প্রি-পেইড মোবাইলে ছাড়ের ইঙ্গিত-অর্থমন্ত্রীর বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন

বিত্তবানদের কাছ থেকে না পাওয়া করের টাকা সরকার দেশের আমজনতার কাছ থেকে মোবাইল ফোন রিচার্জে উৎসে কর বসিয়ে এবং সর্বনিম্ন আয়করের পরিমাণ তিন হাজার টাকা নির্ধারণ করে আদায়ের চেষ্টা করছে কি না- সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাব দেননি অর্থমন্ত্রী।


তবে বৃহস্পতিবার বাজেট বক্তৃতায় মোবাইল ফোন বিলের ওপর যে ২ শতাংশ উৎসে কর আরোপের কথা বলেছেন, সেখান থেকে প্রি-পেইড মোবাইল গ্রাহকদের ছাড় দেওয়ার কিছুটা ইঙ্গিত দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি শুধু বলেছেন, 'গ্রামগঞ্জের সবাই মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। তারা প্রি-পেইড মোবাইল ফোনে কথা বলে। এটা খুবই ভালো বিষয়। তাই এটা পুনর্বিবেচনা করা হবে।'
গতকাল শুক্রবার ঢাকার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী এসব কথা বলেন। সাধারণ মানুষকে করের জালে আটকানোর প্রস্তাবের পরও মন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, এটা জনগণেরই বাজেট। বাজেটে জনগণের মৌলিক চাহিদা মেটানো ও উন্নয়নকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য মহার্ঘ্য ভাতা চালুর কোনো পরিকল্পনা নেই জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, '২০০৯ সালে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ব্যাপক হারে বেড়েছে। তাই মহার্ঘ্য ভাতা দেওয়ার চিন্তা নেই। তবে আমরা একটি স্থায়ী পে-কমিশন করতে চাই। মেয়াদের শেষের দিকেই তা করে যাব।'
মন্ত্রী বলেন, অধিকতর সম্পদ সৃষ্টিকারী বিত্তবানরা পর্যাপ্ত পরিমাণ কর দিচ্ছেন না। দেশের বড় গতিশীল খাত হলো তৈরি পোশাক। সেখান থেকেও পর্যাপ্ত রাজস্ব মিলছে না। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি দেশে তিন কোটি ব্যবসায়ীর হিসাব দিলেও ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে আয়কর দেন মাত্র ১০ লাখ। তাহলে ওই তিন কোটি ব্যবসায়ী কী করেন? দেশে মাত্র ৩০ লাখ লোকের কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) রয়েছে। এটা খুবই লজ্জাকর ব্যাপার।
সমালোচকদের দিকে আঙুল তুলে মন্ত্রী বলেছেন, এটা মোটেই বিশাল বাজেট নয়, বরং দেশের প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত ছোট বাজেট। আগে জনগণের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কোনো উন্নয়ন না করায় প্রস্তাবিত বাজেটকে অনেকের কাছে বিশাল বলে মনে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাসহ সরকারের বিভিন্ন কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিবারের মতোই সংবাদ সম্মেলন বেশ হাসিখুশিভাবেই শুরু করেন অর্থমন্ত্রী। বাজেট নিয়ে সকালে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সংবাদ সম্মেলনে ওঠা কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর তিনি দেওয়া শুরু করেন নিজে থেকেই। অর্থমন্ত্রী এ সময় বলেন, 'সিপিডি বলেছে, আইএমএফের শর্ত আমরা গোপন করেছি এবং এ সম্পর্কে সংস্থাটি কিছু জানে না।' সিপিডির অজ্ঞতা রয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী জোর দিয়ে বলেন, 'আইএমএফের শর্তগুলো আমরা তাৎক্ষণিকভাবে মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দিয়েছি। আর প্রধানমন্ত্রী ও আমি নিজে যেসব উদ্যোগের কথা বলেছি, আইএমএফ তার বাইরে একটিও শর্ত দেয়নি।'
আরো দেড় বছর সময় থাকলেও অর্থমন্ত্রী কেন এত আগেই পরবর্তী সরকারের কাছে আত্মসর্মপণ করলেন- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, 'আমার আগের তিনটি বাজেট- বিশেষ করে প্রথম বাজেটে বেশ কিছু পরিকল্পনা ছিল। দ্বিতীয় বাজেটের ফর্দ আরো বেশি লম্বা হয়েছিল। আমি পরবর্তী সরকারের উদ্দেশে বলেছি, এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারলে ভালো। এটা ঠিক নতুন সরকারকে দায়িত্ব দেওয়া বা আত্মসমর্পণ করা নয়।'
বাজেটে বড় আকারের ঘাটতি রয়েছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে ওঠা সমালোচনার জবাবে অর্থমন্ত্রী ও অর্থসচিব ড. মোহাম্মদ তারেক বলেন, 'বাজেট ঘাটতি আমাদের দেশে সত্যিই কম। প্রস্তাবিত বাজেটে এটি জিডিপির ৫ শতাংশ। শুধু চলতি অর্থবছরই জিডিপির ৫.১ শতাংশ বাজেট ঘাটতি দেখা দিয়েছে। অন্য বছরগুলোতে এটি ৫ শতাংশের নিচেই ছিল। এখন বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশ প্রাক্কলন করা হলেও নতুন অর্থবছরে এটি জিডিপির ৪.৫ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।'

কালো টাকা প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, 'আমাদের অর্থনীতিতে জিডিপির ৪২ থেকে ৮২ শতাংশই কালো টাকা। এই অর্থ মূল অর্থনীতিতে ফিরিয়ে আনার জন্যই স্বাভাবিক করহারের সঙ্গে অতিরিক্ত ১০ শতাংশ জরিমানার বিনিময়ে তা বৈধ করার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।' তিনি বলেন, ঢালাওভাবে নয়, বরং বিনিয়োগের শর্তে এ অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হবে।
বিদ্যুৎ খাতে সরকারের অগ্রগতি কেন সাংবাদিকরা দেখতে পারেন না, সে বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ২০০৯-১০ অর্থবছরে প্রতি ঘণ্টায় বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো ২৬ হাজার ৫৩৩ কিলোওয়াট। পরের বছর তা বেড়ে হয়েছে ২৯ হাজার ২৪৭ কিলোওয়াট। চলতি অর্থবছরে তা বেড়ে ৩৪ হাজার ও নতুন অর্থবছরে ৪১ হাজার কিলোওয়াট হবে। এত বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরও গভীর রাতে লোডশেডিংয়ের কারণ জানতে চান সাংবাদিকরা। এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য অর্থমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই এলাহীকে দায়িত্ব দিলেও তিনি তেমন কিছু বলেননি। একটি বই দেখিয়ে শুধু বলেছেন, 'বাজেটের অন্যান্য বইয়ের সঙ্গে এটিও আপনাদের দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যেই সব প্রশ্নের উত্তর আছে।' অবশ্য কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, ইজিবাইকগুলো রাতে চার্জ দেওয়া হয়। এতে ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ লাগে। সে কারণেই রাতেও লোডশেডিং হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার, তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান, রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. নাসিরউদ্দিন, বাণিজ্যসচিব মো. গোলাম হোসেন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. শফিকুর রহমান পাটোয়ারী ছাড়াও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.