ইরাক-যুদ্ধ শেষ, কিন্তু জয়ও নেই শান্তিও নেই by ফারুক ওয়াসিফ

সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসিকাষ্ঠে তোলার সময় সেখানে উপস্থিত কয়েকজন তাঁকে ধিক্কার দিয়ে বলেছিলেন, ‘জাহান্নামে যাও।’ সাদ্দামের রসবোধ তখনো টিকে ছিল। পরিহাসের সুরে তিনি উত্তর দেন, ‘সেই জাহান্নাম, যার নাম ইরাক?’ মার্কিন আগ্রাসনের আগে ইরাকে হয়তো গণতন্ত্র ছিল না, কিন্তু ২০ বছরের আক্রমণ আর সাত বছরের দখলদারিতে


একদা ‘মধ্যপ্রাচ্যের ওয়েসিস’ ইরাক সত্যিই জাহান্নামে পরিণত হয়েছে। মার্কিনরা এসেছিল, থেকেছিল এবং বিধ্বস্ত অবস্থায় চলে যাচ্ছে। কিন্তু থেকে যাচ্ছে দখলদারির সুবাদে প্রতিষ্ঠিত বহুজাতিক তেল কোম্পানি আর বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের ব্যবসায়ীরা। আর থাকছে মার্কিনদের বসানো ভুঁইফোড় এক শাসকগোষ্ঠী। সেনা আর তাদের প্রভুরা আসে যায়, কিন্তু বণিকেরা ঠিক থেকে যায়। তেলের যুদ্ধ দেশ হেরেছে, জয় হয়েছে তেলতেলে ব্যবসার।
সামনে আমেরিকার মধ্যবর্তী নির্বাচন। তার আগে জনমত জয়ে বারাক ওবামাকে ইরাক যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করতে হলো। কিন্তু সত্যিই কি যুদ্ধ সমাপ্ত? ইরাক কি মুক্ত? যুক্তরাষ্ট্র কি জয়ী? মধ্যপ্রাচ্য কি তাহলে শান্তির মুখ দেখবে? এত সব প্রশ্নের উত্তর এক বিরাট ‘না’। ইরাক মুুক্ত নয়। ৫০ হাজার মার্কিন সেনা ইরাকজুড়ে ছড়ানো বিভিন্ন সেনাঘাঁটিতে রয়ে যাবে। নিয়মিত তারা ইরাকি সেনাদের প্রশিক্ষণ দেবে, তেলক্ষেত্রগুলো তথা পশ্চিমা স্বার্থ পাহারা দেবে এবং বিদ্রোহ দমনে লড়বে তাদেরই তৈরি ইরাকি সেনাদের পাশাপাশি।
যুদ্ধের আগে ইরাকে আল-কায়েদা ছিল না। সাত বছরের মার্কিন দখলদারি সেখানে অজস্র জঙ্গিগোষ্ঠীর জন্মে ধাত্রীর ভূমিকা পালন করেছে। বিস্তীর্ণ ইরাক এখন তাদের প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধে হাতেখড়ির পাঠশালা। সেখান থেকে তারা আরব অঞ্চলসহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। অবস্থা এমন বেচইন যে, যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষিত হলেও জর্জ বুশের মতো বড় গলা করে ওবামা বলতে পারেননি, ‘মিশন অ্যাকমপ্লিশড’—আমরা জয়ী। এ এমন এক যুদ্ধ, যাতে কেউ জয়ী হয়নি। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, হতাশ মার্কিন সেনারা দেশে ফিরছে। তাদের মধ্যে অনেকেই আত্মহত্যা করেছে। অনেকের হাতেই নিরীহ ইরাকি হত্যার রক্ত। অনেকের মনই যুদ্ধের বীভত্সতায় বিকারগ্রস্ত। তাদের অনেকেরই ঘুম হবে না রাতে, অনেকেই স্বাভাবিক জীবনে পুরোপুরি ফিরতে পারবে না। এবং তারা জানবে না, কিসের জন্য তারা জীবন দিতে গেছে, কিসের জন্যই বা আহত বা পরাজিত অবস্থায় তাদের ফিরে আসতে হলো। এর জবাব তাদের রাষ্ট্রপ্রধান তাদের দেননি, তারাও তাদের সন্তানদের এর জবাব দিতে ব্যর্থ হবে।
ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ তিন ট্রিলিয়ন ডলার। প্রায় পাঁচ হাজার মার্কিন সেনা কফিনে করে স্বদেশে ফিরেছে। জাতিসংঘের অনুমতি ছাড়া একতরফাভাবে নিরস্ত্র দেশে আগ্রাসন চালানোয় যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বনেতৃত্বের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কেবল যুক্তরাষ্ট্রই নয়, আটলান্টিকপারের পরাশক্তিগুলো, যথা: জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ ন্যাটোভুক্ত প্রধান প্রধান দেশ বিশ্বে যে একচেটিয়া ক্ষমতাচর্চায় অভ্যস্ত ছিল, ইতিমধ্যে সেই একচেটিয়ায় ফাটল ধরেছে। ইরাক-আফগানিস্তান তাদের নৈতিক ও সামরিক ব্যর্থতার নজির। পাশাপাশি জাতিসংঘ পরিণত হয়েছে এক অকার্যকর সংগঠনে। আর কোনো দুর্বল রাষ্ট্র জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় আস্থা পাবে না। চীন-রাশিয়া বা ভারতের মতো শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রয়োজন পড়বে না জাতিসংঘকে মান্য করার। কাশ্মীর বা ফিলিস্তিন ইস্যুতে কিংবা জর্জিয়ায় রুশ সেনা হস্তক্ষেপের বেলায় জাতিসংঘের ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’ ভূমিকা প্রমাণিত হয়েছে। ইরাক যুদ্ধ পশ্চিমের সমাজগুলিকেও নড়িয়ে দিয়েছে।
অন্যদিকে যে ইরাক ছিল মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, মার্কিন তদারকিতে প্রতিষ্ঠিত সেখানকার রাজনীতিতে এখন ধর্মভিত্তিক দলের ছড়াছড়ি। সাদ্দামের অনুসরিত ধর্মনিরপেক্ষতা ও আধুনিকতা ইরাকি গণকবরের নিচে চাপা পড়েছে। ইরাকের দক্ষ ও অভিজ্ঞ পেশাজীবী, বিজ্ঞানী, শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই নিহত এবং অনেকেই নির্বাসিত। ইরাকের শিল্পভিত্তি পুরোপুরি ধ্বংস করা হয়েছে। সমাজ বহু ভাগে বিভক্ত। দীর্ঘ অর্থনৈতিক অবরোধে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে আধুনিক ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীও মোটামুটি বিলীন।
সম্পদই শুধু নয়, প্রাচীন ইরাকি সভ্যতার নিদর্শনগুলো লুণ্ঠিত ও পাচার হয়ে গেছে। যে ইরাক সভ্যতাকে দিয়েছিল প্রথম আইন, সেই ইরাকে আইন ও সভ্যতা বেআইনি যুদ্ধের বর্বরতার কাছে পরাজিত। যে দজলা ও ফোরাতের তীরে প্রাচীনতম কৃষিসভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল, অবরোধ ও যুদ্ধের কারণে সেই দজলা ও ফোরাত দিয়ে নিহত ১০ লাখ ইরাকির রক্ত বয়ে গেছে। যে ইরাক বিশ্বকে গণিত উপহার দিয়েছিল, সেই ইরাকে আজ গণিতের ব্যবহার হয় লাশ গণনা আর যুদ্ধ-ব্যবসার মুনাফা পরিমাপের কাজে। সুমেরীয় সভ্যতার প্রাচীন নগরগুলো আজ লুণ্ঠিত। বাগদাদ জাদুঘরে রক্ষিত হাজার হাজারের প্রত্নতাত্ত্বিক ঐশ্বর্য এক দিনের লুণ্ঠনেই বেহাত হয়ে গেছে। সভ্যতাগর্বিত পাশ্চাত্য সভ্যতার নাম করেই মানবসভ্যতার একটি বড় কেন্দ্রকে তছনছ করে দিল। ইরাককে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে শত বছর পেছনে। আর কোনো আগ্রাসন এত অল্প সময়ে কোনো দেশের এত ক্ষতি করেছে কি না সন্দেহ।
ইরাক ছিল সুন্নি প্রভাবিত বাথ পার্টির অধীনে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা শিয়া-সুন্নি গোষ্ঠীযুদ্ধ সাদ্দামের ইরাকে ছিল অকল্পনীয়। কিন্তু আমেরিকার ‘ভাগ করো শাসন করো’ খেলা ইরাকি সমাজের সংহতি ধ্বংসপ্রায়। তাদের হাত ধরে এখন সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শিয়াদের আধিপত্য। ইরাকের সঙ্গে এদিক থেকে ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের মিল। যে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ-শাসনের আগের শত শত বছরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কোনো নজির পাওয়া যায় না, তাদের অধীনে সেই ভারত হয়ে ওঠে সাম্প্রদায়িক ঘৃণার বীজভূমি। ইরাক বিদেশি দখলদারিতে ভুগেছে, এখন ভুগছে শিয়া-সুন্নি বিরোধের আতঙ্কে। গত মার্চের নির্বাচনে সেখানে শিয়া নেতৃত্বাধীন জোট জয়ী হলেও এখনো নতুন সরকার গঠিত হয়নি। সুন্নি নেতৃত্বাধীন বাথ পার্টিসহ অন্যান্য গোষ্ঠীও শক্তি সংগ্রহ করছে। মার্কিন সেনাদের হত্যা-নির্যাতন, ধরপাকড়ের আতঙ্ক থেকে ইরাকিরা এখন চালান হয়েছে গৃহযুদ্ধের আতঙ্কের গহ্বরে।
শেষ পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে যারা দাঁড়িয়ে থাকে, তারাই জয়ী। ইরাকি রণাঙ্গনে এখন ইরাক ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই বিপর্যস্ত। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ইরান। একসময় মার্কিন সমর্থনপুষ্ট সাদ্দামের শত্রুতা তাদের মোকাবিলা করতে হয়েছে। কিন্তু এখন রাজনৈতিক বা সামরিক কোনো দিক থেকেই ইরাক শিগগির আর ইরানকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে না। মার্কিন সেনাদের বড় অংশের বিদায়ের পর শক্তিশালী শিয়া সংগঠন তথা ইরান প্রভাবিত দলগুলোই এখন খোদ ইরাকে বসে ইরানের স্বার্থ দেখবে। ইরাককে পরাজিত করে ইরানের ঘাড়ে গরম নিঃশ্বাস ছাড়তে চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, কিন্তু আজ ইরান ইরাক থেকে লেবানন পর্যন্ত তার রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভাব ছড়িয়ে দিয়েছে। লেবাননের হিজবুল্লাহ আর গাজার হামাসের মাধ্যমে ইরানের গরম নিঃশ্বাস এখন ইসরায়েলের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের গায়েও লাগার কথা।
সাদ্দামের ইরাক ইরানের জন্য বড় হুমকি ছিল। জর্জ বুশ ইরাককে পদদলিত করে বিশ্বসম্রাটের বিজয়ীর হাসি হাসতে চেয়েছিলেন, কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে, তা পরিহাস হয়ে দেখা দিয়েছে।
আমেরিকার যুদ্ধ শেষ হলেও সাদ্দামের সহযোগী ইজ্জত ইব্রাহিম আল দৌরির নেতৃত্বে প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়া বাথ পার্টি বলছে, কিসের যুদ্ধ শেষ! তারা ঘোষণা দিয়েছে, যত দিন শেষ মার্কিন সেনা ইরাকে থাকবে তত দিন প্রতিরোধ চলবে। ইজ্জত ইব্রাহিম বলেছেন, ‘আমাদের দল প্রতিরোধের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে। যত দিন মার্কিন সেনা ও মার্কিনিদের তৈরি সংবিধান ইরাকে থাকবে, তত দিন আমরা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেব না। এই সংবিধান দখলদারির ফসল।’
যুক্তরাষ্ট্র গণবিধ্বংসী অস্ত্র ধ্বংসের অজুহাতে, বিশ্বকে নিরাপদ করার কথা প্রচার করে ইরাকে হানা দিয়েছিল। কিন্তু ইরাক যুদ্ধের পর বিশ্ব এখন আরও অনিরাপদ। বিশ্বের মুসলিমদের মনে এমন ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে যে, পশ্চিমকে তারা আর সহজে বিশ্বাস করতে পারবে না। সবকিছুই করা হয়েছিল টুইন টাওয়ার ধ্বংসের প্রতিশোধের নামে। সম্প্রতি ইরানের প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদ দাবি করেছেন, টুইন টাওয়ার ধ্বংস যুদ্ধের অছিলা তৈরিতে বুশ প্রশাসনেরই কাজ। অনেক মার্কিনসহ বিশ্বের বাঘা বাঘা বিশ্লেষকও দিনে দিনে এই অভিযোগে আস্থা আনছেন, প্রমাণ হাজির করছেন। হয়তো একদিন সত্যি কী ঘটেছিল, মানুষ জানবে।
বারাক ওবামার ‘যুদ্ধ শেষ’ ঘোষণার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের দায়দায়িত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে ছেড়ে দিল। আগে যুদ্ধটা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের, এখন তা হয়ে গেল কেবলই ইরাকের। ইরাককে এখন শান্তি, সমৃদ্ধি ও গণতন্ত্রের জন্য নিজের সঙ্গেই লড়াই করে যেতে হবে। যুদ্ধ শেষ মানেই তাই শান্তি নয়।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.