জজকোর্টের চিত্র-এ কেমন নৈরাজ্য?

ঢাকা জজকোর্ট এলাকায় এক শ্রেণীর দালাল ও টাউট চক্রের যে চিত্র বৃহস্পতিবার সমকালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, তা উদ্বেগজনক। সাধারণভাবে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনে ভরসা হারিয়ে যাওয়ার পরই কেবল প্রতিকারের জন্য কেউ আদালতে যায়।


কিন্তু সেখানেও যদি টাউট ও দালালরা সময়, অর্থ ও শান্তি ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য 'ওত পেতে' থাকে; বিচারপ্রার্থীরা যাবে কোথায়? সমকালের ওই প্রতিবেদনে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে যে সিএমএম কোর্ট সংলগ্ন পুলিশ ক্লাবের আশপাশ, কোর্ট হাজতখানার সামনে, জেলা প্রশাসক ভবনের চত্বরসহ আদালত সংলগ্ন বিভিন্ন স্থানে দালাল-টাউটরা কীভাবে অবস্থান করে। কীভাবে 'শিকার' ধরে নিয়ে যায় তাদের সহযোগী কিছু আইনজীবীর কাছে। সেখানে নিয়ে কোনোভাবে মামলা পরিচালনার সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর নেওয়ার পরই শুরু হয় নানা অজুহাতে অর্থ আদায়। খোদ আদালতপাড়ায় এমন নৈরাজ্য মেনে নেওয়া যায় না। বিচার সংক্রান্ত বিভিন্ন দাফতরিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ পুরনো। তা এক ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত রেওয়াজে পরিণত হয়েছে বললেও অত্যুক্তি হবে না। বিচারপ্রার্থীরা সে জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতও থাকে। কিন্তু দালাল-টাউটরা যেভাবে বিচারপ্রার্থীর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আটকে হাজার হাজার টাকা আদায় করে, তা কেবল হয়রানি নয়, গুরুতর অপরাধ। হত্যা, ধর্ষণ, মাদক_ যত বড় মামলাই হোক না কেন, যেভাবে একদিনে বা এক সপ্তাহে জামিনের আশ্বাস দেওয়া হয়, তা কেবল বিচারপ্রার্থীর সঙ্গে প্রতারণা হতে পারে না; আইন ও বিচার ব্যবস্থার মাথায়ও কাঁঠাল ভাঙার সমান। আদালত চত্বরে গিয়ে এমন 'আশ্বাস' পাওয়ার পর সর্বশেষ ভরসাস্থল বিবেচনা করে আদালতে যাওয়া ব্যক্তির মনে এমন আশঙ্কা হওয়া বিচিত্র নয় যে, সেখানে অর্থের বিনিময়ে সবই সম্ভব। সমকালের প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে যে, টোপ দিয়ে টাকা আদায় করলেও এক সপ্তাহের মধ্যেই জামিন করানোর আশ্বাস মাসের পর মাস গড়িয়ে গেলেও পূরণ হয় না। অজুহাতের রাজা দালালরা জামিন বিলম্বের জন্য নাকি বিচারকের দোষ দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। আমরা কি কিছু ব্যক্তির সাময়িক ও অবৈধ সুবিধার জন্য বিচার ব্যবস্থার ভাবমূর্তি স্থায়ীভাবে নষ্ট হতে দিতে পারি? ঢাকা জেলা ও মহানগর আদালত প্রাঙ্গণের এই হয়রানি ও নৈরাজ্যের দায় কিছু আইনজীবীকেও নিতে হবে। তারা আশ্রয়-প্রশ্রয় না দিলে দালালরা এতটা সাহস ও সুবিধা করতে পারত না। সমকালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক সময় বিচারপ্রার্থী জানেনই না যে তার মূল আইনজীবী কে, দালালই সব দায়িত্ব নিয়ে নেয়। ঢাকার নিম্ন আদালতপাড়ার এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বড় ভরসা হতে পারে ঢাকা আইনজীবী সমিতি। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, এসব অভিযোগের ভিত্তিতে বিভিন্ন সময়ে সমিতির পক্ষে তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও ফলাফল শূন্য। প্রশ্ন হচ্ছে, এই শূন্যতা কি দায়িত্বশীলতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা দিয়ে পূরণ হতে পারে না? আমরা আশা করব, আইনজীবীরা দালাল ও টাউট নয়, মেধা ও যোগ্যতার সাহায্যেই নিজেদের পসার বৃদ্ধি করবেন। এক্ষেত্রে সমিতি কড়া নির্দেশনা ও নজরদারি জারি রাখতে পারে। আমরা বিশ্বাস করি, আইনজীবীরা সক্রিয় হলে পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটবেই। আর দালাল-টাউটদের আদালতপাড়া ছাড়া করার জন্য পুলিশ প্রশাসনের সক্রিয়তাই যথেষ্ট। সমকালের প্রতিবেদনে দালালদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট অথচ বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। এখন প্রয়োজন কেবল সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা।
 

No comments

Powered by Blogger.