সদরে অন্দরে-অসুস্থ স্বাস্থ্য খাত, কে সারাবে তাকে by মোস্তফা হোসেইন

মন্ত্রী যাচ্ছেন পটুয়াখালী। পথে বাকেরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কাছে গাড়ি ঘুরিয়ে নিলেন। অনেক রোগী সেখানে চিকিৎসা লাভের আশায়। জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, এই হাসপাতালে আপনারা চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন তো ঠিকমতো? একটি থানা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসা রোগীদের কী জবাব হতে পারে, তা বোধ করি খুলে বলার দরকার নেই। একটু ভিন্ন দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক।
মন্ত্রী কী মনে করে গেলেন এক্স-রে কক্ষে। অবাক কাণ্ড! মন্ত্রী যে মুহূর্তে এক্স-রে কক্ষে পা রেখেছেন, অমনি বিদ্যুৎ চলে গেল ওই হাসপাতালের। মন্ত্রীর সন্দেহ হওয়ায় তিনি যান বিদ্যুৎ সরবরাহ কক্ষে। সেখানে যেতেই মন্ত্রীর সন্দেহের সত্যতা মিলল। তিনি দেখলেন, কেউ একজন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। বিদ্যুৎ সংযোগ আবার চালু করতেই এক্স-রে যন্ত্রটি সচল হয়ে উঠল।
এই কাহিনী শুনে যদি কোনো ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান সাজানো গল্প মনে করে, তাদের কালের কণ্ঠ পত্রিকার ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত সংবাদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করব। মন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন মেশিনের টেকনিশিয়ান দেওয়ান সোহেলের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের। বাংলাদেশের একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মন্ত্রী মহোদয়ের পা পড়েছিল বলে পত্রিকার পাতায় এ সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল। ছোট সংবাদ ছিল এটি। কিন্তু বড় আকারের দাগ দিয়ে রেখেছে আমাদের চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রগুলো। এই অবহেলা ও দুর্নীতি যে শুধু টেকনিশিয়ান কিংবা চিকিৎসকরাই করছেন, তা নয়, বরং তা প্রশাসনের পক্ষ থেকে হচ্ছে, বেসরকারি ক্লিনিকগুলোও করছে এবং অবহেলার সঙ্গে ঊর্ধ্বতন মহলের সংশ্লিষ্টতাও পাওয়া যায়।
অথচ বাংলাদেশে চিকিৎসাসেবা খাতে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে, এটা স্বীকার করে নিতেই হবে। ব্যয়বহুল অনেক আধুনিক চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে সম্ভব। মাত্র কয়েক বছর আগেও কেউ চিন্তা করতে পারেনি, বাংলাদেশে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট থেকে করোনারি বাইপাস পর্যন্ত আধুনিক চিকিৎসা সহজেই হতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, এত উন্নতির পরও কোন কারণে বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবা নিয়ে এত উদ্বেগ? কেন? দুঃখজনক হচ্ছে, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পেছনে যেসব কারণ রয়েছে, সেগুলোর একটিও পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মতো নয়।
প্রায় ৬০ হাজার চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ হয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে। সাড়ে ১৮ হাজার কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিক করার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সরকার। ইতিমধ্যে সাড়ে ১১ হাজার প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে; এবং সেখানে সাড়ে ১৩ হাজার হেলথ প্রোভাইডার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
সরকারি হিসাবের খাতায় যোগ-বিয়োগের পাল্লা ভারী। কাজের ফিরিস্তি তুলে ধরলে মনে হবে, স্বাস্থ্য খাতে এখন সুদিন চলছে। সাধারণ মানুষ এখন চিকিৎসা সুবিধা পাচ্ছে প্রয়োজন অনুযায়ী। কিন্তু এটা কি আমাদের প্রকৃত অবস্থার চিত্র বলে বিশ্বাস করতে সহযোগিতা করে? আরেকটি সংবাদের দিকে নজর দেওয়া যাক। এটাও কালের কণ্ঠে প্রকাশিত হয়েছে, গত মার্চ মাসের মাঝামাঝি। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হক কুমিল্লার চান্দিনা এবং শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ফোন করেন। সময় সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১২টা। দুই কর্মস্থলে সেই সময় আটজন চিকিৎসককে অনুপস্থিত পান। একপর্যায়ে ডা. নাসের ইকবাল নামের একজন চিকিৎসকের ফোনে কল করেন। এ সময় ডা. নাসের মন্ত্রীকে বলেন, 'স্যার, আমি বাথরুমে।' মন্ত্রী যাচাই করেন বিষয়টি। জানতে পারেন, চিকিৎসক আদৌ কর্মস্থলেই নেই। তিনি মিথ্যা বলেছেন মন্ত্রীকে।
এগুলো তো সরাসরি সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান। সেখানে মন্ত্রী, সচিব এবং ডিজি অফিস থেকে তদারকি করার সুযোগ আছে। কমবেশি তদারকি হচ্ছে বলেও শোনা যায়। ডিজি হেলথ এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পৃথক ভিজিল্যান্স টিম দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো পরিদর্শন করছে বলেও জানা যায়। আর সেই সুবাদে ৮০০ চিকিৎসককে গত দেড় বছরে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো চিকিৎসালয়ে সিসিটিভিও স্থাপন করা হয়েছে ইতিমধ্যে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে মনিটর করার তথ্যও জানা যায়।
কিন্তু মানসিকতার যদি পরিবর্তন না হয়, আর চিকিৎসকরা যদি রাজনীতির ঊর্ধ্বে না উঠতে পারেন, তাহলে কি মোবাইল ফোন কিংবা সিসিটিভি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে? যেমন সম্ভব হচ্ছে না দেশের বেসরকারি ক্লিনিকগুলোকে।
শত শত বেসরকারি ক্লিনিক ব্যবসা করছে বাংলাদেশে। এ ক্লিনিকগুলো সেবাকে যদি ব্যবসার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার না করত, তাহলে হয়তো বাংলাদেশের মানুষ অধিক সুবিধা পেত। প্রায় নিয়ন্ত্রণহীন এসব ক্লিনিক এখন গলাকাটা ব্যবসায় নিয়োজিত বলে মানুষ অভিযোগ করছে। ঢাকার বড় বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোর অপব্যবসা নিয়েও কালের কণ্ঠে একাধিকবার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সরকারি চিকিৎসালয়ের চিকিৎসকরা সেখানেও পার্টটাইম চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকেন। গলাকাটা অবস্থা সেখানেও। প্রতিটি ক্লিনিকে গরিবের চিকিৎসার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকার কথা থাকলেও তেমন কোনো সুবিধা কি আছে বাংলাদেশের এসব ক্লিনিকে?
আর চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোর পরিবেশও কি স্বাস্থ্যসম্মত? ঢাকার গ্রিন রোডে ল্যাব এইডের কাছাকাছি একটি বড় হাসপাতালে কয়েক মাস ধরে যেতে হয় এক নিকটজনের চিকিৎসার প্রয়োজনে। কী দুর্বিষহ অবস্থা সেখানে! সার্জারির ডাক্তারসহ জনা দশেক চিকিৎসক বসেন অ্যানেক্স বিল্ডিংয়ের একটি ফ্লোরে। রোগীদের ওয়েটিং রুমের অবস্থা বর্ণনাতীত। একজন হার্টের চিকিৎসক, আরেকজন পাইলস, বৃহদন্ত্র সার্জারি ও জেনারেল সার্জারির চিকিৎসকের রোগীদের বসার জায়গাটা সাড়ে তিন ফুট চওড়া। একটি মাত্র ওয়ালফ্যান সেখানে লাগানো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেখানে রোগীদের বসে থাকতে হয়। অসুস্থ মানুষগুলোকে ঘেমে নেয়ে উঠতে হয় সেই সুড়ঙ্গ সদৃশ জায়গায় বসে। অথচ এসব রোগীর কাছ থেকে কী পরিমাণ পয়সা আদায় করা হয়, তা জানার জন্য একটি মাত্র অভিজ্ঞতার কথা বলি। রোগিণীকে নেবুলাইজ করতে হবে। অপারেশনের আগে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাকে দুবার এবং পরবর্তীকালে একবার নেবুলাইজ করা হয়। পাড়ায় ডাক্তারের চেম্বারে যেখানে প্রতিবার নেবুলাইজ করতে খরচ হয় ৭০ থেকে ১০০ টাকা, সেখানে ওই ক্লিনিক থেকে তিনবার নেবুলাইজ করতে খরচ নেওয়া হয়েছে তিন হাজার ৫০০ টাকা।
চিকিৎসকের ভিজিট নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো নিয়মকানুন নেই। অপারেশনের জন্য কত ফি দিতে হবে, তারও কোনো নীতিমালা নেই। সুতরাং একবার যে ক্লিনিকে যায়, তাকে জীবনের ধাক্কা খেতে হয়। অবশ্য সে যদি হয় মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন আয়ের মানুষ, তাহলে তার মেরুদণ্ড ভেঙে যাওয়ার অবস্থা হতে বাধ্য।
বেসরকারি ক্লিনিকগুলোর এই অরাজকতা চলছে তাদের পরিচালনার জন্য কোনো সরকারি নীতিমালা না থাকায়। যোগ্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকায় সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল, বেসরকারি ক্লিনিকগুলোর জন্য নীতিমালা করা হবে। অন্তত একজন পেশাজীবী মানুষ হিসেবে তিনি দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন করবেন। বেসরকারি ক্লিনিকগুলো পরিচালিত হচ্ছে ১৯৮২ সালের আইনের মাধ্যমে। পুরনো দিনের কথা বলে ক্লিনিক ও চিকিৎসকরা ইচ্ছামতো কাজ করে যাচ্ছে। মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে দিনের পর দিন। এ অবস্থার অবসান হওয়া দরকার।
স্বাস্থ্যনীতি হয়-হচ্ছে করে এত দিনে গেছে সংসদীয় কমিটিতে। কবে তা ঘোষণা হবে কিংবা কার্যকর হবে, তা ভবিতব্য। লোকবল ঘাটতি আছে এখনো। সরকারের পরিকল্পনায় আছে আট হাজার ডাক্তার ও পাঁচ হাজার নার্স নিয়োগ। কবে হবে সেগুলো? স্বাচিপের বেড়াজাল ডিঙিয়ে সঠিকভাবে কি তাদের নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হবে? নাকি পদোন্নতি এবং সাম্প্রতিক নিয়োগের মতোই নানা বিতর্কের জালে আটকা পড়বে সেগুলো? সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কিভাবে স্বাস্থ্য খাতের অসুস্থতা দূর করা হবে।
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.