তথ্যপ্রযুক্তি-ডিজিটাল বাংলাদেশ করার নানা উদ্যোগ by এ এম এম শওকত আলী

ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার নানা কর্মসূচি ২০০৯ সালের আগে থেকেই সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে গ্রহণ করা হয়েছিল। ২০০৯-এর পরবর্তী পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার ফলে এ-সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারি উদ্যোগ অধিকতর জোরদার হয়েছে বলে অনেকে দাবি করেন।


জোরদারকরণের একটি উদ্যোগ হলো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কর্তৃক ইউএনডিপির সহায়তায় গৃহীত একটি প্রকল্প, যার শিরোনাম হলো তথ্য প্রাপ্তির সুযোগ বা ‘অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন’ কর্মসূচি। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে বেশ কিছু লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি। সব কটি মন্ত্রণালয় বা বিভাগ বর্তমানে মাঠপর্যায়ে এ-সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড চালু করেনি। যে কটি মন্ত্রণালয় মাঠপর্যায়ের দপ্তরের মাধ্যমে এ সেবার সুযোগ সৃষ্টি করেছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো কৃষি, স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও প্রাথমিক গণশিক্ষা।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার্বিক তত্ত্বাবধানে কৃষিতথ্যসেবা দপ্তর রয়েছে। এ দপ্তরটি প্রাথমিকভাবে ইউনিয়ন পর্যায়ে ১০টি ডিজিটালভিত্তিক কৃষিসংক্রান্ত তথ্য পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ভবিষ্যতে এ কেন্দ্রের সংখ্যা এক হাজারে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে চালু ১০টি কেন্দ্র থেকে কৃষিসংক্রান্ত কী কী তথ্য কৃষক পর্যায়ে দেওয়া হয়, সে বিষয়গুলো জানতে হলে মাঠপর্যায়ে থেকেই প্রয়োজনীয় তথ্য জানা সম্ভব। এর সঙ্গে যোগ করা যায় মোট কতজন কৃষক প্রতি মাসে কী কী বিষয়ে সর্বাধিক তথ্য গ্রহণে আগ্রহী।
স্থানীয় সরকার বিভাগের এলজিইডিও তথ্য আদান-প্রদানসংক্রান্ত মোট ৩০টি কেন্দ্র চালু করেছে। এর মধ্যে ২৯টি সক্রিয়, একটি সক্রিয় নয়। ভবিষ্যতে আরও অধিকসংখ্যক কেন্দ্র চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। তথ্যসংক্রান্ত যেসব সেবা এরা দিয়ে থাকে, তার মধ্যে কৃষিও রয়েছে। এ কথা সত্যি হলে বলতে হবে যে যদি কোনো দ্বৈততা থাকে, তবে তার সমন্বয় করা প্রয়োজন। ২০০০ সালে জনপ্রশাসন কমিশন অন্তত শহরাঞ্চলের নাগরিক সেবা দেওয়ার যে সুপারিশ করেছিল, তার উদ্দেশ্য ছিল একই কেন্দ্র থেকে বহুবিধ বিষয়ে সেবা দিলে সুবিধাভোগী নাগরিকেরা স্বস্তি বোধ করবে। বর্তমানে চালু কৃষিতথ্য অধিদপ্তরের ১০টি কেন্দ্র থেকে কৃষি খাত ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ে তথ্য দেওয়া হয়। একই কাজ এলজিইডির ইউনিয়নভিত্তিক কেন্দ্রও করে কি না, সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্যও মূল্যায়ন প্রয়োজন। তবে এসব কেন্দ্র থেকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, ই-মেইল পাঠানোর ব্যবস্থাও রয়েছে। এমনকি ছবিও তোলা হয়। এসব সেবার মাধ্যমে এসব কেন্দ্রের কিছু আয়ও হয়। প্রাপ্ত আয়ের অর্থ কীভাবে সংরক্ষণ ও ব্যবহার করা হয়, সেসব বিষয়েও তথ্য প্রয়োজন। মাঠপর্যায়ে মূল্যায়নের ভিত্তিতেই এটা করা সম্ভব।
এসব কেন্দ্রের সময়সূচি কী এবং তা সুবিধাভোগীবান্ধব কি না, সে বিষয়টিও জানা অত্যন্ত জরুরি। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ বর্তমানে নেই। বিশেষ করে, গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুত্হীন অবস্থায় এ কেন্দ্রগুলো কীভাবে চালু থাকে, সে বিষয়টিও জানা প্রয়োজন। এর জন্য বিকল্প কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে কি না, হলে তা কতটা ব্যয়বহুল, তাও জানা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে একটি প্রাসঙ্গিক বিষয় হলো, প্রকল্পের মেয়াদান্তে সেবাকেন্দ্রগুলো অব্যাহতভাবে চালু রাখা সম্ভব হবে কি না। এখানেই চলে আসে ব্যয়ের বিষয়টি। যদি দেখা যায় যে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের লব্ধ আয় থেকে কেন্দ্রগুলো চালু রাখা সম্ভব, তাহলে সমস্যা নেই। কিন্তু এটা যদি সম্ভব না হয়, তাহলে বাড়তি খরচ সরকারকেই অনুদান হিসেবে জোগান দিতে হবে। অন্যথায় কেন্দ্রগুলোর কাজ স্তব্ধ হয়ে যাবে। এটাই একটি বড় ঝুঁকি, যে বিষয়ে এখন থেকেই পরিকল্পনা প্রয়োজন।
ইউনিয়নভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে কর্মসংস্থানসহ জীবিকাসংক্রান্ত বিষয়েও তথ্য প্রদান করা হয়ে থাকে। গ্রামীণ বেকারদের জন্য এটা তাদের কী কাজে আসে, সে বিষয়েও প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা একান্তই প্রয়োজন। একই সঙ্গে অন্য একটি প্রাসঙ্গিক তথ্যও জানা প্রয়োজন; তা হলো, যেসব ব্যক্তি কম্পিউটার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়, তাদের ব্যবহারিক জীবনে অথবা জীবিকায়নের জন্য এ প্রশিক্ষণ কোনো কাজে আসে কি না। প্রশিক্ষণ-পরবর্তী পর্যায়ে এ-সংক্রান্ত বিষয়ে যদি সে কোনো কাজ না পায়, তাহলে অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হবে যে প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান ও দক্ষতা সে ভুলে যাবে। কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হলে এ বিষয়গুলো চিহ্নিত করার প্রয়োজন রয়েছে।
সরকারঘোষিত গ্রামীণ বেকার যুবক কর্মসংস্থান কর্মসূচির সঙ্গে এসব কেন্দ্রের কোনো যোগসূত্র আদৌ রয়েছে কি না, সে বিষয়টিও জানা প্রয়োজন; কারণ ঘোষিত কর্মসূচির আওতায় প্রশিক্ষণের বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছিল। যদি কোনো যোগসূত্র না থাকে, তাহলে এটা করা প্রয়োজন। অবশ্য গ্রামীণ শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতীদের সবাই যে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে, সে বিষয়টিও নিশ্চিত নয়। শিক্ষাগত যোগ্যতার মাপকাঠি অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব। এর মধ্যে সাধারণ কারিগরিবিষয়ক প্রশিক্ষণও হতে পারে। যেমন, স্বল্প পরিসরের বৈদ্যুতিক যন্ত্র মেরামত, সেচযন্ত্রের মেরামত এবং গ্রামীণ জনজীবন-সহায়ক অন্যান্য ক্ষেত্র। কৃষি অর্থনীতিবিদেরা একটি বিষয় প্রায়ই উল্লেখ করেন, তা হলো, কৃষি খাত ও অকৃষি খাতের মধ্যে নিবিড় সংযোগ স্থাপনের (Farm and Non-farm Linkage) মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি। এ বিষয়ে কিছু গবেষণামূলক কাজও করা হয়েছে। গবেষণালব্ধ সুপারিশের ভিত্তিতে কোনো নির্দিষ্ট কর্মকৌশল বাস্তবায়ন করলে গ্রামীণ কর্মসংস্থান অধিকতর মাত্রায় নিশ্চিত করা সম্ভব হতে পারে।
সার্বিক অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, কিছুটা বিক্ষিপ্তভাবে ডিজিটাল পদ্ধতির মাধ্যমে তথ্যসেবা প্রদানের কর্মকাণ্ড চলছে। প্রাথমিক উদ্যোগ হিসেবে এ বিষয়টি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় হলেও এখন আরও গভীরভাবে সার্বিক কর্মকাণ্ড মূল্যায়নের সময় এসেছে। অত্যন্ত আশার কথা যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ ইউএনডিপি অচিরেই সামগ্রিকভাবে মূল্যায়নের পরই প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু করবে।
স্বাস্থ্য খাতের গৃহীত কমসূচির মধ্যে রয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে টেলিফোনের মাধ্যমে রোগসংক্রান্ত পরামর্শ দেওয়ার ব্যবস্থা। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জন্য এটা করা হয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় উপজেলা স্বাস্থ্য দপ্তরে একটি করে মোবাইল ফোনের জন্য এ প্রকল্প অর্থ জোগান দিয়েছে। এর আওতায় কিছু জেলা সদরের হাসপাতালও অন্তর্ভুক্ত। সরকারের ঘোষিত নীতি অনুযায়ী আগে অবহেলিত গ্রাম পর্যায়ের কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে এ সেবা দেওয়া অধিকতর যুক্তিসংগত ছিল। হয়তো বা অবকাঠামোগত ও প্রশিক্ষিত চিকিত্সকের স্বল্পতার জন্য এটা করা সম্ভব হয়নি। অন্তত পরীক্ষামূলকভাবে ইতিমধ্যে স্থাপিত ক্লিনিকের মাধ্যমে এ সেবা দেওয়া সম্ভব ছিল। আশঙ্কার বিষয়টি হলো, ডিগ্রিধারী সরকারি চিকিত্সকেরা কমিউনিটি ক্লিনিক তো দূরের কথা, উপজেলা পর্যায়েও কাজে অনীহা প্রকাশ করেছেন।
এত দিন শোনা গিয়েছিল, হাজার হাজার সরকারি চিকিত্সকের পদ শূন্য। এ শূন্যতা দূর করার জন্য সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে; অস্থায়ীভাবে বা অ্যাডহক ভিত্তিতে বেশ কিছুসংখ্যক চিকিত্সক নিয়োগ করা হয়েছে। পত্রিকান্তরে জানা যায়, তাঁদের অনেকেই কাজে যোগ দেননি। খোদ সরকারপ্রধান এ বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি দিলেও কোনো সুফল হয়েছে কি না জানা নেই। এ জন্যই একসঙ্গে চার শতাধিক উপজেলা স্বাস্থ্য দপ্তরে এ ধরনের কর্মসূচি চালু করা কতটুকু বাস্তবসম্মত হয়েছে, সে বিষয়টি বিবেচনার দাবি রাখে। আশা করা যায়, যে মূল্যায়নের কাজ করা হবে, তার মাধ্যমে এ বিষয়ে নিরপেক্ষ তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হবে।
কৃষি খাতে সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে কৃষকদের প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহের জন্যও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পত্রিকায় এর নাম দেখা গেল ই-কৃষক। একটি বেসরকারি সংস্থা গ্রামীণফোনের সহায়তায় গ্রামীণ তথ্যকেন্দ্র সারা দেশে চালু করবে। ইতিমধ্যে শতাধিক কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে সর্বমোট এক হাজার ২০০ নিবন্ধনকৃত সদস্য বা সুবিধাভোগী রয়েছেন। প্রায় এক হাজার ৪০০ কৃষককে বর্তমানে সেবা দেওয়া সম্ভব। এখন পর্যন্ত কৃষকদের থেকে পাওয়া প্রায় ছয় হাজার প্রশ্নের জবাব দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এ কর্মসূচি চালু করার জন্য কম্পিউটার প্রশিক্ষণের কাজ জেলা প্রশাসকের সার্বিক তত্ত্বাবধানে করা হয়। এর অন্য নাম কমিউনিটি তথ্যকেন্দ্র। মূল প্রশ্নটি হলো, সরকারি কৃষি তথ্য অধিদপ্তরের কার্যক্রমের সঙ্গে এ কর্মসূচি দ্বৈততার সৃষ্টি করছে কি না?
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গৃহীত অন্য একটি কৃষকবান্ধব কর্মসূচির নাম ই-পুরজি। বিষয়টি আখচাষিদের জন্য। পুরজি শব্দটির অর্থ হলো আখ ক্রয়ের আদেশ বা পারচেস অর্ডার। এ কর্মসূচিকে ডিজিটাল পুরজি তথ্যসেবা বলা হয়ে থাকে। পুরজি মোতাবেক তিন দিনের মধ্যে আখ সরবরাহ না করতে পারলে পুরজির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। ফলে কৃষকের ক্ষতি হয়। এ কর্মসূচি বর্তমানে দুটি সরকারি চিনিকলে চালু আছে। উত্সাহব্যঞ্জক সাড়া পাওয়ায় সর্বমোট ১৫টি কলে এ সেবা সম্প্রসারিত করার পরিকল্পনা রয়েছে। যদি তা-ই হয়, তাহলে এ কর্মসূচি সম্প্রসারণের বিষয়টি অযৌক্তিক হবে না। তবে নিরপেক্ষ মূল্যায়ন প্রয়োজন। অন্য প্রাসঙ্গিক বিষয়টি হলো, তাড়াহুড়ো করে সম্প্রসারণ করলে ঝুঁকির প্রশ্ন অবশ্যই রয়েছে।
ডিজিটাল পদ্ধতির মাধ্যমে সারা দেশে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান অবশ্যই কাম্য। তবে যে বিষয়টি মুখ্য এবং মনে রাখতে হবে তা হলো, প্রচারের আধিক্যের ফলে সাফল্যের স্বল্পতা যেন চাপা না পড়ে।
এ এম এম শওকত আলী: সচিব। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।

No comments

Powered by Blogger.