চারদিক-শাঁখারীবাজারে একদিন by শর্মিলা সিনড্রেলা

প্রতিদিন সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে শাঁখা-সিঁদুর পরা একটা মেয়ে ঘরে জ্বালিয়ে দেয় সন্ধ্যাপ্রদীপ। উলুধ্বনি দিয়ে বাজায় শঙ্খ। তারপর সবার মঙ্গল কামনায় প্রণাম করে ভগবানের কাছে এবং স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধায় শাঁখা ছোঁয়ায় কপালে। স্বামীকে তারা দেবতা মনে করে। শাঁখারীবাজারের সেই মেয়েটাও ব্যতিক্রম নয়। মেয়েটার হাত রীতিমতো লাল।


প্রচণ্ড জ্বলছে হাতখানা। তার পরও তার মুখে হাসি। কেননা, স্বামীর মঙ্গল কামনায় তার যত কষ্টই হোক, সে তা সইবে। শাঁখারীবাজারে গিয়ে এমন চিত্রই দেখা গেল। ওয়ারীর রানী ঘোষ এসেছিলেন নিজের জন্য শাঁখা কিনতে। শাঁখা পরতে গিয়েই তাঁর হাতের এই অবস্থা। তার পরও স্বামীর মঙ্গল কামনায় এবং ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে তিনি এটা পরছেন। শাঁখারীবাজারে গেলে দোকানে দোকানে এই চিত্র দেখা যাবে। বিবাহিত হিন্দু মেয়েরাই মূলত এই শাঁখা কিনতে আসেন। শাঁখা-সিঁদুর তাঁদের কাছে সর্বাধিক মূল্যবান।
তবে শাঁখা এখন ফ্যাশনও। সব সম্প্রদায়ের মেয়েরাই ব্যবহার করে শাঁখা।
শাঁখারীবাজারে বেশ কয়েকটা দোকান আছে শাঁখার। তাই বেশ ঘুরে ঘুরে, যাচাই-বাছাই করে শাঁখা কিনতে পারেন ক্রেতারা। এখানকার দোকানিরা ক্রেতাকে দেবতা মনে করেন। ফলে সমাদরটা একটু বেশিই পান ক্রেতারা। এমনই শাঁখার এক দোকান সাজিয়ে বসেছেন নকুলেশ্বর নাগ। দোকানে নানা রকমের শাঁখা থরে থরে সাজানো। ভারি দৃষ্টিনন্দন, নজরকাড়া এবং একটির কারুকার্য আরেকটির থেকে পুরোপুরি ভিন্ন। কী নিখুঁত সব কাজ! কোনোটাতে যদি ময়ূরের ছাপ তোলা, তবে অন্যটাতে আছে হাতির মুখ। যথেষ্ট ধৈর্য ও শৈল্পিক মন না থাকলে সম্ভব নয় এমনভাবে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা। শুধু শাঁখাই নয়, হিন্দুদের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিস ও বিয়ের টুকিটাকি সামগ্রী—মুকুট, সিঁদুর, পলা—এসবও পাওয়া যায় এখানে। প্রতিদিনের সান্ধ্য আরতির প্রধান বাদ্য শঙ্খও পাওয়া যায় এখানে। ‘এসব করা হয় মূলত এক ধরনের শামুক থেকে। সুদূর শ্রীলঙ্কা থেকে আনা হয় এটা। হিন্দু মেয়েরাই তা বেশি পরে, তবে মুসলমানরাও যে একেবারে পরে না, তা নয়। তারাও এখন অনেকে এসে নিয়ে যায় শাঁখা।’ বলছিলেন নকুলেশ্বর নাগ। প্রায় ৪০০ বছরের ব্যবসা তাঁদের। বাবা-দাদারা সবাই করে গেছেন এই ব্যবসা। তাঁরা ধরে রেখেছেন সেই ঐতিহ্য। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে সবকিছু। আগে তাঁদের কারুকার্য করার শিল্পী ছিল প্রায় ৮০ জন, এখন আছে মাত্র ২০ জন। ‘এখন শাঁখা বিক্রি খুব কম হয়। দেখা যায়, পুজোর সময় একটু বেশি বিক্রি হয়। তা ছাড়া ক্রেতারা আসে খুব কম।’ বলছিলেন নকুলেশ্বর নাগের ছোট ভাই দক্ষিণেশ্বর নাগ।
শঙ্খ ভবনের অসীম কুমার সুর বলছিলেন, ‘এখানে প্রায় ১৫ থেকে ২০টা দোকান আছে শাঁখার। আমরা প্রতিদিনই দোকানের পসরা সাজিয়ে বসি। বছরে কেবল দুই দিন দোকান বন্ধ থাকে। ভাদ্র মাসের ১৭ ও ৩১ তারিখ। প্রতিবছর ভাদ্র মাসের ১৭ তারিখে হয় বিশ্বকর্মা। এই পুজো সব কারিগরের পুজো। তাই আমাদের বাবা-দাদারা তো সেই ১৭ তারিখ থেকে পুরো মাসই দোকান বন্ধ রাখতেন। এখন তো আমরা মাত্র দুই দিন বন্ধ রাখি।’
শাঁখারীবাজারেরই আরেক দোকানি অমৃত নাগদের ব্যবসা প্রায় ৭৫ বছরের। তিনি বলেন, ‘যে শামুক থেকে শাঁখা বা শঙ্খ এবং অন্যান্য জিনিসপত্র তৈরি করা হয়, তা আসে শ্রীলঙ্কা থেকে।
এ ছাড়া কেবল মাদ্রাজে এই শামুক পাওয়া যায়। আমরা ছয় মাস পরপর শ্রীলঙ্কায় যাই, অনেক শঙ্খ নিয়ে আসি। তারপর আমরা নিজেরা মেশিন দিয়ে কাটি এবং তার ওপর শিল্পীদের দিয়ে ডিজাইন করাই।’
শাঁখারীবাজারে শাঁখা পাওয়া যাবে—এটাই স্বাভাবিক। এই শাঁখারীবাজারে আরও পাওয়া যায় পলা, সিঁদুর, শঙ্খ ও পুজোর যাবতীয় উপকরণ পাওয়া যায়। একেকটা জিনিসের একেক রকম দাম। ২০ টাকায়ও শাঁখা পাওয়া যায়। আবার কোনো কোনো শাঁখার দাম দুই হাজার টাকা পর্যন্ত। শাঁখার সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে শিল্পীর অপরূপ কারুকার্য। শাঁখায় সোনা বাঁধাতে চাইলে বিশেষ শাঁখার খোঁজ মিলবে শাঁখারীবাজারে। তবে এমন শাঁখার দাম বেশি, প্রায় আড়াই হাজার টাকা।
তো, কবে যাচ্ছেন শাঁখারীবাজারের শাঁখা দিয়ে নিজের হাত ভরিয়ে তুলতে?

No comments

Powered by Blogger.