বাজেটে সাধারণ মানুষের ওপরই চাপ বাড়বে-ভারসাম্য ফেরানোর খণ্ডিত প্রয়াস

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত যখন গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে এক লাখ ৯১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করলেন, তখন তাঁকে বিগত তিন বছরের অসম্পূর্ণ ও অসম্পন্ন কাজগুলোর কথা উল্লেখ করতেই হলো। এটাকে ইতিবাচক বলা যেতে পারে এ জন্য যে, তিনি স্বচ্ছতার সঙ্গে স্বীকারোক্তি করেছেন,


জাতির সামনে করতে না পারা কাজগুলোর একটা খতিয়ান উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। এই অসম্পন্নতার জের টানার কারণে শেষ হতে যাওয়া ২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেটের চ্যালেঞ্জগুলো আগামী অর্থবছরেও বহাল রয়ে গেল।
অথচ, আগামী অর্থবছরে অর্থমন্ত্রী অনেক কিছু করতে আগ্রহী। এ জন্য তাঁকে অর্থের সংস্থান করতে হবে। আর এটাই বরাবরের মতো তাঁর জন্য দুরূহ কাজ। বাজেট ব্যয়ের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ অভ্যন্তরীণভাবে কর ও রাজস্ব আয় থেকে মেটালেও বাকিটা দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিয়ে মেটাতে হবে। বিদেশি ঋণ-অনুুদান প্রাপ্তিতে চলতি বছরে নাজুক অবস্থা দেখা দিয়েছে। তার পরও লক্ষ্যমাত্রা ৪২ শতাংশ বাড়িয়ে ধরেছেন অর্থমন্ত্রী, যা কার্যত অসম্ভব। ফলে ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ এবারের মতোও লক্ষ্যমাত্রা অনেক ছাড়িয়ে যেতে পারে, যা একদিকে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের সুযোগ সংকুচিত করবে, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি বাড়াবে। কিন্তু নির্বাচন সামনে রেখে উন্নয়ন ব্যয় তথা খরচ বাড়ানোর একটা তাগিদ সরকারের ভেতরে থাকবেই। সে ক্ষেত্রে ব্যয় মেটানোর জন্য অনেকটা মরিয়া চেষ্টা করতে হবে অর্থমন্ত্রীকে।
মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর ২ শতাংশ হারে এবং টিআইএন না থাকলে ব্যাংকের সুদে ১০ শতাংশের বদলে ১৫ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তনের মতো পদক্ষেপ সাধারণ মানুষকে লেবু চেপার মতো নিংড়ে কর আদায়েরই নামান্তর। অথচ লাখ লাখ পেনশনভোগী, গৃহবধূ, ছাত্র থেকে বিভিন্ন শ্রেণীপেশার সাধারণ মানুষ তাঁদের সঞ্চয়ের নিরাপদ স্থান হিসেবে ব্যাংকেই অর্থ রাখছেন। এভাবে উৎসে কর কর্তন তাঁদের আবারও ব্যাংকে অর্থ রাখতে অনুৎসাহিত করবে আর রাখলেও প্রকারান্তরে কর-জালের আওতায় আসতে বাধ্য করা হবে। অথচ, অর্থমন্ত্রী শেয়ারবাজারে ব্যক্তি বিনিয়োগকারীকে টিআইএন বাধ্যতামূলক করতে পারেননি, তাদের লাখ লাখ টাকা মূলধনি মুনাফার ওপর একটি টাকাও কর আদায়ের সাহস দেখাননি। কেননা, শেয়ারবাজারে এসব বিনিয়োগকারীকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে ফাটকা কারবারিদের বড় বড় শক্তিশালী চক্র। তাদের বাগে আনতে না পেরে অন্যায্য ছাড় দিয়ে এখন সাধারণ মানুষের সীমিত সঞ্চয়ের ওপর হাত দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। ঢালাওভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগও সৎ করদাতাদের হতাশা বাড়াবে।
আবার রপ্তানিকারকদের উৎসে আয়কর দ্বিগুণ করেছেন। বিশ্ব-অর্থনীতি যেখানে আরেক দফা মন্দার মধ্যে ঢুকতে যাচ্ছে এবং ইতিমধ্যেই যার প্রভাবে দেশের রপ্তানি আয় কমে গেছে, সেখানে এই পদক্ষেপও সমর্থনযোগ্য নয়। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্ত পূরণে বাজেটে না বললেও ভবিষ্যতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে হবে তাঁকে। তা না হলে ভর্তুকির ভার কমাতে পারবেন না। ফলে রপ্তানিমুখী শিল্পে আরেক দফা আঘাত আসবে।
২০০৯-১০ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য জোরালো চাহিদার মতো অনুকূল বৈশ্বিক ও নিম্ন মূল্যস্ফীতির মতো দেশীয় অবস্থা বিরাজ করছিল। কিন্তু সরকার সেদিকে অর্থবহ মনোযোগ না দিয়ে কুইক রেন্টালের মতো অত্যন্ত ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ উৎপাদনে জোর এবং শেয়ারবাজারে কৃত্রিম স্ফীতি উসকে দেওয়ার মতো পদক্ষেপ নিয়ে রাজস্ব ও আর্থিক খাতে দীর্ঘমেয়াদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পথ প্রশস্ত করেছে। এই বিশৃঙ্খলার জের টানতে হচ্ছে এখনো। তিন বছর পরে এসে তাই অর্থমন্ত্রী এলোমেলো হয়ে পড়া অর্থনীতির ভারসাম্য কোনোমতে ঠিক করার প্রয়াস নিয়েছেন। তবে এর ঝুঁকিটাও কম নয়।

No comments

Powered by Blogger.