এমএলএ নির্বাচিত হন তিনি।
নূরজাহান মুরশিদের রাজনীতির ভিত্তি ছিল আদর্শবাদ। কাজ করে গেছেন নিরলসভাবে; কোনো হইচই ছাড়া। তাঁর ছিল না কোনো আত্মপ্রচার। নিরহঙ্কারী মানুষ ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ অনুসারী সদস্য হিসেবে আয়ুববিরোধী আন্দোলনের প্রতিটি ধাপে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৬৯-৭১ সাল পর্যন্ত মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দলকে সংগঠিত করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনার অন্যতম দায়িত্ব পালনকারী এবং নির্বাচিত গণপরিষদের সদস্য। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম কূটনীতিক প্রতিনিধি হিসেবে নূরজাহান মুরশিদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার এবং সরকারের বিভিন্ন ব্যক্তি ও বিরোধীদলীয় নেতাদের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের সংগ্রামরত মানুষের পক্ষে কথা বলেন। নূরজাহান মুরশিদ নিয়মিত বিভিন্ন যুদ্ধশিবির পরিদর্শন করতেন। সেখানে উপস্থিত সমস্যা ও প্রয়োজন সম্পর্কে সরকারের সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে খবর পৌঁছে দিতেন, যেন দ্রুত কিছু করা সম্ভব হয়। স্থানীয় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে, বিশেষভাবে মহিলা ও শিশুদের মানবিক সহায়তা দিতে সচেষ্ট ছিলেন তিনি।
১৯৭২-৭৪ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভায় তিনি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নৃশংসভাবে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সামরিক শাসনের জাঁতাকলে সমাজ তার মূল চেতনার পথ থেকে সরে যেতে থাকে। সমাজ-জীবনে নীতিহীনতা চোখে পড়তে থাকে অহরহ। রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতন্ত্রচর্চায় মরীচিকার হাতছানি। নূরজাহান মুরশিদ বিচলিত বোধ করতে থাকেন। তাঁর স্বপ্ন তাঁকে তাড়া করে ফেরে।
নারী-পুরুষের সম-অধিকারের পক্ষে এ দেশ এ কাল নামের একটি পত্রিকা প্রকাশনায় মনোনিবেশ করেন তিনি। নারী-পুরুষের আবহমান কালের ক্ষমতার বৈষম্য, নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানবিক ও প্রগতিশীল চিন্তার প্রবাহ সৃষ্টি করা ছিল এই পত্রিকার লক্ষ্য। রাজনীতি ও সমাজমানসের গুণগত উৎকর্ষ সাধনের প্রচেষ্টায় এ দেশ এ কাল ছিল উৎসর্গীকৃত।
নূরজাহান মুরশিদের কাছে এ পত্রিকা ছিল একটি আন্দোলন। স্রোতের বিরুদ্ধে হাল ধরা। তাঁর লক্ষ্য ছিল, নাগরিকদের পূর্ণ মর্যাদায় নারীকে প্রতিষ্ঠিত করে পুরুষের পাশাপাশি দেশ গঠন এবং সামাজিক উন্নয়নের সব কর্মকাণ্ডে নারীকে অংশীদার করার সুযোগ সৃষ্টি করা। তাঁর বিশ্বাস ছিল, মেয়েদের অবস্থার উন্নতির জন্য নারী-পুরুষের চিন্তার যেমন ঐক্যের প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন তাঁদের যৌথ প্রচেষ্টা। এ কাজ সম্ভব একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক সমাজে। এমন একটি সমাজের জন্য সংগ্রামের অংশীদার হতে চেয়েছিল তাঁর পত্রিকা।
নূরজাহান মুরশিদের ভাবনা ছিল নিখাদ ও গভীর। তাই তো বলিষ্ঠ অক্ষরে লেখা হয়, পরিবর্তনের জন্য নারীর সংগ্রামকে যেকোনো সমাজের দরিদ্র নিপীড়িত মানুষের সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। নারীর আন্দোলনকে যুক্ত করতে হবে সব ধরনের শোষণ-নির্যাতনের সাধারণ সংগ্রামের সঙ্গে। সমাজে দু-দশজন নারীকে বিশেষ সুবিধাজনক স্থানে বসালেই নারীসমাজের উন্নয়ন হবে না এবং সংসদে মেয়েদের আসনে কোটা বাড়িয়েও তা সম্ভব নয়।
যেন বর্তমানের কথা ভেবে আজও উচ্চারিত হচ্ছে তাঁর শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠস্বর, জীবন ও সম্ভ্রম রক্ষার একটা ন্যূনতম নিরাপত্তা না থাকলে অন্য সব অধিকারের কথা একজন নারীর কাছে অর্থহীন। একজন যোগ্য মানুষ হওয়ার সুযোগ না পেলে সংবিধানে যত অধিকারই তাঁদের দেওয়া হোক না কেন, বাস্তবে তা কোনো কাজে আসবে না। অধিকার ভোগে অনভ্যস্ত নারীকে হঠাৎ যদি বলা হয়, সমাজের সর্বক্ষেত্রে তাঁকে পুরুষের সমান অধিকার দেওয়া হলো, তাহলে নারী কী তা ভোগ করতে পারবেন? সমাজে সেই পরিবেশ তো সৃষ্টি করতে হবে।
নূরজাহান মুরশিদ নেই, আজ তাঁর সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী। কিন্তু একটু ভেবে দেখলে বোঝা যায়, চিন্তাশীল মানুষ নিঃশেষ হয়ে যান না। এই মানুষজন বটবৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে ছায়া দেন যেমন, তেমনি তাঁদের চিন্তা রোদে অঙ্কুরিত হয়ে সঞ্চারিত হয় নতুন প্রাণে। এ প্রবাহ থেমে থাকার নয়।

No comments

Powered by Blogger.