হামলার ঘটনায় দুই ওসি প্রত্যাহার, দুই থানায় পৃথক মামলা-বিল কপালিয়ায় জোয়ারাধার প্রকল্প নিয়ে অনিশ্চয়তা by মাসুদ আলম

যশোরের ভবদহ এলাকার বিল কপালিয়ায় জোয়ারাধার (টিআরএম-টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) চালু করা নিয়ে অচলাবস্থা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এই জোয়ারাধার নির্মাণের অংশ হিসেবে গত শনিবার পেরিফেরাল বাঁধের নির্মাণকাজ শুরু করতে গিয়ে এলাকাবাসীর হামলার শিকার হন স্থানীয় সাংসদ ও জাতীয় সংসদের হুইপ শেখ আবদুল ওহাব ও অভয়নগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মালেক।


এ ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে অভয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহসান হাবিব ও মনিরামপুর থানার ওসি মো. ছয়রুদ্দিনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। ওই হামলা ও গাড়ি পোড়ানোর ঘটনায় গতকাল রোববার অভয়নগর ও মনিরামপুর থানায় পৃথক মামলা হয়েছে।
বিল কপালিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের অভিযোগ, পাউবো ঠিকমতো ক্ষতিপূরণ না দিয়ে বিলটিতে জোয়ারাধার নির্মাণের কাজ শুরু করতে যাচ্ছে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন বিল কপালিয়ার কয়েক হাজার কৃষক। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা বলছেন, যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু বিলের কিছু ঘেরের মালিক এবং বিলের বিপুল পরিমাণ খাস ও অর্পিত সম্পত্তি দখলদারেরা তাঁদের স্বার্থে জোয়ারাধারের বিরুদ্ধে কৃষকদের বিক্ষুব্ধ করে তুলেছেন।
হুইপ ও চেয়ারম্যানের ওপর হামলার ঘটনায় শনিবার রাতেই দুই ওসিকে প্রত্যাহার করে খুলনা রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়েছে।
হামলা ও গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে অভয়নগর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ফেরদৌস ওয়াহিদ গতকাল ওই থানায় মামলা করেন। এতে মনিরামপুরের নেহালপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক নজমুস সাদাত, মনোহরপুর ইউপির চেয়ারম্যান মো. মোহিতুজ্জামান ও স্থানীয় পরিতোষ সরকার, হরিচাঁদ মল্লিক, ফারুক হোসেনসহ ৩০ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ৪০০ থেকে ৫০০ নারী-পুরুষকে আসামি করা হয়েছে। অভয়নগর থানার ওসি খবির আহমেদ বলেন, ‘দাঙ্গা, অগ্নিসংযোগ ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে এ মামলা করা হয়েছে।’
মনিরামপুর থানার ওসি এ কে এম আজমল হুদা বলেন, ‘এসআই তৌহিদুল ইসলাম অজ্ঞাতনামা চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার লোককে আসামি করে মামলা করেছেন। এতে সরকারি কাজে বাধাদান, অনধিকার প্রবেশ, শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগ আনা হয়েছে।’
বিল কপালিয়ার কৃষকেরা জানান, বিল পূর্ব খুকশিয়ায় এ রকম একটি প্রকল্প করা হয়েছে। ওই প্রকল্প তিন বছরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সাত বছর ধরে চলছে। বিল কপালিয়ায় প্রকল্প তিন বছরেই শেষ হবে—এমন আশ্বাস পাউবো তাঁদের দিতে পারছে না।
মনিরামপুর উপজেলার কপালিয়া গ্রামের কৃষক রবিন সরকার বলেন, ‘বিলে ধান ও মাছ—দুটোই হচ্ছে। টিআরএম হলি বিলে কিছুই হবে না। অনেকেই টিআরএমের পক্ষে ছিল। কিন্তু পাউবো ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়ে টালবাহানা করছে। ক্ষতিপূরণের টাকা ঠিকমতো দিলে কৃষকেরা খেপতেন না।’ তবে অনেকে ইতিমধ্যে ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। অভয়নগর উপজেলার কালিশাকুল গ্রামের দুলাল চন্দ্র হালদার বলেন, ‘আমার ৩২ শতক জমির বিপরীতে দুই বছরের ক্ষতিপূরণ বাবদ ৩১ হাজার ৩৩ টাকা পেয়েছি।’ আরও কয়েকজন ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা জানান।
পাউবোর অতিরিক্ত মহাপরিচালক আজিজুল হক ও যশোরের জেলা প্রশাসক (ভারপ্রাপ্ত) মীর জহুরুল ইসলাম গতকাল বিল কপালিয়া এলাকা পরিদর্শন করেছেন।
পক্ষে-বিপক্ষে: কপালিয়া ব্রিজ এলাকায় গতকালই শত শত নারী-পুরুষ লাঠি নিয়ে মহড়া দিয়েছে ও বিক্ষোভ করেছে। তারা টিআরএমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দেয়।
এদিকে হুইপের ওপর হামলার প্রতিবাদে গতকাল বিকেলে অভয়নগর উপজেলা আওয়ামী লীগ নওয়াপাড়া ইনস্টিটিউট মাঠে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। হুইপ শেখ আবদুল ওহাবসহ আওয়ামী লীগের নেতারা এতে বক্তৃতা করেন। হুইপ বলেন, ‘৭০ থেকে ৮০ জন সন্ত্রাসীর কাছে ২০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা জিমিঞ্চ হয়ে থাকতে পারে না। যেকোনো মূল্যে বিল কপালিয়ায় টিআরএম করা হবে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য: যশোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) জহুরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘জমিতে খুব বেশি জটিলতা না থাকলে আবেদনের সাত দিনের মধ্যে কৃষক ক্ষতিপূরণের টাকা পাচ্ছেন। কিন্তু কৃষকের আবেদনের হার অত্যন্ত কম।’
অভয়নগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মালেক বলেন, ‘টিআরএম ছাড়া জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা পাওয়ার বিকল্প নেই। কিন্তু এলাকার নজমুস সাদাত, হরিচাঁদ মল্লিকসহ কয়েকজন স্থানীয় কৃষক টিআরএমের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ করে তুলছে।’
অভিযোগ প্রসঙ্গে নজমুস সাদাত বলেন, ‘এলাকাবাসীর দাবি বিলটিতে যেন টিআরএম না হয়। আমার নিজের কোনো দাবি নেই। আমি এলাকাসীর দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেছি মাত্র।’ তিনি বলেন, ‘পাউবো কৃষকদের ঠিকমতো ক্ষতিপূরণ দিলে আমি বিলটিতে টিআরএম প্রকল্প করতে তাঁদের সহায়তা করব।’
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিরসনে টিআরএমের বিকল্প নেই। কোনো বলপ্রয়োগ নয়, কৃষকদের বুঝিয়ে টিআরএম বাস্তবায়ন করতে হবে। ঘেরমালিকের আন্দোলনে টিআরএম বন্ধ করতে দেওয়া হবে না।’
যশোর পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মশিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কৃষকদের দুই বছরের ক্ষতিপূরণের টাকা অগ্রিম দিতে আমরা বেশ আগেই জেলা প্রশাসনকে সাড়ে ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছি। কৃষকেরা ক্ষতিপূরণের টাকাও পেতে শুরু করেছেন। এ বছরের ফসল কৃষকেরা পেয়েছেন। আমরা সেটারও ক্ষতিপূরণ দিচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘বিলটিতে অনেক খাস ও অর্পিত সম্পত্তি রয়েছে। ওই সম্পত্তিরও ক্ষতিপূরণ চাওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেটা দেওয়া তো সম্ভব নয়।’
বিল কপালিয়ায় জোয়ারাধার: বিল কপালিয়ায় ২০০৯ সাল থেকে জোয়ারাধার চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পাউবো। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। আগামী ৩০ জুন এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা এক বছর বাড়িয়ে আগামী বছরের ৩০ জুন করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত বছরের জানুয়ারি মাসে বিল কপালিয়ায় ৭৫০ হেক্টর জমিতে জোয়ারাধার নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু করে পাউবো। পরে বছর বিঘাপ্রতি ১৬ হাজার টাকা হারে মোট এক হাজার ৮০০ জন কৃষককে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ পর্যন্ত ১৫৩ জন কৃষককে ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া হয়েছে। আরও ৫০ জন কৃষকের ক্ষতিপূরণের টাকার চেক দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
গত ৫ মে বিল কপালিয়ায় জোয়ারাধার নির্মাণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়। জোয়ারাধার চালু করতে বাধা দেওয়ার অভিযোগে পাউবো নেহালপুর ইউপির চেয়ারম্যান নজমুস সাদাতসহ ৫০ থেকে ৬০ জনের নামে গত ৪ মে অভয়নগর থানায় এবং গত ১০ মে যশোর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে পৃথক মামলা করে।
সমস্যা যেভাবে শুরু: ‘অধিক খাদ্য ফলাও’ কর্মসূচির আওতায় গত শতাব্দীর ষাটের দশকের শুরুতে যশোর ও খুলনা জেলার পাঁচটি উপজেলার সংযোগস্থল অভয়নগরের ভবদহে শ্রী নদীর ওপর নির্মিত হয় ভবদহ স্লুইসগেট। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এলাকার ৫২টি বিলের পানি নিষ্কাশিত হতো এই স্লুইসগেট দিয়ে। প্রথম দশকে ইরি ধানের ব্যাপক ফলন হয়।
আশির দশকের শুরুতে গেটের বাইরে পলি জমে বাঁধের বাইরে নদীর ভেতরের নদী ও ভূমি থেকে উঁচু হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। ১৯৮৪ সালের দিকে এই জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করে। হরি, শ্রী, টেকা ও মুক্তেশ্বরী নদী নাব্যতা হারায়। বন্ধ হয়ে যায় পানি নিষ্কাশনের পথ। বৃষ্টির পানি বিলে আটকা পড়ে বিলসংলগ্ন গ্রামগুলোতে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতার। এই জলবদ্ধতা দূরীকরণে আন্দোলন শুরু করে ভুক্তভোগী মানুষ। ১৯৯৪ সালে খুলনা-যশোর নিষ্কাশন পুনর্বাসন প্রকল্পের (কেজেডিআরপি) কাজ শুরু হয়। ২০০২ সালে ওই কাজ শেষ হয়। এই প্রকল্পের আওতায় হরি, শ্রী, টেকা ও মুক্তেশ্বরী নদীর পলি অপসারণ, খাল খনন ও বিল কেদারিয়ায় জোয়ারাধার নির্মাণ করা হয়।
২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্থানীয় বিএনপির নেতা নজমুস সাদাতসহ আরও ৪৮৩ ব্যক্তি বিল কেদারিয়ায় জোয়ারাধার বন্ধের জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পাউবো ৪৯ দিন ভবদহ স্লুইসগেট বন্ধ রাখে। এতে পলি জমে নদীর বুক উঁচু হয়ে পড়ে। ওই বছরের অক্টোবর মাসের টানা বর্ষণে পুনরায় পানি জমে জলাদ্ধতা দেখা দেয়। এরপর ২০০৬ সালের চার দফা অতি বর্ষণে অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলার দেড় শতাধিক গ্রাম তলিয়ে যায়। পানিবন্দী হয়ে পড়েন চার লক্ষাধিক মানুষ। পানি সরানোর দাবিতে ‘ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি’র নেতৃত্বে শুরু হয় অন্দোলন। এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বিল কপালিয়ায় জোয়ারাধার নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
পানি বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিকল্পিতভাবে জোয়ারভাটা সৃষ্টি করে জমিতে পলি ফেলে জমি উঁচু করার প্রক্রিয়াকে জোয়ারাধার বলা হয়। এর মাধ্যমে জোয়ারের সঙ্গে আসা পলি জমিতে পড়ে এবং ভাটার টানে বেরিয়ে যাওয়া পানি নদীর নাব্যতা বাড়ায়।

No comments

Powered by Blogger.